ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়াতে জোর প্রচেষ্টা থাকবে ॥ পরিকল্পনামন্ত্রী

দেড় লাখ কোটি টাকার এডিপি বাস্তবায়নে ৬ কৌশল চূড়ান্ত

প্রকাশিত: ০৫:০১, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

দেড় লাখ কোটি টাকার এডিপি বাস্তবায়নে ৬ কৌশল চূড়ান্ত

আনোয়ার রোজেন ॥ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) বাস্তবায়ন হার বাড়াতে কৌশল চূড়ান্ত করেছে পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগ। কৌশলের আওতায় চলতি অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ছয়টি বিষয়ের ওপর জোর দেয়া হবে। এগুলো হলো- চলমান প্রকল্প সংশোধন ও মেয়াদ বৃদ্ধি, সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ও ক্রয় পরিকল্পনা, নতুন প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন, প্রকল্পের বাস্তবায়ন মনিটরিং, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অর্থায়নপুষ্ট প্রকল্পের বাস্তবায়ন এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়াবলী। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৬ মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে এসব বিষয়ে নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আওতায় বাস্তবায়নাধীন মোট ৮৯৪ প্রকল্পের অনুকূলে মোট বরাদ্দের পরিমাণ ১ লাখ ৪০ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা, যা মোট এডিপি বরাদ্দের ৮৬ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, অর্থবছরের শুরু থেকেই এডিপি বাস্তবায়নে কৌশল নির্ধারণে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই আলোকে কৌশল ঠিক করা হয়েছে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়াতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকবে চলতি অর্থবছরে। বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা সামগ্রিকভাবে বর্তমানে ভাল অবস্থায় আছে। কোথাও মন্দাভাব নেই। এই বছর অর্থনীতির জন্য ভাল একটি বছর হবে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমাদের এডিপি শতভাগ বাস্তবায়ন ও গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। মন্ত্রী বলেন, প্রকল্পগুলোয় সরকারী তহবিলের অর্থ ব্যয় বেশি হলেও বৈদেশিক সহায়তা অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হয়। এডিপি কম বাস্তবায়নের এটি একটি অন্যতম কারণ। এবার এটিসহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সৃষ্ট হওয়া অন্যান্য জটিলতা নির্ধারিত কৌশলের আওতায় দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে। উল্লেখ্য, ৬ বছর ধরে এডিপি বাসবায়ন ঘুরপাক খাচ্ছে ৯০ থেকে ৯৩ শতাংশের মধ্যেই। গত অর্থবছরে ১ লাখ ১৯ হাজার ২৯৬ কোটি টাকার সংশোধিত এডিপির বাস্তবায়ন হয়েছে ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ সংশোধিত এডিপির জন্য বরাদ্দ অর্থের মধ্যে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এডিপির আকার বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিলের আকার ৯২ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা, প্রকল্প সাহায্য ৬০ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ১০ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা। সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) এডিপি বাস্তবায়নের হার কিছুটা বেড়ে ৫ শতাংশ হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে বাস্তবায়ন হার ছিল ৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এবার দুই মাসে এডিপি বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা, যা গতবারের একই সময়ের ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ। গত অর্থবছরে জুলাই-আগস্টে ব্যয় হয়েছির ৪ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। আবার দুই মাস পেরিয়ে গেলেও এডিপিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং সেতু বিভাগের খরচের খাতা শূন্য। প্রকল্প সাহায্য থেকে তারা কোন অর্থ ব্যয় করতে পারেনি। বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞগতায় দেখা গেছে, বিদেশী সহায়তার অর্থ ব্যবহারের নিম্নহার সামগ্রিকভাবে এডিপি বাস্তবায়নের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারী বিনিয়োগের অন্যতম হাতিয়ার হলো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এডিপির সফল বাস্তবায়ন অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে থাকে। বেসরকারী বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বিনিয়োগে গতি সঞ্চার করে সরকারী বিনিয়োগ বা এডিপির সফল বাস্তবায়নের ওপর। এবছর এডিপির কার্যকর ও গুণগত মানসম্পন্ন বাস্তবায়নে যে সব কৌশল অনুসরণের কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলো- অক্টোবরের মধ্যে ৫২ প্রকল্প সংশোধন ও মেয়াদ বৃদ্ধি এবার এডিপিতে ৫২টি প্রকল্প