ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অর্থকরী সম্পদ সোনালী আঁশ ফিরে পাচ্ছে গৌরব

প্রকাশিত: ২২:০৭, ১৯ আগস্ট ২০১৭

অর্থকরী সম্পদ সোনালী আঁশ ফিরে পাচ্ছে গৌরব

মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া ॥ সোনালী আঁশ, বাংলাদেশের অর্থকরী সম্পদ কিংবা পাট-এ রচনা না পড়েছে এমন কোন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে ৯০ দশক পর্যন্ত ছিল এমনটি। এমন কোন বাড়ি ছিলনা যে বাণিজ্যিকভাবে না হলেও অন্তত উঠোন কিংবা গোয়ালঘরের পাশের এক চিলতে জমিতে কৃষকরা করত পাটের আবাদ। উৎপাদিত পাটের দড়ি দিয়ে গবাদিপশু বেধে রাখতেন। হাঁড়িপাতিল ঝুলিয়ে রাখার বিভিন্ন উপকরন তৈরি করতেন কৃষাণী মায়েরা। ঝাঁকি জালের রশি পর্যন্ত করতেন নিজের উৎপাদিত পাটের আঁশ দিয়ে। এসব ছিল প্রায় ৯০ সাল পর্যন্ত। এরপরের দৃশ্যপট ভিন্ন। শুধুমাত্র কেউ কেউ শাক খাওয়ার জন্য পাটের আবাদ করছেন। কেউ বা শখের বসে। প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে পাটের আবাদ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়। সিডর, আইলা, নার্গিসসহ বিভিন্ন ধরনের দূর্যোগে জলোচ্ছ্বাসে জমিতে লোনা পানির প্লাবনে লবণাক্তা বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল পরিবেশগত কারণে পাট চাষ হারিয়ে যায়। জলবায়ূ পরিবর্তনজনিত কারণে পাটের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে দক্ষিণের কলাপাড়ায়। কিন্তু কলাপাড়ার পাখিমারায় গড়ে ওঠা পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ফের এই পাটের আবাদ শুরু হয়। তাও পতিত লবনাক্ত পতিত জমিতে দেশি পাটের লবণ সহিষ্ণু জাতের আবাদ শুরু করেন। পাঁচ বছর আগে থেকেই শুরু হয়। কিন্তু ছিটে-ফোটা। তবে এখন বাণিজ্যিকভাবে পাট চাষের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বৈজ্ঞনিকদের উদ্ভাবিত নতুন লবণসহিষ্ণু চারটি জাতের চাষে পাওয়া গেছে শতভাগ সফলতা। কলাপাড়ায় ৫০টি পাইলট প্রকল্পে এসব জাতের পাটের আবাদে শতভাগ সফলতা এসেছে। উৎপাদন এসেছে প্রতি হেক্টরে প্রায় তিন টন। ফলে হারিয়ে যাওয়া কৃষি অর্থনীতিতে পাট উৎপাদনের মধ্য দিয়ে যোগ হচ্ছে নতুন দিগন্ত। এলক্ষ্যে কৃষককে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করে বাণিজ্যিকভাবে পাটের উৎপাদনের জন্য উপকূলের পতিত লবনাক্ত জমিকে আনতে হবে চাষের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর দেশে ফের ফিরে আসবে হারানো সোনালী অতীত অর্থকরী সম্পদ পাট। কৃষকরাও স্বাবলম্বী হবে পাটের আবাদের মধ্য দিয়ে। কৃষি মন্ত্রনালয়ের একটি প্রকল্প (পাট ও পাট জাতীয় ফসলের কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও হস্তান্তর প্রকল্প) পাট চাষের এমন উদ্যোগ নেয়। এর বাণিজ্যিক সফলতা উপকুলের কৃষকরা সরাসরি পাচ্ছেন। খবর গবেষণা কর্মকর্তা কৃষকসহ নির্ভরযোগ্য সুত্রের। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের আবাদী জমির পরিমান ২ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন হেক্টর। যা মধ্যে মাত্র ৩০ভাগ জমি চাষের আওতায় রয়েছে। এরমধ্যে ১ দশমিক ০৬ মিলিয়ন হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার লবনাক্ততায় আক্রান্ত। যা ক্রমশ বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি লবণাক্ত জেলা হচ্ছে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ভোলা, বরগুনা, কক্সবাজার, নোয়াখালী, চট্রগ্রাম, পটুয়াখালী ও পিরোজপুর। পটুয়াখালীতে প্রায় দেড় লাখ হেক্টর জমি খরিপ-১ মৌসুমে লবণাক্ততার