ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অর্থ পাচার প্রতিরোধে শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চার নম্বরে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২২ আগস্ট ২০১৭

অর্থ পাচার প্রতিরোধে শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চার নম্বরে

রহিম শেখ ॥ অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে অভূতপূর্ব উন্নতি করছে বাংলাদেশ। এই প্রতিরোধ বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪ নম্বরে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্যাসেল গবর্নেন্সের এন্টি মানিলন্ডারিং ইনডেক্সে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, যা সোমবার প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, জঙ্গী অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশের নেয়া পদক্ষেপ বিশ্বমানের। এর আগে বাংলাদেশের মানিলন্ডারিং সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ কার্যক্রমকে আন্তর্জাতিকমানের স্বীকৃতি দিয়েছে এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানিলন্ডারিং (এপিজি)। ওই অর্জনের ফলে কালো তালিকা থেকে মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্যাসেল গবর্নেন্সের এন্টি মানি লন্ডারিং যে ইনডেক্স প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে ২০১৭ সালে সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নকারী ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪ নম্বরে। বাকি নয়টি দেশ হলো সুদান, তাইওয়ান, ইসরাইল, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, লুক্সেমবার্গ, লাটভিয়া ও গ্রিস। ওই সূচকে দেখা যায়, বাংলাদেশ ২৮টি দেশকে পিছনে ফেলে র‌্যাংকিং এর ৫৪ নম্বর ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হতে ৮২ নম্বরে জায়গা করে নিয়েছে। ওই সূচকে এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে রয়েছে ইরান, আফগানিস্তান এবং সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হলো ফিনল্যান্ড। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তানের অবস্থান মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন ঝুঁকির নিরিখে ২ নম্বরে; এছাড়াও মিয়ানমার ১৩, নেপাল ১৪, শ্রীলঙ্কা ২৫, পাকিস্তান ৪৬ এবং ভারত ৮৮ নম্বরে রয়েছে। তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যথাক্রমে ১১৬ ও ১১৮ নম্বরে রয়েছে। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক সংস্থাটি গত ছয় বছরের একটি দেশের মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ঘাটতি; ছতার ঘাটতি, উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতির ধারণা সূচক, আর্থিক মানদ- ও স্বচ্ছতা এবং দুর্বল রাজনৈতিক অধিকার ও আইনের শাসন; এই পাঁচটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ইনডেক্স প্রকাশ করেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে অভূতপূর্ব উন্নতি করছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, এই অর্জন আমাদের সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে কার্যক্রম আরও জোরালো করবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গীকার, আন্তঃসংস্থার কাজের সমন্বয়, আর্থিক খাতে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকারের পর্যাপ্ত লোকবল ও অর্থের সংস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি আরও বলেন, আর্থিক খাত ব্যবহার করে কোন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান যাতে সন্ত্রাসে অর্থায়ন করতে না পারে সেজন্য একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে কোন হিসাব পাওয়া গেলে দ্রুতই তা স্থগিত করবে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানিলন্ডারিং, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে এপিজি ও এর সদস্য ৪১টি রাষ্ট্র থেকে আন্তর্জাতিক মানের হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বাংলাদেশকে। আগের রেটিং অনুযায়ী বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন রিভিউ গ্রুপভুক্ত (আইসিআরজি) হওয়ার যে আশঙ্কা ছিল, তা আর নেই। এপিজির মিউচ্যুয়াল ইভালুয়্যাশন রিপোর্ট মোতাবেক বাংলাদেশ এফএটিএফের ৪০টি সুপারিশের বিপরীতে ৬টিতে কমপ্লায়েন্ট, ২২টিতে অধিকাংশ কমপ্লায়েন্ট এবং ১২টিতে আংশিক কমপ্লায়েন্ট রেটিং পেয়েছে। বাংলাদেশ এফএটিএফের ৪০টি সুপারিশের সবকটিই বাস্তবায়ন করেছে। এছাড়া আইনী ও প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর কার্যকারিতার ১১টি বিষয়ের তিনটিতে সাবস্টেনশিয়াল, চারটিতে মডারেট, চারটিতে লো লেভেল রেটিং অর্জন করেছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রেটিং নরওয়ে, শ্রীলঙ্কা, ফিজি থেকে ভাল। সন্ত্রাস, সন্ত্রাসে অর্থায়ন, জঙ্গীবাদ, মানিলন্ডারিংসহ অন্যান্য অপরাধ নির্মূলে বাংলাদেশের অবস্থান আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। ফলে সন্ত্রাস, সন্ত্রাসে অর্থায়ন, জঙ্গীবাদ, মুদ্রা পাচারসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া পদক্ষেপ এ্যাসেসমেন্ট টিম কর্তৃক প্রস্তাবিত রেটিংগুলোর মধ্যে দুটি ইমিডিয়েট আউটকামের (আইও) রেটিংয়ে উন্নত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় নাম থাকলে এলসি খোলাসহ নানা ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। বিনিয়োগ আনাও কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বিভিন্ন যোগাযোগের ক্ষেত্রে নানামুখী সমস্যা হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন পক্ষের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ এখন জঙ্গী, সন্ত্রাস ও অর্থপাচার রোধে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করছে। প্রসঙ্গত, ২০০২ সালে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বাংলাদেশের ওপর প্রথমবারের মতো এ ধরনের মূল্যায়ন প্রতিবেদন দেয়। ওই সময়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নন-কমপ্লায়েন্ট ছিল। পরে ২০০৮ সালে দ্বিতীয় ধাপের মূল্যায়ন প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের ফল ভাল না হওয়ায় ২০১০ সালে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনাল গ্রুপের সঙ্গে আলোচনা করে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এ কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী পরবর্তী তিন বছরে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও অপরাধ-সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তা আইনসহ বিভিন্ন বিধিবিধান ও প্রজ্ঞাপন প্রণয়ন করে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন সংস্কার করে, যার ফলে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ আইসিআরজি প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
×