ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

এ দেশ তোমার আমার

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭

এ দেশ তোমার আমার

এই বছর সেপ্টেম্বর মাসে দুই দুটি বড় উৎসব। প্রথম সপ্তাহে হয়ে গেল ঈদ-উল-আযহা। তার রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হবে শারদীয় দুর্গাপূজা। ঈদ-উল-আযহা মুসলমানের, দুর্গাপূজা বাঙালী হিন্দুর। হোক ধর্মীয়, তবু ধর্মের সীমানা পেরিয়ে আনন্দের আবহ ছড়িয়ে থাকবে সেপ্টেম্বর মাসজুড়ে সেটাই স্বাভাবিক। যদিও বানভাসিদের সুষ্ঠু পুনর্বাসন এবং রোহিঙ্গাদের বিপন্নতার বিষয় দুটি মন থেকে ঝেরে ফেলা যায় না। কিন্তু বাঙালী মুসলমান এবং হিন্দু উভয়েই দুই বড় উৎসবের আনন্দ থেকে মুখ সরিয়ে রাখবে সেটা কল্পনা করা যায় না। তাছাড়া শত শত বছরের বহমান সংস্কৃতিও বলে না যে, বাঙালী উৎসববিমুখ, আনন্দ রহিত। চরম দারিদ্র্যের মাঝেও একটুখানি সুযোগ পেলেই বাঙালী উৎসবানন্দে মেতে ওঠে। আর এখন তো সেই অর্থে দারিদ্র্য চোখে পড়ে না। অনাহারে মৃত্যুর খবর বিরল। দারিদ্র্যসীমার নিচে যারা তাদের অধিকাংশেরই আছে মাথা গোঁজার ঠাঁই, পরনে কাপড়, পেটে ভাত। সুতরাং দুই দুটি বড় উৎসব ঘিরে এই বছরের সেপ্টেম্বর দেশজুড়ে আনন্দ হয়ত একটু বেশিই হবে। আর আনন্দে মেতে থাকা মানে কুচিন্তা এবং কুকর্ম থেকে দূরে থাকা। উৎসবের আনন্দ একসঙ্গে উপভোগ করলে সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হয়। হোক না তা ধর্মীয় উৎসব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাঙালীর এই চিরায়ত দর্শনে বিশ্বাস রেখে তাই উচ্চারণ করেছেন ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’। শেখ হাসিনার উচ্চারণে বঙ্গবন্ধুর এই সত্যবাণীই প্রসারিত হয়েছে এবং সহজবোধ্য হয়ে পৌঁছেছে সাধারণ মানুষের কাছে। ‘আমি চাই আমার জনগণ হাসুক, আনন্দ করুক, পেট ভরে ভাত খাক’Ñ বঙ্গবন্ধুর এই প্রত্যাশা আজ পূর্ণতা পেয়েছে এটা মানতেই হবে। ধর্মীয় উৎসবগুলোতে অনাবিল আনন্দ-হাসিতে মেতে উঠছে সকলে। ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে আরও এক রঙিন উৎসব। সেটা বাংলা নববর্ষ পালন। প্রতিটি উৎসবেই লাখো মানুষের খুশির জোয়ারে হেসে উঠছে গোটা জাতি। পেট ভরে খাওয়ার পাশাপাশি গায়ে উঠছে নতুন কাপড়, উপহার বিনিময় হচ্ছে। বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে মানুষের ঢল, দেশ হতে দেশান্তরে অনেকেই ছুটছে ভ্রমণের নেশায়। উৎসবগুলোকে ঘিরে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য কি সুখী বাংলাদেশের বার্তা দেয় না? তবু মনের ভেতর কেন জানি কাঁটা খচখচ করে। যখন দেখি চিরায়ত বাঙালীর সংস্কৃতিতে যারা বিশ্বাস করে না, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, তারা সুযোগ পেলেই পিছন থেকে ছুরি মারতে উদ্যত হয় এবং মারেও। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে তারা যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই আঘাত করেছে বাঙালীর অস্তিত্বে। বাংলার ঐতিহ্যিক সংস্কৃতিকে চেয়েছে বিনাশ করতে। যে সংস্কৃতিতে আছে আন্তঃধর্ম সম্প্রীতির বন্ধন, আছে জাতিতে জাতিতে সৌহার্দ্য এবং ভালবাসার ঐক্য, সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠের সহমর্মিতা এবং সভ্য আচরণ- সেই সংস্কৃতি নষ্ট করার পাঁয়তারা শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর থেকেই। ঘাপটিমেরে থাকা পরাজিত অপশক্তি সুযোগ সন্ধানী হয়ে বারবার চেষ্টা করেছে বাঙালীর চিরকালীন ঐক্য বিনষ্ট করতে। সেই পাকিস্তানী আমলের পুরনো স্টাইলের খেলা। যে খেলায় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের স্থানীয় দালালরা বাংলার জনগণের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ছিনিয়ে নিয়ে জনপদের হাজার বছরের স্বতঃস্ফূর্ত গতিধারা রুদ্ধ অথবা বিকৃত করতে চেয়েছিল। বাঙালী জাতীয়তাবাদের অমোঘ শক্তির কাছে যা বারবার ব্যর্থও হয়েছে। জাতপাতের বেড়াকে অস্বীকার করে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অসীম সাহসে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানী অপশক্তির বিরুদ্ধে। নেতা সেখানে শেখ মুজিব। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা। যুদ্ধ জয়ের ভেতর দিয়ে সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সংবিধানের মূল স্তম্ভের একটি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা স্বীকৃতিও পেয়েছিল। পাকিস্তানের জল্লাদখানা থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বারবার তাই বলেছেন মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সকলে যার যার ধর্ম পালন করবে সমান অধিকারে। কেউ কারও ধর্মাচরণে, সংস্কৃতিতে বাধা তো দেবেই না, বরং সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে পাশে দাঁড়াবে। তিনি বলেছেন, ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করতে আর দেয়া হবে না। বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করা চলবে না। তবে তিনি এটাও বলেছিলেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’Ñ জনপদের এই শাশ্বত দর্শনে ছিল তাঁর গভীর বিশ্বাস এবং আস্থা। সুবিধাবাদী সুযোগ সন্ধানীদের কাছে তাই তিনি চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। পঁচাত্তরের হত্যাকা-ের পেছনে এটাও বোধ হয় একটা অন্যতম কারণ। পঁচাত্তরের পর থেকে একুশটা বছর তাই দেখতে পাই পাকিস্তানী শাসকদের প্রেতাত্মার নগ্ন উল্লস্ফন নৃত্য। দেখতে পাই পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের শাসনামলে যা করতে পারেনি তাই করতে। দেখতে পাই এক অদ্ভুতুড়ে ধর্মদর্শনের প্রভাব খাটিয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে। যে ধর্মদর্শনের সঙ্গে বাংলার চিরায়ত দর্শনের কোন মিল নেই। যা সিনথেটিক, আর্টিফিশিয়াল ও ইম্পোর্টেড এবং ক্ষতিকরও বটে। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে তারা যেন ওয়াকওভার পেয়ে গিয়েছিল একুশটা বছর। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূলমন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মুকুট থেকে ছেঁটে ফেলে সর্বত্র বন্দনা হলো সাম্প্রদায়িকতার মেশিন। দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র চালানো হতো এই মেশিন প্রেরিত প্রেসক্রিপশনে এবং সেই প্রেসক্রিপশনের সর্বাঙ্গে থাকত সাম্প্রদায়িকতার উগ্র গন্ধ। সেটাই স্বাভাবিক। সাম্প্রদায়িকতার মেশিন থেকে তো আর সুমিষ্ট শান্তির জল ঝরবে না। ঝরবে বিনষ্টিক বিষ। সেই বিষে বিষাক্ত হলো রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সমাজ। সবচেয়ে মারাত্মক যেটা হলো তা একুশ বছরের এক নতুন প্রজন্ম, যারা জানল না বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। জানল না বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের বিশালত্ব সম্পর্কে কোন কিছু। চিনল না বঙ্গবন্ধুর মতো এক সিংহ হৃদয় বাঙালীকে। পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতার প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে জন্ম নিল কট্টর এক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। ধর্মের মানবিক গুণগুলোকে তছনছ করে তারা হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর উগ্রবাদী। এ এক অনাকাক্সিক্ষত নতুন উপদ্রব যারা ধর্মীয় সম্প্রীতির এই পুণ্যভূমিতে বসাতে চায় তার বিষাক্ত নখের আঁচড়। ধর্মভীরু জনপদের সরল ধর্মবিশ্বাসকে উপজীব্য করে তারা যা করতে চায় তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, চিরায়ত বাঙালী জাতীয়তাবাদের পবিত্র দর্শন পরিপন্থী। আমাদের এই স্বাধীন ভূখ- যে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মিলিত রক্তঘামের ফসল এটা তারা মানতে চায় না। বাঙালীর চিরায়ত মানবিক দর্শনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জঙ্গীবাদী সমাজ এবং রাষ্ট্র তৈরির স্বপ্নে বিভোর এই উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য একের পর এক অপকর্ম করে চলেছে। বারবার ব্যর্থ হয়েও তারা ষড়যন্ত্র থেকে বিরত থাকছে না। তাই উৎসব-আনন্দে শঙ্কা কিছুটা থেকেই যায়। এই বছর দুই ঈদই নির্বিঘেœ কেটে গেছে। কোথাও কোন অঘটন ঘটেনি। আসন্ন দুর্গাপূজার উৎসব-আনন্দে যাতে কোথাও ঘাটতি না হয় সেটাই কাম্য এবং সেই আনন্দ অবশ্যই হিন্দু-মুসলমান মিলিতভাবে ভাগাভাগি করে নেবে। যেভাবে নিয়ে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রকৃত বাঙালী মাত্রই বিশ্বাস করে এদেশটা সকলের। বাংলার হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান সকলেই বাঙালী এবং সকলে মিলে এক জাতি। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি এই জাতিকে আলাদা করতে পারবে না- এই বিশ্বাস চিরদিন অটুট ও দৃঢ় থাকুক। হোক ধর্ম ভিন্ন, উৎসব হোক আলাদা; কিন্তু আনন্দ হোক সকলের। লেখক : নাট্য ব্যক্তিত
×