সংশোধিত অননুমোদিত অবস্থায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সফলভাবে বাস্তবায়নের স্বার্থে প্রকল্পগুলো আগামী অক্টোবরের মধ্যে একনেকে অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ ১৮১টি প্রকল্প তারকা চিহ্নিত অবস্থায় এবারের এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৩০ জুন ২০১৭ এর মধ্যে এসব প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য বারবার তাগাদা দেয়া সত্তেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তা আমলে নেয়নি। যে কারণে অর্ধেকের বেশি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি। তারকা চিহ্নিত প্রকল্পের ক্ষেত্রে মেয়াদ বৃদ্ধি বা সংশোধন করা না হলে অর্থছাড়/ অর্থব্যয় করা সম্ভব হয় না, যার প্রভাব এডিপি বাস্তবায়নের ওপর পড়ে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সমাপ্তির জন্য প্রকল্প তালিকা হালনাগাদ ডিসেম্বরের মধ্যে চলতি অর্থবছরে ৪১১টি প্রকল্প (বিনিয়োগ ৩৭৮টি ও কারিগরি সহায়তা ৩৩টি) সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অর্থবছরের শুরুতে সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত থাকলেও কিছু কিছু প্রকল্প অর্থ বছরের শেষ পর্যায়ে সমাপ্ত না করে মেয়াদ বৃদ্ধি বা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর ফলে সময় মতো এসকল প্রকল্পের সুফল হতে জনগণ বঞ্চিত হয় এবং বাজেট ব্যবস্থাপনায় সৃষ্টি হয় জটিলতা। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি (ভৌত ও আর্থিক) পর্যালোচনা করে সমাপ্তির জন্য নির্ধারতি প্রকল্প তালিকা ডিসেম্বরের মধ্যে ফের হালনাগাদ বা চূড়ান্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এজন্য অর্থবছরের শুরুতেই সব প্রকল্পের ক্রয় পরিকল্পনা অনুমোদন এবং সময় ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে বলা হয়েছে। নতুন প্রকল্পের দ্রুত অনুমোদন এবার এডিপিতে অননুমোদিত ও বরাদ্দহীনভাবে অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পের সংখ্যা ১ হাজার ৩১৫টি। এসব প্রকল্পের জন্য ‘অননুমোদিত প্রকল্পের বরাদ্দ’ হিসেবে মোট ৮ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এর মধ্যে জিওবি ৭ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা এবং প্রকল্প সাহায্য ১ হাজার ১১২ কোটি টাকা। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও এডিপি প্রণয়নের নীতিমালার অগ্রাধিকার বিবেচনায় একনেকে এসব প্রকল্পের দ্রুত অনুমোদন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। বিদেশী সহায়তা প্রাপ্তির সুবিধা আছে এমন ৩৬০টি অননুমোদিত প্রকল্পের অনুমোদন ও অর্থায়ন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। সমন্বিতভাবে প্রকল্পের বাস্তবায়ন মনিটরিং প্রকল্প মনিটরিংয়ের জন্য এককভাবে আইএমইডির ওপর নির্ভরশীলতা পরিহারের সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আইএমইডির পাশপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে মাঠ পর্যায়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়মিতভাবে মনিটর করতে হবে। প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন ও গুণগতমান নিশ্চিত করার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সচিব, উর্ধতন কর্মকর্তা এবং প্রকল্প পরিচালকদের মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন কাজ পরিদর্শনের সুপারিশ করা হয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নের ১১৬ প্রকল্প এবার এডিপিতে স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সংস্থা এবং কর্পোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নপুষ্ট ১১৬টি প্রকল্প ১০ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দসহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। দেখা গেছে, প্রতিবছর প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এসব সংস্থা এডিপিতে বরাদ্দের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে ফেলে। এমন ক্ষেত্রে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (আরএডিপিতে) প্রদত্ত বরাদ্দ ও ব্যয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়াবলী প্রকল্প পরিচালকের প্রকল্প এলাকায় অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি জারিকৃত পরিপত্র যথাযথভাবে অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়ন-সহযোগী হতে প্রতিশ্রুত অর্থ প্রাপ্তি ত্বরান্বিত এবং বরাদ্দ অনুসারে ব্যয়ের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ স্থাপন করবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন সহযোগীর আর্থিক নিয়ম-কানুন সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালকসহ বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। অন্যদিকে ইআরডি প্রকল্প সাহায্য বরাদ্দের অগ্রগতি নিয়ে নিয়মিত মনিটরিং সভা আয়োজন করতে পারে।
×