ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিভিন্ন গ্রামে সেনাবাহিনীর বর্বরতা

জ্বলছে সিটওয়ে, রোহিঙ্গা বসতি ছারখার

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

জ্বলছে সিটওয়ে, রোহিঙ্গা বসতি ছারখার

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের তিনটি টাউনশিপ মংডু, বুচিদং ও রাচিদংয়ের পর এখন বন্দর শহর সিটওয়ে জ্বলছে। মঙ্গলবার থেকে রোহিঙ্গাবিরোধী সেনা অভিযান শুরু হয়েছে সিটওয়েতে। মঙ্গলবার পর্যন্ত সেনা নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের আগুনে ২ হাজার রোহিঙ্গা বসতঘর এবং মসজিদ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর নির্মম এ বর্বরতা চলেছে সিটওয়ের নুরুল্লাহপাড়া, কুঙ্গানা, মাঝেরঢিল, গর্জনদিয়া, বাগঘোনাসহ বিভিন্ন গ্রামে। দক্ষিণ মংডুর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ৫টি রোহিঙ্গা গ্রামেও মঙ্গলবার দুপুরে আগুন দেয়া হয়েছে। দাউ দাউ করে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা বসতপল্লী। এর আগে মঙ্গলবার পর্যন্ত দু’দিনের সময় দিয়ে রোহিঙ্গাদের রাজ্য ছাড়ার জন্য মাইকিং করা হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই সোমবার থেকেই শুরু হয়ে যায় সিটওয়ে অপারেশন। আকিয়াব, রাচিদং, বুচিদং ও মংডুর রোহিঙ্গা পল্লীগুলো এখন একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মঙ্গলবার সকালে সেনা সদস্য ও উগ্রপন্থী রাখাইন সংগঠন নাড়ালার শতাধিক সন্ত্রাসী মংডুর গ্রামগুলোতে হামলে পড়ে। ফলে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশুরা পালাতে থাকে। এ সময় তাদের ওপর চলে নির্বিচারে গুলি। এতে ঠিক কতজন হতাহত হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও এতে ৫০ জনের মতো প্রাণ হারিয়েছে বলে ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে। তাদের দেয়া আগুনে দু’হাজার বাড়িঘর যেমন পুড়েছে, সঙ্গে গৃহপালিত পশুও রক্ষা পায়নি। সৈন্যরা এসব মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার মসজিদেও হানা দিয়েছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত আঠার দিন ধরে রাখাইন রাজ্যে চলমান পরিস্থিতিতে আরও প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশ সীমান্তমুখী। এর আগে অনেকে জিরো পয়েন্টে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তারা আশা করেছিল হয়ত বা ফিরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে তারা এখন অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেছে। ফলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আইওএম, ইউএনএইচসিআর ও বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গাদের এমন ঢল ইতোপূর্বে তারা প্রত্যক্ষ করেনি। দশকের পর দশক জুড়ে রোহিঙ্গারা সেখানে নির্যাতিত ও বর্বর আচরণের শিকার হয়ে আসছে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি সেনা বর্বরতার সকল মাত্রাকে হার মানিয়েছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উগ্রপন্থী রাখাইন সন্ত্রাসীরা। অনুপ্রবেশ অব্যাহত টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। স্রোতের মত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে। পালিয়ে আসা মিয়ানমারের মংডু ধাওনখালীর আব্দুস সালাম জানিয়েছেন, মংডুর দক্ষিণে রাখাইনের নাইক্ষংদিয়া একটি পয়েন্টে এখনও ৮০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা এপারে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন পয়েন্টে অপেক্ষা করছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নর-নারী-শিশু। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিতে মাইকিং সীমান্ত অতিক্রম করে আসা রোহিঙ্গাদের কারও বাড়ি-ঘরে আশ্রয় না দিয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে প্রশাসনের পক্ষে মাইকিং করা হয়েছে মঙ্গলবার। মাইকিংয়ে আশ্রয় দেয়া রোহিঙ্গাদের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠাতে জানানো হয়েছে। ইউপি সদস্য রেজাউল করিম রেজু জানিয়েছেন, পুরো শাহপরীর দ্বীপে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিতে এবং শাহপরীর দ্বীপে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের যারা আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের মঙ্গল-বুধবার ২ দিনের মধ্যে সরকারী নির্ধারিত ক্যাম্পে পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে। অগ্নি সংযোগ অব্যাহত মঙ্গলবারও টেকনাফ সীমান্তের কাছে রাখাইনের বেশ কয়েকটি গ্রামে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। টেকনাফ দমদমিয়া এলাকার বাসিন্দা ছালেহ আহমদ জানান, রাখাইনের পেরামপুরুও রইংগাদংসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। টেকনাফের দমদমিয়া ও কেরুনতলী সীমান্ত এলাকা থেকে মিয়ানমারে জ্বলন্ত আগুনের লেলিহান শিখা ও ধোয়ার কু-ুলি দেখা গেছে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন সিদ্দিক জানিয়েছেন, বালুখালী