ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মহিউদ্দিন মঞ্জুর নাছিরের আমলে জলজট নিরসনে মোট ব্যয় ৩২৩ কোটি টাকা

মেগা প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ের ওপরই নির্ভর করছে চট্টগ্রামের উন্নয়ন

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২০ আগস্ট ২০১৭

মেগা প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ের ওপরই নির্ভর করছে চট্টগ্রামের উন্নয়ন

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ প্রতি বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রাম মহানগরীর জলজট পরিস্থিতির শুধুই অবনতি ঘটছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে একদিকে যেমন হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে, অপরদিকে ক্ষোভের মনোভাব অবর্ণনীয়। কেননা, চলতি মৌসুমে জলজটে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এই ক্ষতি ও দুর্ভোগের বিপরীতে ক্ষোভের তীর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) কর্তৃপক্ষের প্রতি। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবেলায় কোন সফলতা দেখাতে পারেনি চসিক। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মহিউদ্দিন চৌধুরী টানা সতেরো বছর মেয়র থাকাকালে জলজট নিরসনে ব্যয় করেছেন ৬৬ কোটি টাকা, এম মঞ্জুর আলম পাঁচ বছরে করেছেন ২০৫ কোটি টাকা আর বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন নির্বাচিত হওয়ার পর গত দুই বছরে খরচ করেছেন ৫২কোটি টাকা। সব মিলিয়ে জলজট নিরসনে সরকারী অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ ৩২৩ কোটি টাকারও বেশি। এত বিপুল অর্থ ব্যয় যেসব স্থানে করা হয়েছে এবার সেসব স্থান আরও বেশি জলজটে তলিয়ে গেছে। পাশাপাশি নতুন নতুন এলাকাও পানিতে একাকার হয়ে গেছে। এ দুঃসহ পরিস্থিতি অনুধাবন করে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কর্ণফুলী নদীর একাংশের ড্রেজিং ও মহানগরীর খাল, উপখাল সংস্কার, খনন ও উন্নয়নের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) ওপর। খাল সংস্কার, খনন ও উন্নয়নের প্রকল্প সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকেও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু একনেকে অনুমোদন হয়েছে চউক প্রদত্ত প্রকল্প। একনেকে এসব প্রকল্প অনুমোদনের পর চউকের পক্ষ থেকে চসিকের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে। চসিকের পক্ষ থেকেও এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের এ দুর্যোগ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে বিপুল পরিমাণ অর্থ অনুমোদনের পর জনমনে স্বস্তি এসেছে ঠিকই। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে এই দুই সেবামূলক সংস্থার কর্ণধারদের সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকবে কি-না তা নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। চসিক মেয়র ও চউক চেয়ারম্যান দু’জনই মহানগর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। কিন্তু নেপথ্যে তাদের মধ্যে যে গ্রুপিং রয়েছে তা কারও অজানা নয়। ফলে আগামীতে জলজট নিরসনে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের বিপরীতে সফলতা আসার বিষয়টি সন্দেহের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে দুই সংস্থার কর্ণধারদের মধ্যে এখনও কোন বিপরীতমুখী বক্তব্য আসেনি। তবে একথা ঠিক যে, এক সংস্থার কাজ অন্য সংস্থার ওপর অর্পিত হওয়ার বিষয়টি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরে বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চউক মহানগরীতে কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছে এবং এখনও করছে। এসব ফ্লাইওভার নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদদের মাঝে আলোচনা সমালোচনার কমতি নেই। এরপরও এ সংস্থাটি তাদের কর্মে অটল অবস্থানে রয়েছে। এ অবস্থায় সংস্থাটির জন্য খাল পুনঃখনন, সংস্কার ও উন্নয়ন কাজে ৫ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা অনুমোদন দেয়া হয়েছে একনেকের সভায়। চউক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রদান ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্যে বলেছেন, চট্টগ্রামের উন্নয়নে ইতোপূর্বেও বর্তমান সরকার ১৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। যার কয়েকটি ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং কিছু বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। বর্তমানে চলমান রয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকার ‘চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড’ প্রকল্প, ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, ২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চাক্তাই খাল থেকে কালুরঘাট ব্রিজ পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর তীরে বাঁধ-রাস্তা নির্মাণ, মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত ৭শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার’ নির্মাণ, ২০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা রোড থেকে বাকলিয়া থানা এলাকা পর্যন্ত ‘বাকলিয়া এক্সেস রোড নির্মাণ প্রকল্প, ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে অন্যান্য আবাসিক এলাকায় দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্প এবং ফৌজদারহাট থেকে বায়েজিদ বোস্তামী পর্যন্ত নগরীর প্রথম বাইপাস সড়ক নির্মাণ। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২০ কোটি টাকা। প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম মহানগর অভ্যন্তরে ৪২টি খালের কথা বলা হয়ে থাকে। প্রধান প্রধান খালের সংখ্যা মূলত ২৬টি। অপরাপর খালের সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে উপখাল। এসব খাল-উপখালের মোট দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১৪৪ কিলোমিটার। এসব খালের অন্যতম হচ্ছে চাক্তাই খাল, মহেষখাল, রাজাখাল, হিজড়া খাল, চশমা খাল, মির্জা খাল, চট্টেশ্বরী খাল, সাব এরিয়া খাল, তুলাতলি খাল, ডাইভারশন খাল, ডোম খাল, নালী খাল, মরিয়ম খাল, বদর খাল, বালাম বোর্ড খাল ইত্যাদি। পরিকল্পনাবিদদের হিসাব অনুযায়ী ৪২টি খালের মধ্যে ৩৬টিই বর্তমানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এসব খালের গভীরতা একেবারেই নেই। পাশাপাশি দু’পাশ অবৈধ দখলে চলে গেছে। অপরদিকে, পাহাড় কাটা ও পাইলিংয়ের মাটি এবং উজান থেকে আসা পলিতে কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা হারিয়েছে বহু আগে। দিন দিন তা বন্দরের মূল চ্যানেলের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ নদীর ড্রেজিংয়ের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং’ নামে যে প্রকল্প গ্রহণ করেছিল তার অপমৃত্যু হয়েছে। ১৬৫ কোটি টাকা বিল হাতিয়ে নিয়ে ঠিকাদার সটকে পড়েছে। এ অবস্থায় সরকার পক্ষে বন্দরের ড্রেজিং কাজের একটি অংশ চউকের ওপর অর্পণ করেছে। চট্টগ্রাম বন্দর ও চসিকের এত কর্মযজ্ঞ চউকের হাতে অর্পণ করার পর নগর পরিকল্পনাবিদদের মাঝে প্রশ্ন উঠেছে, এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে চউকের জনশক্তি বা প্রযুক্তিগত অভিজ্ঞতার বিষয়টি নিয়ে। যদিও চউক চেয়ারম্যান দাবি করেছেন, সকলের সহযোগিতা নিয়ে তিনি এগিয়ে যাবেন। ইতোপূর্বে সমন্বয়হীনতা সেবা সংস্থাসমূহের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তা নিরসনে এবার প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সমন্বয় সাধনের নির্দেশনাও প্রদান করা হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, চট্টগ্রাম বন্দর প্রকৃত সৃষ্ট একটি বন্দর। কর্ণফুলীর মোহনা থেকে সুদূর কালুরঘাট পর্যন্ত এর বিস্তৃতি রয়েছে। সদরঘাট পর্যন্ত আগে বড় আকৃতির জাহাজ ভেড়ানো যেত, এখন যায় না। কালুরঘাট পর্যন্ত ছোট ও মাঝারি আকৃতির নৌযান চলাচল করত। এখন সেখানে সৃষ্টি হয়ে আছে অসংখ্য ডুবোচর। মূলত সেই ব্রিটিশ আমলে কালুরঘাট ব্রিজ নির্মাণের পর এ নদীর নাব্যতা হারানো শুরু হয়। এরপর এরশাদ সরকারের আমলে নির্মিত হয় শাহ আমানত সেতু। পিলার নির্মিত এসব সেতু নির্মিত হওয়ার পর উজান থেকে আসা পলির স্তর বাড়তে থাকে। এরপর বিএনপি সরকার আমলে নির্মিত হয় তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু। এটিও পিলার সংযুক্ত। অবশ্য এ সেতু চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার বহু পরে স্টিল গার্ডারের কর্ণফুলী সেতু অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু তার আগেই উজান থেকে নেমে আসা পলিতে জোয়ার-ভাটার কর্ণফুলী নদীর বিশাল অংশ ক্রমাগতভাবে ভরাট হয়ে গেছে। জেগে উঠেছে বিক্ষিপ্তভাবে চর। বিশেষজ্ঞদের দাবি, পিলারসর্বস্ব এসব সেতু নির্মাণের জের হিসেবে বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর এই করুণ দশা।
×