ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

কৃত্রিম নয়, স্বাভাবিক খাবার দিয়েই মোটাতাজা করা হচ্ছে গরু

কোরবানির হাটগুলোতে দাম হাঁকা হচ্ছে আকাশচুম্বী

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২২ আগস্ট ২০১৭

কোরবানির হাটগুলোতে দাম হাঁকা হচ্ছে আকাশচুম্বী

সমুদ্র হক ॥ বিরাট গরু ও বিরাট ছাগলের হাটের আয়োজন নেই। তবে গরু- ছাগলের বিরাট হাটের আয়োজন এখন পাকা। হাট বন্দোবস্ত নেয়া শুরু হয়েছে অনেক আগেই। এই হাটকেই মাইকের প্রচারে বলা হয় ‘বিরাট গরু ছাগলের হাট। গরুর ব্যাপারীদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত আছে।’ কোরবানির ঈদ ঘিরে চারদিকে হাঁকডাক। হাতে সময় কয়েকটা দিন। সকলেরই প্রশ্ন এবার গরুর দাম কি কম হবে! এমন কথা বন্যার কারণেই। ধারণা, এবার কোরবানির হাটে পশুর দাম কম হবে। হাট ও মাঠের চিত্র বলে ভিন্ন কথা। প্রাথমিক হাটগুলোতে দাম হাঁকা হচ্ছে আকাশচুম্বী। এমন দাম শেষ পর্যন্ত আর থাকে না। অনেক নিচে নেমে আসে। বগুড়ার অন্যতম একটি বড় হাট মহাস্থান। গরুর ব্যাপারী আজিজুর রহমান পান চিবিয়ে দাঁতে খিলাল করতে করতে মৃদু হেসে বললেন ‘দাম বেশি না হাঁকাইলে হাটের সুনাম থাহে না। রিপোর্টার ভাইয়েরা এই দাম শুইন্যা গলায় জড়ির মালাওয়ালা মোটাতাজা গরুর ফডো তুইল্যা প্যাপারত লেইখ্যা দেন। হাটের ইজারাদার ভাই তাই দেইখ্যা নাইচা ওডে।’ তার কথা শুনে বোঝা গেল তিনি বগুড়া অঞ্চলের নন। পূর্বাঞ্চলের গরুর ব্যাপারী। কোরবানির ঈদের সময় এমন ব্যাপারী দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাকে করে গরু নিয়ে ব্যবসা করেন। তারা রমজানের ঈদের পরই দেশের প্রায় প্রতিটি এলাকায় গিয়ে খোঁজখবর করে কম দামে গরু কিনে কিছুদিনের জন্য গৃহস্থ ও কৃষকের বাড়িতে রেখে আসেন। এ জন্য বড় অঙ্কের অর্থ পান গৃহস্থ ও কৃষক। বাড়তি লাভবান হন। তারা আগ্রহ ভরে গরু পালন করেন। ঈদের কিছুদিন আগে ব্যাপারীরা এই গরু সংগ্রহ করে বিভিন্ন হাটে নিয়ে যান। ঢাকার গাবতলীতে যান ঈদের দিন কয়েক আগে। ব্যাপারীদের মতো এমন ব্যবস্থা ও পরিকল্পনা শহর ও নগরীর অনেকেই করেন। কোরবানি ঈদের অনেকটা আগে তারা গ্রামে গিয়ে গরু কিনে গরু লালন-পালনকারীদের আঙ্গিনায় রেখে আসেন। ঈদের দু-একদিন আগে শহর ও নগরীতে নিজেদের বাড়িতে আনেন। হালে প্রায় প্রতিটি এলাকার গ্রামে গরু মোটতাজাকরণের খামার ও মিনি ডেইরি ফার্ম গড়ে উঠেছে। অনেক গৃহস্থ কৃষক স্বল্প পরিসরে নিজেদের গোয়ালঘরে ৫-৭টি করে গরু পালন করেন। কারও গোয়ালে সঙ্গে ছাগলও থাকে। গরু মোটাতাজাকরণ করার পর তাদের লক্ষ্য থাকে কোরবানির ঈদ। অবার অনেকে গাভী লালন-পালন করে সারা বছর দুধের ব্যবসা করেন। গত কয়েক বছরে বগুড়ার প্রতিটি উপজেলায় গরু মোটাতাজাকরণের খামার গড়ে উঠেছে। বগুড়া প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের এক হিসাব বলছে, এই সংখ্যা ১৭ হাজার ৪৯০টি। যেখানে গড়ে প্রতি খামারে গড়ে ১০টি করে মোট প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার গরু পালন করা হচ্ছে। কোথাও দেশীয় গরুর পাশাপাশি বিদেশী গরু আছে। বগুড়ায় সবচেয়ে বেশি খামার আছে সদর উপজেলায় ২ হাজার ৩০০টি। যেখানে গরু মোটাতাজাকরণ করা হচ্ছে। ২০ হাজার ৫০০টি। সাবগ্রামের একটি খামারে দেশী গরুর পাশাপাশি বিদেশী ব্রাহাম, শিবাবি, নেপালী ও দেশাল জাতের গরু পালন করা হচ্ছে। এসব গরুর ওজনও বেশি। গরু পালনকারী খামারগুলোতে এবার যে বিষয়টি প্রশংসিত হয়েছে বেশিরভাগ গরুকে কোন স্টেরয়েড বটিকা সেবন ইনজেকশন করা হচ্ছে না। তাদের কথা, এই ধরনের বটিকা খাওয়ানোর পর গরু কৃত্রিমভাবে দ্রুত মোটাতাজা হয়ে ওঠে ঠিকই তবে গরুর কিডনি কলিজায় পচন ধরে। দ্রুত হাটে না পৌঁছলে মারাও যায়। গত বছরগুলোতে এ ধরনের অনেক গরু মারা যাওয়ায় অনেক খামারি ও ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গরু খামারি মোরশেদুল বললেন, তিনি গরুকে সব সময়ই স্বাভাবিক খাবার যেমন নেপিয়ার ঘাস, খড়, ভুসি, খৈল, ভাত মাটির চারির ভেতরে গুলিয়ে খাওয়ান। এভাবেই গরু মোটাতাজা হয়েছে। সময়মতো পশু চিকিৎসকের সহায়তা নেন। একজন পশুপালন কর্মকর্তা বললেন, দেশে অনেক উন্নতমানের পাবনা ব্রিড, অস্ট্রেলিয়ান ফ্রিজিয়ান ব্রিড, হরিয়ানা ব্রিড, লোকাল ব্রিড এমনিতেই মোটাতাজা থাকে। এসব গরুকে স্বাভাবিক খাবার দিয়ে শুধু যতœ নিলেই গরু ভাল থাকে। গাবতলী এলাকার খামারি আশরাফুল বললেন, তিনি প্রতিটি ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা দরে ১০টি গরু কিনে পালন করেছেন। আশা করছেন, দ্বিগুণ দামে বিক্রি করতে পারবেন। তবে এই বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করলেন সোনাতলার হরিখালি এলাকার গৃহস্থ মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বললেন, গরুর ব্যাপারীরা বন্যাক্রান্ত এলাকায় গিয়ে কম দামে গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক বানভাসিরা গরু, ছাগল রাখতে পারছেন না। কম দামেই বেচে দিচ্ছেন। তবে হাটবাজারে এখনও গরুর দামে কোন প্রভাব পড়েনি। খামারিদের কয়েকজন বললেন, গরুর দাম না পেলে তারা বিক্রি করবেন না। তারা কোরবানি ঈদের দিকে লক্ষ্য রেখেই গরু পালন করেন। বগুড়া সদরের খামারি রফিকুল ইসলাম দশ বছর ধরে গরু পালন করছেন। গরু পালন করেই তিনি বাড়িঘর পাকা করেছেন। জমিজিরাত করেছেন। গত কোরবানি ঈদের সময় দশটি গরু বিক্রি করে তার লাভ হয়েছিল অন্তত আড়াই লাখ টাকা। এবারও দশটি গরু তিনি বিক্রি করবেন। মাঠ পর্যায়ের চিত্র বলে দিচ্ছে, এবারের কোরবানির ঈদে গরুর দামে তেমন হেরফের হবে না।
×