ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মনজুরুল আহসান বুলবুল

রোহিঙ্গা ॥ কী বলছে আনান কমিশন!

প্রকাশিত: ০৫:০০, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা ॥ কী বলছে আনান কমিশন!

(শেষাংশ) তিন প্রধান সঙ্কট কমিশন প্রাথমিকভাবে রাখাইন রাজ্যের তিনটি সঙ্কট চিহ্নিত করে। এই তিন সঙ্কট হলো : উন্নয়ন সঙ্কট, মানবাধিকার সঙ্কট এবং নিরাপত্তা সঙ্কট। এসব খাতের মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ৮৮টি সুপারিশ করেছে আনান কমিশন। পিছিয়ে পড়া রাখাইন উন্নয়ন সঙ্কট বিশ্লেষণ করে দেখা যায় : রাখাইন রাজ্য সার্বিকভাবে দেশের অন্য অংশের চাইতে সকল অর্থেই পিছিয়ে আছে। মিয়ানমারে সামগ্রিকভাবে দরিদ্রের হার যখন ৩৭.৫৪ শতাংশ. তখন রাখাইনে দরিদ্রের হার প্রায় ৭৮ শতাংশ। উত্তর রাখাইনে ৬০ ভাগ পরিবার গৃহহীন। তবে রাখাইন রাজ্য ঘিরে রয়েছে ভারত ও চীনের বিশাল প্রকল্প। যেমন, ভারত-মিয়ানমার যৌথ উদ্যোগে কালাদান মালটি-মডেল ট্রান্সপোর্ট ট্রানজিট প্রকল্প ভারতের মিজোরামকে চীন ও রাখাইন হয়ে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযোগ করবে। এই প্রকল্পের অন্যান্য অংশজুড়ে রয়েছে ভারতের বাজার সম্প্রসারণের। অন্যদিকে রাখাইন থেকে গ্যাস পাইপলাইন যাবে চীনের ইউনানে। এ ছাড়া স্পেশাল ইকোনমিক জোন এবং ডিপ সি পোর্টেও পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে চীন। সাম্প্রদায়িক সংঘাত, জাতিগত বৈরিতা, ভূমি সমস্যা এবং শ্রমশক্তির একটা বড় অংশ অন্যান্য রাজ্যে চলে যাওয়ায় রাখাইন রাজ্যের উন্নয়নে কখনই চাঙ্গাভাব আসেনি। বিশেষত মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর নানা বিধিনিষেধ রাজ্যের অগ্রযাত্রায় তাদের ভূমিকার পথও সঙ্কুুচিত করেছে। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর রাখাইন রাজ্যে বেসরকারী বিনিয়োগ উৎসাহিত হয়নি স্থানীয়ভিত্তিক জাতিগত বৈরিতা, সহিংসতা ও বিচ্ছিন্নতার জন্য। ফলে কিয়কপিউতে তেল-গ্যাসভিত্তিক বিনেয়োগও তেমন কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেনি। অন্যদিকে কেন্দ্র সরকারের নানা সিদ্ধান্ত রাখাইন ও মুসলিম জনগোষ্ঠীকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবেই ঠেলে দিয়েছে। এই খাতে সঙ্কট উত্তরণের জন্য আনান কমিশনের মোট ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভূমি সমস্যার সমাধান, শ্রমবাজার মূল্যায়ন, নারী শ্রমিকদের মর্যাদা ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী মানবাধিকার সঙ্কট বিশ্লেষণে দেখা যায় : রাখাইন রাজ্যে দৃশ্যত সব সম্প্রদায়ই কোন না কোনভাবে সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার। বিশেষত মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর পরিকল্পিত নিপীড়ন তাদের জীবনকে শুধু দুর্বিষসহই করে তোলেনি বরং তাদের ‘রাষ্ট্রহীন’ এক জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত করেছে। কমিশন বলছে, বিশ্বের রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর ১০ ভাগেরই বাস মিয়ানমারে এবং রাখাইন রাজ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠী হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীকে এমন কিছু নিষেধাজ্ঞার মধ্যে জীবনযাপন করতে হয় যা দৃশ্যত তাদের সকল মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করে। মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার সদস্য অভ্যন্তরীণভাবে ঠিকানাহীনদের ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়কে সব রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। নাগরিকত্ব সমস্যা মানবাধিকার সঙ্কট বিশ্লেষণ করে প্রধানতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে নাগরিকত্বকে। কমিশন বলছে : ৩৫ বছরে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নাগরিকত্বের বিষয়টিকে একটি জটিল জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ২০০৮ সালের সংবিধানকে কমিশন বলছে, আন্তর্জাতিক মানদ-ে অগ্রহণযোগ্য। বস্তুত এই নাগরিকত্ব সমস্যাই রাখাইন রাজ্যে উত্তেজনা ও সহিংসতার মূল কারণ। বর্মা/মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর থকে দশকের পর দশকজুড়ে রাখাইন রাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়কে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ১৯৬২ সালের সেনা অভ্যুত্থানের আগেও রাখাইনের মুসলিম জনগোষ্ঠী অনেক মর্যাদা ও অধিকার নিয়েই বসবাস করতেন। ১৯৭৮ এবং ১৯৯১ সালে সেনা সরকারই ২ লাখেরও বেশি মুসলিমকে ঠেলে দেয় বাংলাদেশে। দেখা যাচ্ছে নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন দিয়ে যেটিও আন্তর্জাতিক মানদ-ে গ্রহণযোগ্য হয়। একে তো এই আইনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে, পাশাপাশি এই আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে ইচ্ছামাফিক, সুবিধামতো। আনান কমিশন সুপারিশ করছে : ১৯৮২ সালের আইনটিকে আবার যাচাই বাছাই করতে হবে। এই যাচাই-বাছাইয়ে ‘নানা ধরনের নাগরিকত্বের’ বিষয়টি বাতিল করতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন বলছে, কাউকে রাষ্ট্রবিহীন রাখা যাবে না। নতুন আইনে যারা স্থায়ীভাবে দেশে অবস্থান করছেন তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে সরকারী নীতির কারণে যে সব নাগরিক তাদের কাগজপত্র হয় সরকারের কাছে জমা দিয়েছেন অথবা হারিয়ে ফেলেছেন তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি যৌক্তিকভাবে বিবেচনা করতে হবে। নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান করতে হবে দ্রুত, স্বচ্ছতার সঙ্গে এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে হবে রাখাইন ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে। নাগরিকত্ব বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে যথাসম্ভব জটিলতা কমিয়ে। কাউকে নাগরিকত্ব না দিলে তার কারণও স্পষ্ট করে বলতে হবে। নাগরিকত্ব না নিয়েও যারা দেশটিতে অবস্থান করবেন তাদের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিকত্ব নিয়ে কোন ধরনের অভিযোগ-আপত্তি দেখা দিলে তা নিষ্পত্তি করতে হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। মানবাধিকার বিষয়ে আরও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ৬টি সুপারিশে। এতে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের স্বাধীভাবে চলাচলের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সংখ্যালঘুদের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে সব পক্ষপাতিত্ব পরিহার করে। ভয়ের রাজ্য রাখাইন নিরাপত্তা সঙ্কট রাখাইন রাজ্যকে দৃশ্যত একটি ভয়ের রাজ্যে পরিণত করেছে। ২০১২ সালের সহিংসতার ঘটনার পর মুসলমানদের যেমন বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তেমনি রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় যে, তারা একদিন মুসলমানদের চাইতে সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতির দ্রুত অবসান না হলে দুই গোষ্ঠীই চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। কমিশন মনে এই নিরাপত্তা সঙ্কট দূর করতে সেনা অভিযানই একমাত্র সমাধান নয়, বরং অতিমাত্রার সেনা অভিযান পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে। মানুষের স্বাভাবিক অধিকার যদি নিশ্চিত করা না যায় তা আরও জটিলতার সৃষ্টি করবে এবং তা উগ্রবাদী শক্তি বৃদ্ধিতেই সহায়তা করবে। পৃথকভাবে চিহ্নিত করা হলেও কমিশন বলছে, এই তিনটি সমস্যাই আন্তঃসম্পর্কযুক্ত। কমিশন জোর দিয়েই বলছে : আর্থিক ও