ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদ সম্পর্কে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধান বিচারপতির অসাংবিধানিক আপত্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ বাতিল দাবি

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল বিষয়ে সংসদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ॥ আইনী পদক্ষেপ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল বিষয়ে সংসদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ॥ আইনী পদক্ষেপ

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা ষোড়শ সংবিধান সংশোধনী বাতিল করে দেয়া প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিতর্কিত পর্যবেক্ষণের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, বিএনপি-জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধীরা যে ভাষায় কথা বলে, প্রধান বিচারপতি তার রায়ে সেই ভাষাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করেছেন। তার এই স্ববিরোধিতাপূর্ণ রায় জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এমন রায় দিয়ে প্রধান বিচারপতি নিজেকেই শুধু বিতর্কিত করেননি, সংসদ, সংবিধান ও গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। এর পেছনের উদ্দেশ্য কী? সুপ্রীমকোর্ট সংসদে প্রণীত কোন আইনের ব্যত্যয় ঘটলে ব্যাখা দিতে পারে, কিন্তু সংবিধান সংশোধন করতে পারে না, সেই অধিকার তাদের নেই। সংবিধান সংশোধনের একমাত্র অধিকার সার্বভৌম জাতীয় সংসদের। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে ষোড়শ সংশোধনী রায় নিয়ে কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ বিধি অনুযায়ী আনীত সাধারণ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, সংসদকে হেয় করা, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা, দেশের স্বাধীনতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার চেষ্টা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতির রায়ে অনেক স্ববিরোধিতা ও সাংঘর্ষিক বিষয় রয়েছে। রায়টি কোথা থেকে কে করে দিয়েছে সেটা দেখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ ছাড়াও সরকার ও বিরোধী দলের ১৮ জন সংসদ সদস্য আনীত এই প্রস্তাবটি সমর্থন করে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদলের আনীত প্রস্তাবটি স্পীকার ভোটে দিলে তা সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুপ্রীমকোর্টের যে রায় দেয়া হয়েছে এটা কারও কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। রায়ের পর বিএনপি খুশি হয়ে মিষ্টি বিতরণ করেছে। এমন হতে পারে এই রায়ে জিয়াউর রহমানের অবৈধ ক্ষমতা দখল বানানো গণতন্ত্র বলা হয়েছে। হয়তো ওটাতে খুশি হয়ে এতদিন আমরা যেটা বলতাম সেটা মেনে নিয়ে মিষ্টি বিতরণ করেছে। তিনি বলেন, গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে হবে। গণতন্ত্র ছাড়া দেশের উন্নতি কখনো হয়নি, হবেও না। তাই গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আনীত প্রস্তাবটি সর্বাত্মক সমর্থন করে বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে, স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত যেভাবে কথা বলে, সেই ভাষারই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে ওই রায়ে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী রায়ে সংসদ সদস্য ও সংরক্ষিত নারী এমপিদের নিয়েও কটাক্ষ করেছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করেন সংসদের সকল সংসদ সদস্যরা। সংরক্ষিত নারী আসনের এমপিরাও এতে ভোট দেন। রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন বিচারপতিদের। এখন উনি (প্রধান বিচারপতি) যদি সংসদ সদস্যেদের নিয়ে এভাবে কথা বলেন তাহলে উনার অবস্থান কোথায় থাকে? প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতি তাঁর রায়ে রাষ্ট্রপতিকে অপমান করেও কথা বলেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। যা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। রায়টার ভেতরে সাংঘর্ষিক বিষয় আছে। উনার বক্তব্যে স্ববিরোধিতা আছে। কোথায় কে করে দিয়েছে তা দেখতে হবে। তিনি বলেন, আমরা সংবিধানের মূল কাঠামোতে যখন ফিরে গেলাম, প্রধান বিচারপতি সেটা মানছেন না। তিনি সামরিক অধ্যাদেশকে সংবিধানের মূল কাঠামো বলছেন, এর উদ্দেশ্য কী? কোন বিষয়ে আপীল হলে সুপ্রীমকোর্ট আপীলের রায় দিতে পারেন, ব্যাখ্যা দিতে পারেন। কিন্তু সংবিধান সংশোধন করে দিতে পারেন না। এ অধিকার সংবিধান সুপ্রীমকোর্টকে দেয়নি। আসলে প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। সংবিধান ও গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। সংসদ নেতা বলেন, রাষ্ট্রের মূল কাঠামোই হচ্ছে নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগ। এই তিনটি স্তম্ভ একে অপরের পরিপূরক ও সমান অধিকার রয়েছে। কেউ কাউকে খাটো করবে না। সংসদে পাস হওয়া কোন আইনে ব্যত্যয় ঘটলে সর্বোচ্চ আদালত এ ব্যাপারে বিশ্লেষণ করতে পারেন, কিন্তু সংবিধান সংশোধন করতে পারে না। রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি শত শত বছর আগের বিষয়গুলো টেনে এনেছেন। জবাবদিহিতা সবার থাকতেই হবে। আমরা প্রতি পাঁচ বছর পর পর জনগণের কাছে গিয়ে কাজের জবাবদিহি করি। সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতি ও অন্য দুই বিচারপতির নেতৃত্বে এই কাউন্সিল হয়। এই এক ব্যক্তি কোন বিচারপতিকে পছন্দ না হলে অপসারণ করতে পারবেন। কে বিচারপতি থাকবেন কি থাকবেন না- তা ওই এক ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। কারো (বিচারপতি) প্রতি এতটুকু বৈরী হলে সেই বিচারপতির চাকরি চলে যাবে। প্রধান বিচারপতি রায়ে আমিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অথচ সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে উনি নিজেই আমিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। অথচ ষোড়শ সংশোধনী অনুযায়ী কোন বিচারপতিকে অপসারণ করতে হলে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের সমর্থন লাগবে। এরপর আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নিতে পারবেন। অথচ এই ব্যবস্থাকেই করা হলো অবৈধ! প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধান অনুযায়ী জনগণই সকল ক্ষমতার মালিক। আর জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আর আপীল বিভাগের এখতিয়ারও সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে। তিনি বলেন, রায়ে বলা হয়েছে সংসদ পরিচালনা হয় নাকি কেবিনেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। বাস্তবে সংসদ পরিচালনার ক্ষেত্রে কেবিনেটের কোন ভূমিকাই নেই। সংসদ পরিচালনা হয় সংসদের কার্যোপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্তে, সংবিধান ও কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী। এমন অনেক কিছুই প্রধান বিচারপতির রায়ে স্ববিরোধিতা ও সাংঘর্ষিক বিষয় রয়েছে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, জনগণের শক্তিই মূল শক্তি, জনগণের এ অধিকার সমুন্নত রাখতে হবে।
×