ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

ডেট লাইন ১৫ আগস্ট

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৯ আগস্ট ২০১৭

ডেট লাইন ১৫ আগস্ট

কেউ কেউ আমাকে বলেন আমি কেবল বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ কামাল এবং শেখ হাসিনাসহ তার সরকার ও আগস্ট ট্র্যাজেডির ওপর একটানা লিখে যাচ্ছি। অন্য কোন বিষয় নেই কি? তাদের বলেছি আছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ সংসদে পাস করা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিয়েছে। রায়টি বাতিল করতে গিয়ে তারা অহেতুক কতগুলো কথা বলেছেন অবজারভেশন বা পর্যবেক্ষণের নামে। যেটি আমি মনে করেছি প্রয়োজন ছিল না। প্রধান বিচারপতির ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গাওয়া কেন? এসব অবজারভেশন কি তিনি সরল উদ্দেশ্যে দিয়েছেন নাকি এর পেছনে কোন ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত এজেন্ডা রয়েছে। যেমন তিনি বলেছেন : ‘কোন এক ব্যক্তির নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি’- এতে তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালীর জাতি-রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কটাক্ষ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি বিএনপি-জামায়াত তথা স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে একটা অস্ত্র তুলে দিয়েছেন, যা সময়ের সাহসী রাষ্ট্রনেতা শেখ হাসিনা, তার সরকার তথা বাংলাদেশের দীর্ঘ সংগ্রাম, বঙ্গবন্ধুর দুনিয়া কাঁপানো নেতৃত্ব এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের মূলধারার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিলেন। বিএনপি-জামায়াত তো এটাই চায়। তারা মিলিটারি জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড় করাতে চায়। প্রধান বিচারপতি তাতে যোগ দিলেন। এটি কি তার ঠিক হলো? সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ সময় এ ধরনের একটা বক্তব্য দেয়ার অর্থ হচ্ছে তিনি নিজেই রাজনীতি করেছেন। প্রধান বিচারপতিকে বিনীতভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের রাঘব বোয়ালদের বিচার হয়নি। আমি তার সঙ্গে এ প্রশ্নে একমত। যেমন খোন্দকার মোশতাক, মিলিটারি জিয়াউর রহমান, তাহের ঠাকুর, নূরুল ইসলাম মনজুর এবং পাকিস্তানের আইএসআইসহ তাদের বিদেশী প্রভুদের বিচার হয়নি। আমি বিশ্বাস করি তাও একদিন হবে। মরণোত্তর হোক আর জীবিতাবস্থায় হোক, হবেই। সেইসঙ্গে তিনি যে ‘শিবের’ গীত গেয়েছেন তারও চেহারা উন্মোচিত হবে। রায় নিয়ে কথা বলব না, বলবেন আইনজ্ঞরা। কিন্তু তিনি যখন বলেন পার্লামেন্ট ‘ইমম্যাচুর’ তখন কথা বলতেই হয় এই ইমম্যাচুর পার্লামেন্ট মেম্বাররাই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালী জাতির হাজার বছরের স্বপ্নসাধ স্বাধীনতা তথা নিজস্ব জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছেন। এসব আমি আগেও লিখেছি। টক শোতে অনেকবার বলেছি, ভবিষ্যতেও আরও লিখব, বলব; কিন্তু এই আগস্ট মাসটা এমন যে, এ মাসে অন্য কোন ইস্যু নিয়ে যারা বেশি বেশি লিখেন বা টক শোতে গলাবাজি করেন তারা মূলত আগস্ট ট্র্যাজেডি থেকে পাঠকের দৃষ্টি বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে চান। আমি তাদের দলের বা ভ- সিভিল সোসাইটির মেম্বার নই। আমি বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক, যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের গৌরব ধারণ করে আজও বেঁচে আছেন আমি তাদের একজন। একটু ভিন্নতা, একটু স্বকীয়তা, একটু আত্মম্ভরিতা তো থাকবেই। ডেট লাইন ১৫ আগস্ট ডেট লাইন ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাসভবন। এরচেয়ে বেশি বলার প্রয়োজন পড়ে না, কারণ বাঙালী জাতির ঠিকানা এখানে অঙ্কিত যেন শিল্পী হাশেম খানের হস্তাক্ষরের সংবিধান। সুবহে-সাদেক পেরিয়ে ফজরের আজান হচ্ছে। মুয়াজ্জিন উচ্চারণ করছেন- ‘আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম (নামাজ নিদ্রা থেকে উত্তম)’। মুয়াজ্জিনের সুমধুর কণ্ঠ ভোরের নির্মল বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল তখনও। মুসল্লিগণ মসজিদের পথে ছুটছেন মুক্তির অন্বেষায়। বাসভবনে লুটিয়ে পড়ল বাংলার হৃদয়। সিঁড়িতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্তাক্ত দেহ, সিঁড়ির গোড়ায় শেখ কামাল, দোতলায় শোবার ঘরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ আবু নাসের, কর্নেল জামিল, অন্য বাড়িতে শেখ ফজলুল হক মণি, আরজু মণি, আবদুর রব সিরনিয়াবাত, সুকান্ত বাবু নিথর নিস্তব্ধ। নবপরিণীতা দুই পুত্রবধূ শেখ সুলতানা কামাল, শেখ রোজি জামালের হাতের মেহেদির রং তখনও শুকোয়নি। কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না তুলে বুকের তাজা রক্ত ঢালতে ঢালতে ৩২ নম্বরের বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে গড়াতে গড়াতে বাংলার সবুজ মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর ধুয়ে দিল। কি পবিত্র সেই রক্তের ধারা। ৪২টি বছর চলে গেল। আজও সেই রক্তধারা বাংলার অপবিত্র মাটি ধুয়ে পবিত্র করে চলেছে। কী অসাধারণ, কী অপ্রতিরোধ্য। একে থামিয়ে দেবার ক্ষমতা কারও নেই। এই বাংলায় নেই, প্রাচ্য ছাড়িয়ে প্রতীচ্যের নয়। পাশ দিয়ে যেতে যেতে কে যেন ডেকে বলে-তিষ্ট ক্ষণকাল। এখানে বাংলার হৃদয় ঘুমিয়ে আছে, একটু উষ্ণতা নিয়ে যাও পথিক, পথ হারাবে না। কে যেন একজন বলেছিল তোমরা বাংলার হৃদয়ের রক্ত ঝরিয়েছ ঠিকই এবং সেইসঙ্গে ঐ ৩২ নম্বরের বাসভবন কিংবা টুঙ্গিপাড়ার সমাধি তাবৎ মুক্তিকামী মানুষের তীর্থভূমিতেও পরিণত করে দিয়ে গেলে। ক্লান্ত-শ্রান্ত পথিককে মহাকালের পথে থমকে দাঁড়াতেই হবে এখানে এই ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাড়িতে। যেতে হবে টুঙ্গিপাড়ার সমাধির পাশে। বলতে হবে পিতা আমাদের ক্ষমা করুন। হে বাংলার পুরনারীগণ হে বাংলার পুরনারী আপনারা ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাসভবনের বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে চেনেন কি? না চিনলে আমি চিনিয়ে দিচ্ছি, দয়া করে মনোযোগ দিয়ে শুনুন। বঙ্গমাতা হবার জন্য তাঁকে রাজপথে গলাবাজি করতে হয়নি। অতি সাধারণ জীবনযাপন করেও অসাধারণ এক উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে আপনাদের সামনে যে উদাহরণ রেখে গেলেন আমি হলফ করে বলতে পারি তা আগত-অনাগত প্রজন্মের জন্য ভাবতে হবে না। বরং এক অভাবনীয় বর্ণাঢ্য জীবন লাভে সক্ষম হবেন। তাঁর সংগ্রামী জীবন কি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব স্বামী হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বাঙালীর জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিক সংসার সামলেছেন, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁর রাজনৈতিক সংসারও ম্যানেজ করেছেন বিচক্ষণ রাষ্ট্রনেতার মতো। বঙ্গবন্ধু তো এক যুগেরও বেশি সময় পাকি মিলিটারি জান্তার কারাগারে কাটিয়েছেন। এর মধ্যেই শেখ হাসিনার মতো সময়ের সাহসী একজন রাষ্ট্রনায়ককে উপহার দিয়েছেন। একজন শেখ কামালকে উপহার দিয়েছেন অনাগত তরুণদের স্বপ্নের নায়ক হিসেবে। বাংলার যে কন্যা শেখ হাসিনার জীবনের পাঠ নেবে তাকে জীবন-সংসার গোছাতে দ্বিতীয় পাঠ নিতে হবে না, যে তরুণ শেখ কামালকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করবে তাকে কোন পশ্চাৎপদতা স্পর্শ করবে না, কোন কুপথ টানতে পারবে না, সন্ত্রাস, মাদকাসক্তি তার কাছেও ঘেঁষতে পারবে না। বঙ্গমাতার জন্ম ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট। খুব ছেলেবেলায় অর্থাৎ শৈশবেই পিতৃ-মাতৃহীন হন এবং মাত্র তিন বছর বয়সে খেলার সাথীর মতো বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী হিসেবে এই পরিবারে পিতা শেখ লুৎফুর রহমান ও মাতা শেখ সাহেরা খাতুনের আদর-যতেœ বড় হন। শেখ কামালের জন্ম ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট। লক্ষ্য করার বিষয় হলো ১৯৭৫ সালের এই আগস্টের ১৫ তারিখ ঘটে ইতিহাসের নির্মম হত্যাকা- এবং কেবল বঙ্গবন্ধু