ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেশিরভাগই জামায়াত বিএনপি নেতাকর্মী

রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে বিদেশে দেশের ইমেজ ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২২ আগস্ট ২০১৭

রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে বিদেশে দেশের ইমেজ ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে

ফিরোজ মান্না ॥ নিপীড়ন, নির্যাতন আর হয়রানিমূলক মামলার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশীদের ইউরোপ-আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রতিবেদন অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের প্রায় দেড় লাখ মানুষ ইউরোপ-আমেরিকার অন্তত ৩০ দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে জামায়াত ও বিএনপির নেতাকর্মীর সংখ্যাই বেশি। আবার অনেকে ভাগ্যবদলের আশায় বিদেশে গিয়ে স্থায়ী বসবাসের জন্যও রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ সেন্টারেরও’ সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশীদের স্থান ইরাক, সিরিয়া, পাকিস্তান ও সোমালিয়ার পরেই। দুটি সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা মানবিক যুক্তি দেখিয়ে ‘পলিটিক্যাল এ্যাসাইলাম’ চাচ্ছেন। ইরাক, সিরিয়া ও সোমালিয়ার সংঘাত ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ দেখিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করছে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশীদের রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী দিন দিন বেড়েই চলেছে। রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা তাদের আবেদনে উল্লেখ করছে, দেশে তাদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা, নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে তারা দেশে নিরাপত্তাহীন। তারা দেশে ফিরলে জীবন হুমকির মধ্যে পড়বে। জীবনের নিরাপত্তার জন্য তাদের আশ্রয় দেয়া হোক। গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন এক লাখ ৩৭ হাজার বাংলাদেশী। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ২০১৬ সালে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন ২৮ হাজার ৩৯৫ বাংলাদেশী। সূত্র জানায়, রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে গিয়ে দেশে অনেকেই পুলিশকে ম্যানেজ করে মিথ্যা মামলা দায়ের করান। পরে ওই মামলার সূত্র দিয়ে অখ্যাত পত্রিকায় নিজের নামে নিউজ প্রকাশ করে। ওই সব মামলার নথি ও পত্রিকা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে নিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করার অভিযোগ রয়েছে। এত বিপুলসংখ্যক মানুষ রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি বিদেশীদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে তারা ভয়াবহ বলে মনে করছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, জামায়াত-বিএনপির একটি অংশ দেশে তাদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করছে। তারা দেশের বিরুদ্ধে বিদেশের কোর্টে চরম বিদ্বেষ প্রকাশ করছে। বিদেশীরাও বিষয়টি বিশ্বাস করে জামায়াত-বিএনপির অনেক নেতাকর্মীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিচ্ছে। সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করার দেশ ইংল্যান্ড ও ইতালি। এ দুটি দেশে বিএনপি-জামায়াতের হাজার হাজার নেতাকর্মী রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রার্থনা করেছে। তাদের অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ও পেয়েছে। এদের পাশাপাশি কিছু সাধারণ নাগরিক জীবন-জীবিকার জন্যও রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে। এদের সংখ্যাও কম নয়। দালাল চক্রের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গেছে তারা। কিন্তু ওসব দেশে কাজের অনুমতি না পাওয়ায় তারা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করছে। যতদিন কোর্টে বিষয়টি নিষ্পত্তি না হচ্ছে ততদিন তারা কাজের সুযোগ পাচ্ছে। পুলিশ তাদের দেশ থেকে বেরও করে দিতে পারছে না। এভাবে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের সংখ্যা রাড়ছে। রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকলে পুলিশী ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া যায়। মানবিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ফ্রান্সে ৩২ হাজার ৭শ’ বাংলাদেশী রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। বাংলাদেশীদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বেশি জমা পড়েছে ইতালিতে। ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত পাঁচ বছরে দক্ষিণ আফ্রিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে ২৬ হাজারের বেশি বাংলাদেশী। জানা গেছে, ২০১৪ সালে যেসব বাংলাদেশী ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন তাদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা বেড়ে ১৮ হাজারে দাঁড়ায়। অথচ ২০১৩ সালে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৭ হাজার বাংলাদেশী। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপে যেসব নাগরিক রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করছেন তাদের মধ্যে বাংলাদেশীদের স্থান ১৪তম। প্রতিবেদনে ৩০ দেশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আশ্রয় প্রার্থনাকারীরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮ দেশ বেছে নিয়েছে। এর বাইরে রয়েছে নরওয়ে ও সুইডেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের ৭৩ শতাংশই হলো তরুণ। এদের বয়স ১৮ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। মানব পাচার নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি সংস্থা জানিয়েছে, বেকার সমস্যা একটি বড় কারণ। তরুণরা কিছু করার জন্য যে কোন উপায়ে হোক (দালাল চক্র) বিদেশে পাড়ি দিতে চায়। তাদের ধারণা, উন্নত দেশে গিয়ে ভাল বেতন পাবে। নিজের পরিবারকে সুখী করার জন্য তরুণরা নানা কৌশলে বিদেশে যায়। বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায়। পথে নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে যখন কোন দেশে পৌঁছে তখন তার আর ভাল চাকরি পাওয়া হয় না। আবার দেশেও ফিরে আসতে পারে না। পরিবারের লাখ লাখ টাকা নিয়ে বিদেশে গিয়ে দেশে ফিরে এলে পরিবারসহ পথে বসে যায়। এ কারণে যে কোন উপায়ে ওই দেশে থাকার চেষ্টা করে। অনেকের ভাগ্য ভাল থাকলে থেকে যেতে পারে, আবার অনেককে দেশে ফিরে আসতে হয়। কাউকে আবার কারাগারে বন্দী হিসেবে বছরের পর বছর পার করে দিতে হচ্ছে। তবে যারা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী তাদের হিসাব আলাদা। তারা রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বসবাস ও কাজের সুযোগ তৈরি করে নেয়। যখন ওই সব নেতাকর্মীর দল ক্ষমতায় আসে তখন তারা দেশে চলে আসে। তবে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা যত বাড়বে তত দেশের বদনাম হবে। বিদেশীদের কাছে দেশের ইমেজ সঙ্কট হবে। অনেক দেশ জানে না যে, দেশের অবস্থা আসলে কতটা খারাপ বা ভাল। তারা হিসাব করে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার ওপর।
×