এলাকায় স্থাপিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জন্য সরকার দুই হাজার একর জমি বরাদ্দ দেয়ার পর তাতে রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজ পুরোদমে চলছে। সীমান্ত দিয়ে আগত রোহিঙ্গাদের সেখানে প্রেরণের কাজও চলছে। গ্রামেগঞ্জে কোথাও যাতে রোহিঙ্গারা বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে না পারে, সে বিষয়ে জনপ্রতিনিধি ও বিজিবি পুলিশ কোস্টগার্ডকে তৎপর রাখা হয়েছে। পরিবেশ ঝুঁকিতে টেকনাফের নেচারাল পার্ক টেকনাফের দমদমিয়া ন্যাচারাল পার্ক ঘেঁষে নতুন করে রোহিঙ্গা বসতি গড়ে উঠেছে। স্থানীয় কিছু বাসিন্দা অর্থের বিনিময়ে ওই পার্কে বসতি স্থাপনে সহায়তা করছে বলে জানা গেছে। ফলে ন্যাচারাল ওই পার্কটি মারাত্মক পরিবেশ ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্ধশতাধিক বসতি গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গারা। উখিয়া টেকনাফ এলাকায় রোহিঙ্গাদের পক্ষে নিজেরা বিক্ষিপ্তভাবে অর্ধশতাধিক বসতি গড়ে তুলেছে। বসবাসকারী সকলে নতুন করে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পরিবার। মংডুর চারকুম্বু এলাকার আয়াতুল্লাহ জানিয়েছেন, প্রতিটি ঘর থেকে ২ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এছাড়া মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাড়াও ধার্য করা হয়েছে। উপায়ান্তর না দেখে তারা এতে বাধ্য হয়েছেন। রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গাশূন্য হতে চলেছে সেনা বর্বরতায় পুরো রাখাইন রাজ্য এখন রোহিঙ্গাশূন্য হতে চলেছে। ইতোমধ্যে চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সেখান থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রিত হয়েছে। বুচিদং, রাচিদং ও মংডুর পর এখন চলছে সিটওয়েতে সেনা অভিযান। ফলে মঙ্গলবার থেকে সে বন্দর শহর থেকেও দলে দলে আসছে রোহিঙ্গারা। এছাড়া নাফ নদী ও সাগরে রোহিঙ্গাদের লাশ আসছে ক্রমাগতভাবে। এসব লাশ সাবরাং থেকে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত উপকূল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভেসে আসছে। আবার বহু লাশ সাগরের জোয়ার ভাটার টানে অন্যত্রও চলে যাচ্ছে। এসব লাশের বড় একটি অংশ সাগরের জীবন জানোয়ারের খাদ্যে পরিণত হয়েছে। এছাড়া উপকূলে ভেসে আসা বহু লাশ শিয়াল কুকুরেও খাচ্ছে। স্থানীয় মাুনষের পক্ষে মানবিক কারণে লাশ দাফনের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ছোট ছোট নৌযানযোগে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর আগমনও থেমে নেই। এদের এমন কোন একজন নেই যে তাদের পরিবারের কেউ না কেউ মিয়ানমার বাহিনীর হাতে প্রায় হারায়নি। যারা বেঁচে আছে তারা মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে বন-জঙ্গল পেরিয়ে সাগর পথকেই বেছে নিয়েছে। নৌকাডুবিতে ইতোমধ্যে বহু রোহিঙ্গার সলীল সমাধি হয়েছে। রাখাইন রাজ্যজুড়ে রোহিঙ্গা নিধন অব্যাহত থাকায় আগামীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কোন সদস্য সেখানে প্রাণ নিয়ে থাকতে পারবে কিনা এখন সে প্রশ্নই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা নিবন্ধনে ১৭ বুথ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে উখিয়া টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ১৭ নিবন্ধন বুথ স্থাপন করা হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একেএম লুৎফুর রহমান জানিয়েছেন, কুতুপালং থেকে বালুখালী পর্যন্ত ১৭ বুথ স্থাপনের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে কুতুপালং ক্যাম্পে একটি ও বালুখালীতে একটি বুথ স্থাপন হয়েছে। ওই বুথগুলোতে প্রতিদিন ৭শ’ করে প্রায় ১২ হাজার রোহিঙ্গাকে নিবন্ধন কাজ চলছে এবং শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। নিবন্ধন প্রকল্পের উপ-পরিচালক লে. লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল আজম জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের ১০ আঙ্গুলে চাপ, ছবি, বাংলাদেশে প্রবেশের সময় ও মিয়ানমারের ঠিকানা নেয়া হবে। তারপর দেয়া হবে পরিচয়পত্র। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ জানিয়েছেন, সব রোহিঙ্গাদের একস্থানে নিয়ে ডাটাবেইজ তৈরির উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। পরিচয়পত্র পাওয়া রোহিঙ্গাদেরই সব ধরনের সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেইসঙ্গে ছড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গাদের এক জায়গায় নিয়ে এসে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে একটি ডাটাবেইজও তৈরি করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বুথ স্থাপন করে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চাকমা পল্লীতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা নিয়ে উত্তেজনা টেকনাফে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের চামকা পল্লীতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
×