ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এবার ঈদে ১ কোটি ১০ থেকে ১৫ লাখ পশু কোরবানির সম্ভাবনা;###;কোরবানির উপযোগী ১ কোটি ১৫ লাখ ৫৭ হাজার পশু প্রস্তুত রয়েছে

চাহিদার চেয়ে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা বেশি ॥ কোন সঙ্কট হবে না

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২০ আগস্ট ২০১৭

চাহিদার চেয়ে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা বেশি ॥ কোন সঙ্কট হবে না

রহিম শেখ ॥ দেশে বর্তমানে কোরবানি উপযোগী গরু ও মহিষ রয়েছে সাড়ে ৪৪ লাখ। আর ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা ৭১ লাখ। সব মিলিয়ে ১ কোটির ওপরে কোরবানিযোগ্য পশু থাকার কথা বলছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। অধিদফতরের ভাষ্য মতে, দেশে এবার কোরবানির পশু সঙ্কট হবে না। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও বলছে একই কথা। তারপরও পশু সঙ্কটের আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, গত বছর আমদানি না হওয়ায় শেষ মুহূর্তে হাটগুলোতে কৃত্রিম সঙ্কটে কোরবানির পশু চড়া দামে কিনেছেন অনেকেই। তাই এবার পশুর দাম নিয়ে দোটানায় রয়েছেন বেপারিরা। আগে যেখানে আগেভাগেই দাম বাড়া-কমার বিষয়টি আন্দাজ করা যেত, এবার সেটিও করা যাচ্ছে না। উত্তরের জেলাগুলোতে সাম্প্রতিক বন্যার কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক স্থানে ঈদের আর মাত্র দুই সপ্তাহ সময় থাকলেও কোরবানির পশুহাট এখনও জমে ওঠেনি। রাজধানীর সবচেয়ে বড় পশুর হাট গাবতলীতে কেবল প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স এ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে কোরবানি উপযোগী পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৪ লাখ। গত বছরের চেয়ে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ১ লাখ ৫৪ হাজার বেড়ে বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ ৫৭ হাজারে। দেশে বর্তমানে কোরবানি উপযোগী গরু ও মহিষ রয়েছে সাড়ে ৪৪ লাখ। আর ছাগল ও ভেড়ার সংখ্যা ৭১ লাখ। সাধারণত প্রতিবছর কোরবানির ঈদে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ গরু জবাই হয়। চাহিদার ৮০ শতাংশ দেশীয় যোগানে সম্পন্ন হলেও ২০ শতাংশ আসত ভারত ও মিয়ানমার থেকে। তবে গত কয়েক বছর ধরেই ভারত থেকে গরু আসা প্রায় বন্ধ। কিন্তু গত বছর শেষ মুহূর্তে ভারতীয় গরু আমদানি হলেও কৃত্রিম সঙ্কট দেখিয়ে দাম বেশি হাঁকিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ জানিয়েছেন, আসন্ন ঈদ-উল আযহায় কোরবানির পশুর কোন সঙ্কট হবে না। উত্তরাঞ্চলের বন্যারও কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে তিনি জানান। মন্ত্রী জানান, এবারের ঈদে ১ কোটি ১০ থেকে ১৫ লাখ পশু কোরবানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর বিপরীতে সারাদেশে খামার পর্যায়ে কোরবানির উপযোগী ১ কোটি ১৫ লাখ ৫৭ হাজার পশু প্রস্তুত রয়েছে। যার মধ্যে গরু হলো ৪৭ লাখ। চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পশু প্রস্তুত থাকায় ঈদে কোরবানির পশুর সঙ্কট হবে না। জেলা পর্যায়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, দেশে বর্তমানে পর্যাপ্ত গরু রয়েছে। শেষ সময়ে মোটাতাজাকরণে কৃত্রিম হরমোন বা ক্ষতিকর ওষুধের ব্যবহার বন্ধে খামারি পর্যায়ে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক আইনুল হক বলেন, সারাদেশেই কৃষক ও খামারিদের মধ্যে কোরবানির গরু পালনে ব্যাপক উৎসাহ রয়েছে। এবারের ঈদে পশুর কোন ধরনের ঘাটতি হবে না। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা এ সময় সতর্ক রয়েছেন। নিরাপদ গরু উৎপাদনে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা কৃষকদের বাড়ি ও খামারে গিয়ে তদারকি করছেন। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহ এমরান জনকণ্ঠকে বলেন, এবারের কোরবানিতে পশুর যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, দেশে তার চেয়ে অধিক কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে। সরকারী-বেসরকারী হিসাব মতে, বছরটিতে চাহিদার তুলনায় ১০ লাখের বেশি কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে। এরপরও যদি গরু আমদানি হয়, ভারত থেকে গরু নিয়ে আসা হয়; তাহলে সেটি হবে দেশের জন্য আত্মঘাতী। তাই যে কোন ক্রমেই চোরাইপথে আসা গরু আমদানি বন্ধ করতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ গরু ব্যবসায়ী বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, কোরবানি পশুর দাম এখন মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ থাকায় মাংসের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে যা পাঁচ শ’ টাকা