ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাসুদা ভাট্টি

তবে কি বিএনপি কোন রাজনৈতিক দল নয়?

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২২ আগস্ট ২০১৭

তবে কি বিএনপি কোন রাজনৈতিক দল নয়?

বাংলাদেশকে বিরাজনীতিকরণ একটি নোংরা প্রক্রিয়ার নাম, যা শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। এরপর থেকে রাজনীতি সাধারণ মানুষের হাতছাড়া হয় এবং রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে এদেশে দুটি বড় রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। এই দল দুটি সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এবং ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে থেকেই এদেশে বিস্তার লাভ করে। জেনারেল জিয়া যখন বিএনপি গঠন করেন তখন তিনি ক্যান্টনমেন্টে থাকতেন আর এরশাদ তো সামরিক আইনের মধ্যেই নিজের রাজনৈতিক দলটি গঠন করতে সক্ষম হন। এই দল দুটির রাজনৈতিক শুরুটা দেখুন, বিভিন্ন দল থেকে লোক ভাঙ্গিয়ে এনে প্রথমে একটি আহ্বায়ক কমিটি এবং তারপর তাদের দিয়ে একের পর এক রাজনৈতিক ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়া শেষে জেলা কমিটি এবং সর্বশেষ সাবেক সরকারী কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও সরকারী সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে কালোবাজারি ব্যবসায়ী শ্রেণীর রাঘব বোয়ালদের দ্বারাই এই দল দুটি হৃষ্টপুষ্ট হয়ে আজকের অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। দুঃখজনক হলো, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে সৃষ্ট ও বিস্তার লাভকারী আওয়ামী লীগের মতো একটি মাল্টিক্লাস রাজনৈতিক দলকে এরকম অগণতান্ত্রিক ও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে জন্ম নেয়া রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাজনৈতিক ও গণতন্ত্রের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। বিএনপি কেবল যে অগণতান্ত্রিকভাবে জন্মেছে তা-ই নয়, তার রাজনৈতিক দর্শনটাও রাজনৈতিক নয়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে রাজনীতিকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগে জিয়াউর রহমান কেবল যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদেরই এদেশে রাজনীতির সুযোগ দিয়েছেন তা নয়, তিনি তার নিজের দলকে আরও শক্তিশালী করেছেন। তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, এক সময় বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তিনি মারা গেলে তার পরিবারের কেউ যদি রাজনীতির হাল ধরে তাতেও শেষ রক্ষা হবে না । কারণ বাংলাদেশের মানুষ আসলে এটা স্পষ্টই বোঝে কোন্্টা রাজনীতি আর কোন্্টা অপরাজনীতি। তাছাড়া সব সময় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী তার সৃষ্ট দলের পক্ষে নাও থাকতে পারে। লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, যেবারই প্রশাসন ও সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ থেকেছে সেবারই নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে এবং প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর অসহযোগিতার কারণেই বিএনপিকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে একাধিকবার। জিয়া সে কারণেই বুদ্ধি করে জামায়াতকে বিএনপির বি-টিম হিসেবে তৈরি করে রেখে গিয়েছিলেন এবং তার ফল ২০০১ সালে বিএনপিও হাতেনাতে পেয়েছিল, সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী প্রক্রিয়ায় দেশ শাসন করে গেছে বিএনপি-জামায়াত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েও, যদিও সে নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন তোলার সুযোগ এখনও রয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে আজ যতটুকু বদনাম বা যতটুকুই অশ্রদ্ধা তা শুরু হয়েছিল জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই। কারণ তখনই এদেশের মানুষ দেখেছিল যে, টাকা দিলেই বাঘা বাঘা রাজনৈতিক নেতাকে দলে ভেড়ানো যায়। জিয়াউর রহমান তো বলেই ছিলেন, টাকা কোন সমস্যা নয় এবং তিনি রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করে তুলবেন। এটাই সত্য হতো, এদেশে কোন রাজনীতি আসলে থাকত না, যদি না শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করতেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগসহ ডান-বাম প্রত্যেক দলের বাঘা বাঘা নেতারা তো এদেশে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে ‘ভাঁজ খাওয়া’ রাজনীতিই করেছেন এবং পরবর্তীকালে এরশাদ জমানায় শেখ হাসিনা প্রতিবাদী না হলে এরশাদের গু-াবাহিনী মোকাবেলা করার মতো কোমর ক’জন নেতার ছিল তা একটু পেছন ফিরে তাকালেই স্পষ্ট হয়। কিন্তু বিএনপি বাধ্য হয়েই এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল, যেমনটি বিএনপির তৎকালীন নেতারা বেগম জিয়াকে নেতা হিসেবে মনোনীত করেছিলেন শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন বলেই। সেদিক দিয়ে বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়া ‘বাই ডিফল্ট’ একজন রাজনৈতিক নেতা এবং এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও বিএনপি ‘বাই ডিফল্ট’ গণতন্ত্রের পক্ষে আন্দোলনকারী একটি রাজনৈতিক দল। ওপরের এই কথা এ কারণেই জোর দিয়ে বলা যায় যে, বিএনপি কখনোই গণতন্ত্রকে স্থিতিশীল করার মতো কোন কাজ করেনি। মাগুরা নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৬ জানুয়ারির নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে আমূল প্রশ্নবিদ্ধকরণ, কত উদাহরণ দেব আর? কিন্তু ১/১১ আমলেও যখন রাজনীতিকে প্রধান শত্রুজ্ঞান করে এদেশে নতুন করে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া শুরু হলো তখনও বিএনপির রাজনৈতিক ভূমিকা কোথায়? শেখ হাসিনা ও তার দলের কিছু নেতা যখন প্রাণের মায়া ত্যাগ করে এদেশে রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনার জন্য লড়াই করছেন তখন বিএনপির কোন্্ নেতার কথা আপনি বলতে পারবেন, যিনি সেই বিরাজনীতিকরণের বিপক্ষে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছিলেন? আমি তো একজনের নামও খুঁজে পাইনে। বরং এ কথা আজকে আর একেবারেই গোপন নেই যে, বেগম জিয়া তার পুত্রদ্বয়সহ বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলেন। শেখ হাসিনা দেশ ছাড়বেন না জেনেই তিনিও গো ধরেন এবং ব্যালেন্স করার জন্য বেগম জিয়াকেও জেলে নেয়া হয়। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলের কাছে সেই সময়ের বিরাজনীতিকরণের ভিলেনগণ আবারও পরাজিত হন এবং আবারও ‘বাই ডিফল্ট’ বেগম জিয়া ও তার দল রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করে। কিন্তু বেগম জিয়া ও তার দল যে ১/১১-র বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া থেকে কোন শিক্ষাই নেয়নি তার প্রমাণ আমরা দেখতে পাই আবারও যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে দেশে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এবং বিএনপি-জামায়াত সেই অস্থিরতায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। এমনকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কোন অরাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনা এবং তারাও বিএনপি-জামায়াতকে এ লক্ষ্যেই উস্কে দিয়েছিল বলে প্রমাণ রয়েছে। এরপর থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কোন আন্দোলন করার মতো সক্ষমতা তৈরি হয়েছে বলে আমরা প্রমাণ পাইনি। সরকার হিসেবে আওয়ামী লীগের উল্লেখ করার মতো অনেক ব্যর্থতাই রয়েছে তা বিএনপি সরকার করলে আওয়ামী লীগ এতদিনে গণআন্দোলনের মাধ্যমে তার পতন ঘটিয়ে ছাড়ত। কিন্তু বিএনপি নেতাদের বেশিরভাগই তাদের ব্যবসা সামলে এবং রাজনীতি অনভিজ্ঞতার কারণে জনগণের সামনে কোন ধরনের প্রোগ্রামই হাজির করতে পারেনি, যাতে জনগণও