নন, তাঁর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব; তিনপুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল, দুই নবপরিণীতা পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামালসহ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাসভবনের সকলকে নির্মমভাবে হত্যা করে বাংলাদেশ মিলিটারির বিপথগামী সদস্যরা। অন্য বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনদের। সেদিন দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা শেখ হাসিনার স্বামী প্রখ্যাত অণুবিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ আলী মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। ড. ওয়াজেদ সেখানে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণারত ছিলেন। এই শোকের মাসে বঙ্গমাতা ও শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা কতখানি কষ্টের? তারপরও দুটি জন্মদিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলেও শোকগাথাই হয়েছে বেশি। সবাই তো আর খালেদা জিয়া নন যে, ১৫ আগস্ট ভুয়া জন্মদিন ঘোষণা করে উৎসব করবেন। এদিন সত্যিকার জন্মদিন হলেও তো করা উচিত নয়। একজন সাধারণ নাগরিকও এদিন নিজের সত্যিকার জন্মদিনও পালন করে না। রুচিতে বাধে। বাধে না কেবল ঐ ম্যাডামের। তাছাড়া তিনি তো আর সাধারণ নারী নন, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। তার মধ্যে ভব্যতা আশা করাটা বেশি কিছু কি? অবশ্য এর জন্য শিক্ষা, পরিবেশ ও ঐতিহ্য থাকতে হয়। শোকের মাসে জন্মদিন শোকের মাসে দুটি জন্মদিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন নাট্য ব্যক্তিত্ব পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে শেখ কামালের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বন্ধুরা। এ উপলক্ষে তারা ‘সতীর্থ-স্বজন প্রকাশনা’ নাম দিয়ে ‘সতত প্রেরণাদায়ী বঙ্গমাতা’ ও ‘শেখ কামাল, উদ্দীপ্ত যৌবনের দূত’ শিরোনামে দুটি সঙ্কলনও প্রকাশ করে। বঙ্গমাতার জন্মদিনের সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ দৈনিক ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাসমিমা হোসেন এবং মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা। আলোচনা করেন হুইপ মাহবুব আরা বেগম গিনি, কবি কাজী রোজি এমপি ও আমরা কয়েকজন। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জীবন দর্শন শাশ্বত বাঙালী নারীর প্রতিকৃতি। তুলনা হতে পারে কেবল অপর মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের সঙ্গে। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত অবরোধবাসী নারীদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে সংসার ধর্মের বাইরেও যে সমাজে, রাষ্ট্রে নারীদের করণীয় আছে তার পথ দেখিয়েছেন, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবও বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক সংসার এবং রাজনৈতিক সংসার দুটিই সমভাবে সামলেও যে গণমানুষকে পথ দেখানো যায়, সাধারণ গৃহবধূ হয়েও আন্দোলন-সংগ্রামের পতাকা তুলে ধরা যায় তার অনুকরণীয় উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কারাগারে কাটিয়েছেন। বেগম মুজিব কখনও তাঁকে পিছু টানেননি। বরং শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে যেমন ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন, তেমনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংসার ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগকেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে ছাত্রলীগ নেতাদের দিকনির্দেশনার পাশাপাশি অর্থেরও জোগান দিয়েছেন। নিজে যেমন বাঙালী মুসলমান গৃহবধূর মতো সাদামাটা জীবনযাপন করেছেন, পোশাক-আশাকও তেমনি এবং রুচিসম্মত। এক মুহূর্তের জন্যও মাথার কাপড় সরত না। অনেক সময় অর্থাভাবে ছেলেমেয়েদের খাবার থালার খিচুড়ির বাইরে কিছু দিতে পারেননি। ঐ পরিবারে এজন্য কোন আফসোস ছিল না। বরং লেখাপড়ার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চায় মনোনিবেশ ছিল ঐতিহ্য। এমনকি বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বাঙালীর জাতি-রাষ্ট্রের পিতা বা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী হবার পরও অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক হবার পরও বেগম মুজিবের পোশাক পাল্টায়নি, গায়ে বিদেশী শিপন ওঠেনি। ঠিক একইভাবে দেখা গেছে তাঁদের আদরের প্রথম সন্তান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে আসতেন সাধারণ সূতি শাড়ি পরে। শেখ কামালকেও কখনও ইনশার্ট করে ক্যাম্পাসে আসতে দেখা যায়নি। ওপেন ফুলহাতা টি-শার্ট, প্যান্ট আর পায়ে সাধারণ স্যান্ডেল বা স্যান্ডেল সু। কোনদিন স্যুট পরতে দেখা যায়নি। কেবল একবার দেখা গেছে বিয়ের সময়। ছাত্রলীগ করতেন; কিন্তু কোনদিন নেতৃত্বের আসনে বসেননি। পরিবারের ঈঁষঃঁৎব ছিল “ঝরসঢ়ষব ষরারহম যরময ঃযরহশরহম”। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন। এই ছিল তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। কিন্তু বাসায় ধর্ম, দর্শন, মহাপুরুষদের জীবনী পড়তেন। শুনেছি বার্ট্রান্ড রাসেল পড়তে পড়তে ‘রাসেল’ শব্দটি পছন্দ হয় এবং এভাবেই ছোট ছেলের নাম রাখেন শেখ রাসেল। রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয়টি যেমন নিজের জীবনের উপলব্ধি দিয়ে শাণিত করেছেন, তেমনি ছেলেবেলা থেকেই মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, পল্লী কবি জসীমউদ্দীন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন প্রমুখকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। শেখ হাসিনাসহ অন্য সন্তানরাও এভাবেই বড় হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর এত কালজয়ী ব্যক্তিত্ব তো ঘরেই রয়েছেন। বেগম মুজিব আন্দোলনে-সংগ্রামে কতখানি আপোসহীন, দেশের প্রতি কতখানি বিশ্বস্ত থেকেছেন তার একটি উদাহরণ- বঙ্গবন্ধু তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করারও ষড়যন্ত্র চলছে। তৎকালীন মিলিটারি শাসক আইয়ুব খাঁ পশ্চিম পাকিস্তানে নেতাদের বৈঠক আহ্বান করলেন এবং বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বৈঠকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালেন। কেউ কেউ এও বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষা হোক চাইলে প্যারোলে মুক্তি দরকার। নেতাদের অনেকেই এ প্রস্তাবে রাজি ছিলেন; কিন্তু বেগম মুজিব এত বড় আপোসহীন দূরদর্শী ও দেশপ্রেমিক ছিলেন যে, স্বামীর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও প্যারোলের বিপক্ষে দাঁড়ালেন এবং প্যারোলে মুক্তি না নেয়ার জন্য চিঠি লিখে কন্যা শেখ হাসিনা ও জামাতা ওয়াজেদ মিয়ার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর কাছে বার্তা পাঠালেন। সমাজ বিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক গবেষকগণ তাঁকে বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সহযোদ্ধা হিসেবে মনে করেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এ বাড়ি সে বাড়ি আত্মগোপনের এক পর্যায়ে সন্তানসহ গ্রেফতার হয়ে ধানম-ির একটি বাড়িতে (সাব-জেল) ওঠেন। তার আগেই বড় দুই ছেলে শেখ কামাল ও শেখ জামালকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার জন্য ভারতে পাঠিয়ে দেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেদিন শেখ রাসেলের বয়সও যদি ১৫/১৬ বছর হতো হয় তো তাকেও পাঠিয়ে দিতেন দেশের জন্য যুদ্ধ করতে। শেখ হাসিনা তখন সন্তানসম্ভবা। নয় তো তিনিও যুদ্ধে যেতেন। বাংলাদেশের নারীরা অবহেলিত। বেগম রোকেয়ার ভাষায় অবরোধবাসিনী। তারপরও সংসার ধর্ম পালন করে একজন নারী যে নিজের সন্তান-সন্ততি তথা পরিবারের বাইরে বিশাল জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত করতে পারেন তার প্রমাণ বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বেগম মুজিব সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষায় মানুষের মতো মানুষ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার মধ্যেও এই