ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ইস্যু ॥ কোথায় চীনপন্থীরা কোথায় বেগম জিয়ার টুইট?

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা ইস্যু ॥ কোথায় চীনপন্থীরা কোথায় বেগম জিয়ার টুইট?

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার আন্তর্জাতিকভাবে কতটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে নিরাপত্তা পরিষদে এ সংক্রান্ত সর্বশেষ বৈঠকটি হয়ে যাওয়ার পরে। যদিও ইতোমধ্যে চীন জোরালো ভাষায় মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক কমিউনিটির সমর্থন চেয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রিটেনের ভূমিকা আমরা জানি, নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনে ব্রিটেন মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতেও পিছপা হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। এখানেই বোধকরি গণতান্ত্রিক ইউরোপ আর একদলীয় চীনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য। কিন্তু চীন কেন মিয়ানমারের এই বর্বরতায় সঙ্গী হচ্ছে তা ব্যাখ্যা করার জন্য আজকের লেখা নয়, বরং কেন আজকে বাংলাদেশের চীনপন্থী রাজনৈতিক দলসমূহ, চীনা-নীতির কট্টর সমর্থক বুদ্ধিজীবী এবং অধুনা গজানো ফেসবুকীয় চীনা ছত্রাকের দল রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের ভূমিকা সম্পর্কে নীরব, সে প্রশ্নটাই তুলতে চাইছি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে এদেশীয় রাজনীতিও যে ভয়ঙ্কর বাস্তবতা, সেটিও আলোচিত হওয়া দরকার। একথা সত্য যে, মিয়ানমার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষ একথা নিশ্চিত করেই জানে যে, তারা যদি রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমদের এদেশে ঠেলে দেয় তাহলে বাংলাদেশে মূলত তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এক. বাংলাদেশের মানবিকতাবাদী, গণতন্ত্রপন্থী অংশটি সামগ্রিকভাবে এর প্রতিবাদ জানাবে, দুই. বাংলাদেশের ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি করা অংশটি রোহিঙ্গারা মুসলমান বলে তাদেরকে কেবল এদেশে আশ্রয় দেয়া নয়, তাদের পাশে দাঁড়ানোর নামে তাদেরকে ভবিষ্যত ভোটব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশেই রেখে দেয়ার চেষ্টা করবে এবং তিন. যেহেতু বাংলাদেশে চীনপন্থী রাজনীতির একটি শক্তিবলয় আছে, তারা চীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা-নিধন যজ্ঞে টু-শব্দটি করবে না। ফলে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার পড়বে বড় ধরনের বিপদে, তারা কোন্্ দিক সামলাবে তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে আর এর ফাঁকে মিয়ানমার তাদের কাক্সিক্ষত রোহিঙ্গা নিধন কর্মটি শেষ করে ফেলতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকার যে বিষয়টিকে অতি দ্রুত একটি আন্তর্জাতিক ‘ইস্যু’ বানিয়ে ফেলতে সক্ষম হবে সেটি মিয়ানমার ভেবে থাকলেও তার পরিণতি সম্পর্কে এখনও ঠিক নিশ্চিত হতে পারছে না। তবে একথা জোর দিয়েই বলা যায় যে, আসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুটি তোলার ঘোষণা দেয়ার পর পরই মিয়ামনারের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী নেত্রী আউং সাং সুচি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এবার না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, কারণ তিনি সেখানে গেলেই এবার তাকে ভয়ঙ্কর সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু এভাবে পালিয়ে তিনি আসলেই বাঁচতে পারবেন কিনা তা নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত বৈঠকটি হওয়ার পরেই বোঝা যাবে। মিয়ানমার থেকে ভয়াবহ নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে যে এদেশে রাজনীতি হবে বা অতীতেও হয়েছে তা নতুন করে বলার বিষয় নয়। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকলে আজকে রাজনীতিটা অন্যরকম হতো তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু যেহেতু তারা এখন বিরোধী দলে সেহেতু তারা বার বার রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতার কথা বলছে এবং টেবিল ভেঙে ফেলছে গলাবাজিতে, যদিও আজ অবধি তাদের কোন পাতি নেতার পক্ষে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে তাদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার সময় ও সুযোগ হয়নি। বিএনপি নেত্রী তার দলের ভাইস চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন। যদিও তিনি কথায় কথায় সামান্য বিষয়ে টুইটারে বিবৃতি দেন, কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি কোন টুইট করেছেন বলে তার টুইটার এ্যাকাউন্ট তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না। হতে পারে যে, তিনি বাংলায় বিবৃতি দিয়েছেন কেবল দেশের ভেতর তাদের রোহিঙ্গা-রাজনীতিকে জীবিত রাখার জন্য আর টুইটারে কিছু বললে তো সেটা তাকে ইংরেজীতে বলতে হবে এবং তাতে তো চীনের সঙ্গে তার সম্পর্কে কিছুটা হলেও প্রভাব পড়তে পারে, নারাজ হতে পারে পাকিস্তান বা সৌদি আরব। সে কারণেই হয়তো তিনি রোহিঙ্গাদের নিয়ে টুইট করা থেকে বিরত থেকেছেন। একদা চৈনিক রাজনীতি থেকে তার দলে ভর্তি হওয়া মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার শুদ্ধ উচ্চারণে হাত নাচিয়ে বর্তমান সংসদে কেন রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব আনা হলো না সে জন্য সরকারকে দায়ী করে জ¦ালাময়ী বক্তব্য দিতে পারেন কিন্তু কোনভাবেই তার নেত্রী বেগম জিয়ার কাছ থেকে একটি টুইট বার্তা আদায় করতে পারেন না। সে ক্ষমতা আসলেই তার নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাংলাদেশের ওপর এত বড় একটি বিপদ নেমে এসেছে, তাও প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে, এত বড় একটি ভয়াবহ বন্যা কাটাল বাংলাদেশ, আর এই সময় কিনা তার দলের নেত্রী মাসের পর মাস লন্ডনে পড়ে রয়েছেন, বাংলাদেশ বলেই এরকম একটি রাজনৈতিক দলের রাজনীতি এদেশের মানুষকে সহ্য করতে হয়, অন্য কোন দেশ হলে রাজনীতিতে বিএনপিকে বহু আগেই মানুষ ‘খোদা হাফেজ’ জানাত। আমরা এদেশে চীনপন্থী রাজনীতি বলতে যা বুঝি তা মূলত আওয়ামী লীগ ও ভারত-বিরোধিতা, আর যাদেরকে চীনপন্থী রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, বিশ্লেষক হিসেবে চিনি তারা মূলত শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা ও ভারত-বিদ্বেষী রাজনীতিকেই এদেশে উস্কে দিয়ে থাকেন। রামপাল ইস্যুর কথাই যদি ধরি তাহলে এদেশে চীনের অর্থায়নে যে সব বিদ্যুত কেন্দ্র হচ্ছে সেসব নিয়ে তাদের কোন কথা না থাকলেও রামপাল ইস্যুতে তারা কেবল সক্রিয় তাই-ই নয়, তারা জানপ্রাণ দিয়ে হলেও রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র হতে দেবেন না, এরকমটাই তাদের অবস্থান। সমালোচকরা বলেন, রামপালও চীনকেই দেয়া উচিত ছিল, তাতে অন্তত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এত বাধার মুখোমুখি হতে হতো না। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে যেহেতু মিয়ানমারের পক্ষে চীন জোরালো অবস্থান নিয়েছে সেহেতু কোন চীনপন্থী রাজনৈতিক দল বা বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক বা ফেসবুকীয় ছত্রাকদের দেখা যাচ্ছে না এ জন্য চীনের সমালোচনা করতে। যদিও তারা ভারতকে এ জন্য গাল দিয়ে নিহত করে ফেলছেন। এদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সাফল্যকে ম্লান করার জন্য যে সব রাজনীতিবিদের বহু কসরত করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে তার মধ্যে রেড মওলানা খ্যাত ভাসানী অন্যতম, চীনের সঙ্গে যার ছিল আদিমতম সখ্য। কথায় কথায় যিনি স্বাধীন বাংলাদেশে চীনের জোরে প্রতিবিপ্লব ঘটানোর হুমকি দিতেন, ভুট্টোর কাছে চিঠি লিখতেন দেশোদ্ধারের জন্য, সেই মওলানা ভাসানীর পক্ষেও সম্ভব হয়নি ১৯৭২ সালের ২১ আগস্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদের বিরুদ্ধে চীনের দেয়া ভেটোকে ঠেকানোর, ফলে ভাসানীপন্থী বা ভাসানীজাত চীনা রাজনীতির এদেশীয় এজেন্ট বা দোসরদের পক্ষে আজ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনে চীনের সমর্থনের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কোত্থেকে আসবে? তারা পারবেন রোহিঙ্গাদের মানুষ হিসেবে নয়, কেবল মুসলমান হিসেবে নির্যাতিত হওয়ার ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করে এদেশে রাজনীতি করতে যেমনটি ভাসানী করেছিলেন আমাদের সংবিধানের চার মূলনীতি (সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা) নিয়ে, তিনি পল্টন ময়দানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, এই সংবিধান কোরআন-হাদিস মতো হয়নি, এই সংবিধানকে তিনি ছুড়ে ফেলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং সেটাই করেছিলেন তার রাজনৈতিক উত্তরসূরি জেনারেল জিয়াউর রহমান, সংবিধানকে কেটেছিঁড়ে বাদ দিয়ে। চীনপন্থী রাজনীতির জনক ভাসানী এদেশকে কখনও মুসলিম বাংলা কখনও ‘হুকুমতে রাব্বানী’ প্রতিষ্ঠা করে ‘নতুন পতাকা’ ওড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন বার বার, আজকে যারা তার অনুসারী, তারাও এদেশে সেই রাজনীতিই করে যাচ্ছেন, তাদের জোব্বার রং লাল ঠিকই কিন্তু তাদের লুঙ্গি বা আস্তিনের নিচে চাপাতি, উদারপন্থীদের ঘাড়ে সে চাপাতি যখন-তখন নামিয়ে দিতে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হয়। এই মুহূর্তে তারা বিএনপি নামক রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমটির সঙ্গে আছে বটে কিন্তু তাদের শেষ আশ্রয় যুদ্ধাপরাধী ও রগকাটা রাজনৈতিক দল জামায়াত-শিবির। মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর চেহারা উন্মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। তাহলে ভবিষ্যতে যারা এদেশে রোহিঙ্গা-রাজনীতি করতে আসবেন তাদেরকে জনগণ প্রতিহত করতে পারবে। আজকে এই সত্যই আমাদের সামনে উন্মোচিত যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে এদেশের চীনপন্থীরা হয় নিশ্চুপ, নয় তাদের সেই পুরনো ইসলাম কার্ড খেলছেন আর সর্বাধিক চীনপন্থী রাজনীতিবিদদের আশ্রয়স্থল বিএনপি রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশের মাঠ গরম রাখছে সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতার ধোঁয়া তুলে আর তাদের নেত্রী লন্ডনে বসে নিজের ঘর সাজানোর জন্য সস্তায় বাজার-সদায় করছেন বলে আমরা দেখতে পাই, নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে তার কথা বলার সময় কোথায় বলুন? আগেই বলেছি, বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, এদেশের রাজনীতি এরকমই, নৈতিকতা ও অনৈতিকতার ফারাকটি আমরা ধরতে পারি না, যারা ধরতে পারি তারা এদেশে সুশীল চেহারা নিয়ে টকশো আর সেমিনার নিয়েই ব্যস্ত থাকি। ঢাকা ॥ ১৩ সেপ্টেম্বর, বুধবার ॥ ২০১৭॥ [email protected]
×