কারনে পতিত থাকছে। এসব পতিত জমিকে পাট চাষের আওতায় আনার জন্য ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ পাট গবেষনা ইনস্টিটিউটের পাখিমারা গবেষণা ব্লকে দেশি পাটের লবন সহিষ্ণু চারটি জাতের পরীক্ষণ চালানো হয়। স্থানীয় কৃষককে পতিত জমিতে এ জাতের পাট চাষে পাওয়া গেছে শতভাগ সফলতা। এবছরও কলাপাড়ার ৫০ কৃষকের পতিত জমিতে লবণসহিষ্ণু জাতের পাটের পরীক্ষামূলক পাটের আবাদ করা হয়। পাওয়া গেছে শতভাগ সফলতা। গড়ে ফলন পাওয়া গেছে প্রতি হেক্টরে প্রায় তিন টন। অন্তত ৩০০ কৃষককে চাষ সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। স্থানীয় কৃষকদের মাঝে দিন দিন বাড়ছে এ জাতের পাট চাষের আগ্রহ। তবে দীর্ঘদিন পাটের আবাদ না হওয়ায় এবং স্থানীয়ভাবে পাটের বাজার না থাকায় উৎপাদিত পাট বিক্রয় নিয়ে কৃষকরা রয়েছে নানা সমস্যার কথা বলেছেন। লতাচাপলীর মিশ্রিপাড়া গ্রামের কৃষক মো. মাসুম জানান, বর্ষাকালে আমন চাষের জমি পতিত পড়ে থাকে। শুকনো মৌসুমে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। তখন আর কোন ফসল আবাদ করা যায়না। পাট গবেষণার কর্মকর্তাদের কথায় তিন বছর পাট চাষ করছেন। ভাল ফলন পেয়েছেন। খাজুরা গ্রামের আবু জাফর জানান, যেসব জমিতে বাপ-দাদারা কখনো পাট লাগায়নি গত দুই বছর পাট চাষ করে আমি লাভবান। জমি পতিত থাকেনা। ওই গ্রামের কৃষক বেল্লাল শেখও একই কথা বললেন। তবে পাটের বাজার নিয়ে এদের প্রত্যেকরই শঙ্কা রয়েছে। তবে সেচ সমস্যা আর উৎপাদিত আঁশের বাজারজাত সমস্যার সমাধান করা গেলে আগামী দিনে উপকূলীয় এলাকায় পাট চাষ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হবে বলে মনে করেন লবনাক্ত সহিষ্ণু পাটের জাত উদ্ভাবক ড.মাহমুদ আল হোসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাট ও পাট জাতীয় ফসলের কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও হস্তান্তর প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ পাট গবেষনা ইনস্টিটিউট কতৃক উদ্ভাবিত লবনাক্ত সহিষ্ণু দেশী পাট-৮ জাতের ১৪ডিএস/মিটার এবং ৯ডিএস/মিটার মাত্রার সহনশীল চারটি লাইন উদ্ভাবন করা হয়েছে। কৃষকের জমিতে মাঠ মূল্যায়নের মাধ্যমে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার পশ্চিম খাজুরায় ১৩.৪৫ডিএস/মিটার, মম্বিপাড়ায় ১১.৬ ডিএস/মিটার, মিশ্রিপাড়ায় ৮.৩০ ডিএস/মিটার এর সফলতা পাওয়া গেছে। ড.মাহমুদ আল হোসেন আরো বলেন, কৃষি নির্ভরশীল আমাদের দেশ প্রতিনিয়ত বাড়ছে মানুষ। কমছে কৃষি জমি। আমাদের অর্থনীতি দাড়িয়ে আছে কৃষির উপড় নির্ভর করে। সেখানে কৃষি জমি পতিত থাকলে অর্থনীতির চাকার গতি মন্থর হতে পারে। তাই উপকূলীয় এলাকার সকল কৃষকদের পাট চাষে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে সকল পতিত জমিকে পাট চাষের আওতায় আনতে হবে। আর এজন্য সরকারী ভাবে আরও বেশি বেশি পাইলট প্রোগ্রাম নেয়া প্রয়োজন রয়েছে। আরো কৃষকদের প্রনোদনার আওতায় আনতে হবে। উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ত জমিতে পাট চাষের সম্ভাবনা নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে বিজেআরআই মহা পরিচালক ড. মনজুরুল আলম বলেন, স্থায়ীভাবে কৃষকদের এ সমস্যার সমাধান এবং সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি সকল কৃষককে পাট চাষে সম্পৃক্ত করা গেলে কৃষি অর্থনীতিতে আসবে গতিশীলতা, কৃষক হবে অর্থিকভাবে সাবলম্বী, পাট ফিরে পাবে তার হারানো অতীত। আর পতিত থাকবেনা কোন জমি। যা জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
×