গুণাবলী লক্ষণীয়। শেখ হাসিনার সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় যেমন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইটি বিশেষজ্ঞ, তেমনি কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও অটিজমের ওপর কাজ করতে করতে এখন জাতিসংঘের পরামর্শদাতা। জয় যেমন হার্ভার্ড এডুকেটেড, তেমনি পুতুলও বোস্টনের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী। শেখ রেহানার ছেলে ববি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে এখন জয়-পুতুলের পাশাপাশি শেখ হাসিনাকেও সাহায্য করছেন। রেহানার বড় মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক তো হাউস অব কমন্সে ঝড় তুলছেন নির্বাচিত ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি হিসেবে। রেহানার ছোট মেয়েও অক্সফোর্ডে লেখাপড়া শেষ করার পথে। অথচ অনেকেই জানেন না বঙ্গবন্ধু হত্যার পর শেখ রেহানা লন্ডনে বাংলাদেশ সেন্টারে রিসেপশনিস্টের চাকরি করেছেন। শেখ কামাল আজও চোখ বন্ধ করলে তার মুখচ্ছবি সামনে ভেসে বেড়ায়- উজ্জ্বল শ্যামল গায়ের রং, ঘন কালো ব্যাকব্রাশ করা চুল, মোটা গোঁফ, মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, মেদহীন পাতলা শরীর হলেও আর দশটি তরুণের চেয়ে আলাদা ব্যক্তিত্বের অধিকারী। প্রাণোচ্ছল মেধাবী, উদ্যমী, পরিশ্রমী, দক্ষ সংগঠক এবং সৃষ্টিশীল। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর এত বড় ক্ষমতার ছত্রছায়া অর্থাৎ পিতার রাষ্ট্রক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে তরুণ কেবল ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সদস্য হয়েছেন। ইচ্ছে করলে বড় কোন পদে যেতে পারতেন। যাননি। এটাই ছিল এই পরিবারের স্বতন্ত্র শিক্ষা, কালচার। মনে পড়ছে সম্ভবত ১৯৭৪। লাইব্রেরির পেছনে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন। ভদ্রলোক টিপিক্যাল ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতেন। আমরা তার ওখানে চা-সিঙ্গাড়া খেতাম। একদিন ঢুকে দেখি ছালার চট পরা কবি সাফদার সিদ্দিকীও চা খাচ্ছে। আমাকে চিনত। কবি নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, আবুল হাসান, সেলিম আল-দীন, আখতারুন্নবীদের (কবি ও লেখক) সঙ্গে আমার সখ্য ছিল। এক পর্যায়ে সাফদার বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে খুব আপত্তিকর কিছু মন্তব্য করল। তাকিয়ে দেখলাম ছাত্রলীগের কিছু কর্মী কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় চোখ করে তাকাচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, সাফদার তোমার কথাটি উইড্র কর। সে করল না। তখন আমি ওর হাত ধরে বেরিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় আমার চেনা এক ছাত্রলীগ কর্মী দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, শফিক ভাই ওকে আমাদের হাতে ছেড়ে দিন। ওকে ভাল করে গাঁজা খাওয়াব। বললাম, দ্যাখো ও কবি, কবিরা গাঁজা খেয়ে কত কিছু বলে, ও ধরতে নেই। আমি ওকে নিয়ে লাইব্রেরির পুব পাশে এসে একটা রিকশা ডাকলাম এবং হাতে ১০টা টাকা দিয়ে বললাম, এই পথে চলে যাও, আজ আর ক্যাম্পাসে এসো না। আমি কলাভবনের দিকে চলে আসি। কিছুক্ষণ পর কবি রফিক আজাদ ও কবি মহাদেব সাহা এসে বললেন, ছাত্রলীগের ছেলেরা সাফদারকে ধরে নিয়ে গেছে। আমি তাদের সঙ্গে যেতে যেতে দেখলাম বন্ধুবেষ্টিত শেখ কামাল, কলাভবনের গাড়ি বারান্দায়। কামালকে ঘটনাটা বললাম। শুনে সঙ্গে সঙ্গে বলল, আপনিও চলুন। কামাল সরাসরি ওদের ভিড় থেকে সাফদারকে বের করে নিয়ে এলো এবং ওকে গাড়ির পেছনে ও আমাকে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসিয়ে স্টার্ট করে বলল, কোথায় যাবেন? বললাম প্রেসক্লাবে নামিয়ে দাও। কামাল তাই করল। গাড়ি থেকে নামিয়ে সাফদারের হাতে একটা নোট গুঁজে দিল। নোটটা ভাল করে দেখিনি, পঞ্চাশও হতে পারে, একশ’ও হতে পারে। টাকাটা হাতে দিতে দিতে বলল, এত সুন্দর কবিতা লেখেন, গাঁজা খান ক্যানো? চলবে... ঢাকা ॥ ১৭ আগস্ট ২০১৭ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×