ছাড়িয়েছে। আসন্ন কোরবানি ঈদে গরু আমদানি না হলে মধ্যবিত্তের পক্ষে কোরবানি করাই দায় হয়ে পড়বে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার পশুর দাম কম হবে না বেশি হবে তা নির্ভর করছে কয়েকটি বিষয়ের ওপর। এর মধ্যে ভারতীয় গরু আমদানির বিষয়টি অন্যতম। এছাড়া বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হলে দেশী গরুর দাম পড়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গাবতলী পশুহাটের ব্যবসায়ী আলাদীন বলেন, কোরবানি ঈদে পশুর দাম কেমন যাবে তা এখন বলা মুশকিল। সরকার কোনভাবে ভারতকে ম্যানেজ করে গরু আনতে পারে। আমাদের ধারণা আনবে। সেই চেষ্টা সরকার করছে। অপর ব্যবসায়ী আরিফ বলেন, এবার পশুর দাম নিয়ে দোটানায় আছি আমরা। কী হবে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় আগেভাগে গরু হাটে এনে লস খেতে চাই না। গরু আনার বিষয়ে আমরা ভেবেচিন্তে এগোচ্ছি। এদিকে বন্যায় পশুখাদ্য ও বাসস্থান সঙ্কটের কারণে উত্তরের জেলাগুলোতে অপেক্ষাকৃত কমমূল্যে গরু বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন অনেক খামারি ও কৃষক। মধ্য অঞ্চলে গরু উৎপাদনের অন্যতম জেলা সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জসহ বিস্তৃত অঞ্চলে খামারি ও কৃষকরা নিজেদের গরু বিক্রি করছেন কমমূল্যে। তারা জানিয়েছে, বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি ডুবে গেছে, গরু রাখার জায়গা নেই। পশুখাদ্যের মূল্য দ্বিগুণ, কোন কোন ক্ষেত্রে তিনগুণ হয়েছে। এ অবস্থায় অপেক্ষাকৃত কমদামে গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন খামারি ও কৃষকরা। এই প্রভাব পড়েছে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের পশুহাটে। অনেক স্থানে ঈদের আর মাত্র দুই সপ্তাহ সময় থাকলেও কোরবানির পশুহাট জমে ওঠেনি। জমে ওঠেনি দেশের সবচেয়ে বেশি কোরবানির পশু সরবরাহকারী জেলা কুষ্টিয়ার গ্রামের হাটগুলোও। সেখানে খামারি ও কৃষকদের মধ্যে গরুর দাম পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জেলার বৃহত্তর হাট বালিয়াপড়ায় এখনও বেপারিরা পুরোদমে গরু কেনা শুরু করেনি বলে জানিয়েছে কুষ্টিয়ার একাধিক খামারি। সদর উপজেলার কাঞ্চনপুর গ্রামের গরু খামারি জহুরুল ইসলাম জানান, গতকাল স্থানীয় উজানগ্রামের হাট ছিল। সেখানে গরু উঠলেও বেপারিরা গরু তেমন কেনেননি। দামও কম ছিল। যারা কিনছেন তারা গরুর মাংসের ওজন দেখে কিনছেন যেন কোরবানির ঈদের আগে বিক্রি না হলে পরে মাংস বিক্রি করে লাভ করতে পারে। ফলে কোরবানির গরু কেনা তেমন চোখে পড়েনি। বেপারিরা বলছে বন্যার কারণে গরুর বাজার কেমন হবে সেটা নিয়ে তারা শঙ্কায় আছে তাই আগে গরু কিনে লোকসান দিতে রাজি নন। নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার চকবনমালি গ্রামের কৃষক সোহাগ হোসেন জানান, বদলগাছিতে বন্যার পানি গ্রামে ঢুকে পড়ায় গরুর খাবারের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। গরিব কৃষক খাবার কিনতে না পেরে বিক্রি করে দিচ্ছে গরু। নওগাঁর বন্যার আগে ৮০ হাতা বিছালির দাম ছিল ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এখন সেটার দাম ৫০০ টাকা। তাহলে কে এত টাকা দিয়ে গরুকে খাওয়াবেন। এদিকে পবিত্র কোরবানি ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর সবচেয়ে বড় পশুর হাট গাবতলীতে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, পশুর হাটের ভেতরের রাস্তা পরিষ্কার করা হচ্ছে। অপসারণ করা হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় মাটি ও কাদা। গাবতলী পশুর হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য সানোয়ার হোসেন বলেন, কাজ শুরু হয়েছে। ব্যবসায়ীদের ইজারা দিতে যেন ভোগান্তিতে পড়তে না হয় সেই লক্ষ্যে এ বছর আমরা ১০টি কাউন্টার তৈরি করব। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও নজরদারি টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি কমিটির পক্ষ থেকেও স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হবে। তাদের জন্য আলাদা পোশাকেরও ব্যবস্থা করা হবে, যেন দেখলেই চেনা যায়। হাটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত ঈদের তিন-চার দিন আগে শুরু হবে পশুর হাট। রাজধানীর ক্রেতাদের কোরবানির পশু কিনে রাখার জায়গা নেই বলে হাট দেরিতে শুরু হয়। পশু না এলেও গাবতলী হাটের কিছু ব্যবসায়ী আগে থেকেই সেখানে কিছু পশু লালনপালন করে আসছেন। কোরবানির জন্য তারা নিজেদের প্রস্তুতিও শেষ করেছেন। এখন ক্রেতার অপেক্ষায় তারা। গাবতলী পশুহাটের ব্যবসায়ী ইকবাল বলেন, প্রতিবছর কোরবানি ঈদের আগে ঠিক এ সময়ে হাটে গরু, মহিষ ও উট আসতে শুরু করে। কিন্তু এবার আসতে দেরি হচ্ছে। আগে না কিনলেও ক্রেতারা হাটে এসে ঘুরে যেতেন। এবার কোন ক্রেতাই চোখে পড়ছে না।
×