একাত্ম বোধ করে। বরং জনগণ কিছু কারণে আওয়ামী লীগের ওপর বিরক্ত হলেও আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বিএনপিকে কোনভাবেই যে মনে করে না তার প্রমাণ হিসেবে বহু জরিপের কথাই উল্লেখ করা যায়। এদেশের মূল বাস্তবতাও তাই, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিকল্প বিএনপি নয়, এখনও হয়ে উঠতে পারেনি। তাহলে বিএনপি কী করে ক্ষমতায় আসে? ওই যে আগেই বলেছি, প্রশাসন ও সেনাবাহিনী চাইলেই কেবল বিএনপি ক্ষমতায় আসে, না হলে পারে না। আর সেইসঙ্গে যদি বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার কৌটিল্যদের যোগসাজশ ঘটে তাহলে তো কথাই নেই। এই যেমন এখন ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণার রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে যে রাজনীতি শুরু হয়েছে তা মূলত এদেশের রাজনীতিকে আবারও দূরে সরানোর প্রক্রিয়া বৈ অন্য কিছু নয়। পুরো রায়টিই রাজনৈতিক এবং এদেশের যে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন জিয়াউর রহমান রাজনীতিবিদ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও সংসদ সদস্যদের চরিত্র হননের মধ্য দিয়ে, ১/১১-র আমলেও যেভাবে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের আক্রমণ করা হয়েছে ঠিক সেসব কথাই এই রায়ে পর্যবেক্ষণ হিসেবে উঠে এসেছে। অথচ এদেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের যে ঐতিহাসিক ও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও জাতীয় উন্নয়নে সে কথা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে ঢালাওভাবে এই রায়ে কেবল রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের নিন্দা করা হয়েছে। অত্যন্ত মিহি সুরে একটুখানি স্বৈরশাসনের নিন্দা করলেও তার চেয়ে অনেক বেশি কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে গণতান্ত্রিক রাজনীতির। কিন্তু এই কথা কোথাও বলা নেই যে, রাজনীতির যতটুকুই দুরবস্থা তার সবটাই জিয়া-এরশাদের অবদান এবং আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দল সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালেও জিয়া-এরশাদের কু-রাজনীতি, দুর্নীতি ও অগণতান্ত্রিক অব্যবস্থামুক্ত করতে পারবে না খুব সহজে, এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ সময়। কিন্তু সেই সময়টুকু এই দলটিকে যে দেয়া যাবে না সেটাই এই রায়ের পেছনে নিগূঢ় উদ্দেশ্য। আবারও দেশকে বিরাজনীকিরণের সুর শোনা যাচ্ছে সর্বত্র, এই রায়ের ওপর ভিত্তি করেই হোক আর এই সুরের সুরকার হিসেবেই হোক কিংবা সুর শুনে শুনেই হোক, জেনেশুনেই বিএনপি এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সর্পনৃত্য করে যাচ্ছে। প্রকৃত রাজনৈতিক দল হলে, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে আজকে এই রায়ের বিপরীতে তাদেরও কঠোর বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল। কারণ এই রায়ের বক্তব্য আসলে এদেশে রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য চরম অপমানজনক, যেখানে জিয়াউর রহমানের নামও রয়েছে। বিএনপি জিয়াউর রহমানকেও যে রাজনীতিবিদ মনে করে না তার প্রমাণ আবারও পাওয়া যাচ্ছে। কারণ এই রায়কে তারা মনে করছে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি। কিন্তু গরু হারিয়ে গোপাল ভাঁড়ের তার নিজের স্ত্রীকে ‘মা’ আর ছেলেকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করার মতো বিএনপিও তার রাজনৈতিক গরুটি হারিয়ে ফেলেছে তার প্রমাণ দিচ্ছে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণের পক্ষে দাঁড়িয়ে। কোন রাজনৈতিক দলের যদি রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটে তখন তার কবরটিও তারা নিজের হাতেই খোঁড়ে। বিএনপি এখন সেই কাজটিই করছে সর্বতোভাবে। লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি ঢাকা ॥ ১৯ আগস্ট, শনিবার ॥ ২০১৭ ॥ [email protected]
×