কারিগরি সীমাবদ্ধতা এবং মিয়ানমারের জনগোষ্ঠীর কিছু অংশের বিরোধিতা থাকলেও দেশেটির রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বকে রাখাইন অঞ্চলের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, নিরাপদ ও নিরাপত্তা, সকল জাতি গোষ্ঠীর অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে দৃঢ় হাতেই। এ অঞ্চলে রাখাইন ও মুসলিম জনগোষ্ঠী একত্রে বাস করবে এ কথা বলাই যথেষ্ট নয়, বরং বিচ্ছিন্নতা নয়, অন্তর্ভুক্তির দর্শন নিয়ে তারা কিভাবে পরস্পর মিলিত জীবনযাপন করবে নিশ্চিত করতে হবে সে বিষয়টিই। আনান কমিশন রাখাইন রাজ্যে ঠিকানাবিহীন মানুষের ঠিকানা নিশ্চিত করা, মানবিক সাহায্যের পথ প্রশস্ত করা, গণমাধ্যমের প্রবেশ অবাধ করা, রাখাইনবাসীদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাদক নিয়ন্ত্রণ, সম্প্রদায়ভিত্তিক প্রতিনিধিত্বমূলক অংশাদারিত্ব নিশ্চিত করা, আন্তঃসম্প্রদায় সম্প্রীতি স্থাপন, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার করা, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য সুনর্দিষ্ট সুপারিশ করেছে। আনান কমিশনের রিপোর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি হচ্ছে : বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত ইস্যু এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে। কমিশন বলছে রাখাইন রাজ্যের সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আন্তরিক উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই। মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য যৌথ সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার ওপরও জোর দিয়েছে কমিশন। আনান কমিশনের ৭৮ নম্বর সুপারিশে খুব স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে : কমিশনের অন্তর্বর্তী সুপারিশের অনুসরণে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ কমিশন করার যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে তাকে কমিশন স্বাগত জানায়। ৭৯ নম্বর সুপারিশে বলা হয়েছে : আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার শরণার্থী প্রত্যাবাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করবে। ৮০ নম্বর সুপারিশে বলা হচ্ছে : প্রত্যাবাসনের পর সকল শরণার্থীকে নিরাপত্তা দেয়ার পাশাপাশি যাদের ঘরবাড়ী ধ্বংস হয়েছে তাদের বসতভিটা গড়ে তোলার দায়িত্বও নেবে মিয়ানমার সরকার। ৮১ নম্বর সুপারিশে জোর দেয়া হয়েছে যৌথভাবে সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ওপর, সবাই স্মরণ করতে পারেন এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবও রয়েছে টেবিলে। কমিশন মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাড়ানোর সুপারিশও করেছে। রোহিঙ্গা সমস্যার আপাত সমাধান সূত্র আনান কমিশনের রিপোর্ট এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মিয়ানমার তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে নজর দেবে তাতেও কারও কোন আপত্তি থাকার কথা নয়, কিন্তু কিছু দুর্বৃত্তকে দমনের জন্য একটি জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করা হবে এটি আইন, মানবিকতা এবং আন্তর্জাতিক বিধি কখনই সমর্থন করে না। লাখ লাখ অসহায় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে উদার মানবিক বাংলাদেশকে গোটা বিশ্ব যেভাবে প্রশংসা করেছে, সেই আন্তর্জাতিক সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে কোফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমস্যার মূলোৎপাটনের যাত্রা শুরু করার জন্য। বাংলাদেশ তার কাজটুকু করেছে এবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব তাদের কাজ করার। লেখক : সাংবাদিক প্রধান সম্পাদক- একুশে টেলিভিশন
×