ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সমুদ্র বাণিজ্যে কর্মসংস্থানে বিপর্যয়

নৌ ক্যাডেট ও অফিসারদের চাকরিপ্রাপ্তি এখন যেন ‘ডেড স্টপ’

প্রকাশিত: ০৫:০০, ১৯ আগস্ট ২০১৭

নৌ ক্যাডেট ও অফিসারদের চাকরিপ্রাপ্তি এখন যেন ‘ডেড স্টপ’

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ এক সময়ের সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর। বর্তমানে নৌপরিবহন অধিদফতর নামকরণ করা হয়েছে। আর এ সংস্থার নিয়ন্ত্রিত চট্টগ্রাম ও খুলনার নৌবাণিজ্য অধিদফতরের নাম হয়েছে নৌবাণিজ্য দফতর। অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি, রাজস্ব লোপাট, নাবিকের নামে বিদেশে মানবপাচারসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে সংস্থার এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অপকর্মের জের হিসেবে এ সংস্থার অগ্রগতির চাকাটি বন্ধ হয়ে ‘ডেড স্টপ’ হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে। পাশাপাশি এ সংস্থার কার্যক্রমের মাধ্যমে অতীতে যেখানে বছরে ১২শ’ কোটি টাকারও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো তা এখন হ্রাস পেয়ে ৭শ’ কোটি টাকারও সামান্য বেশিতে এসে ঠেকেছে। অথচ আন্তর্জাতিক সমুদ্র বাণিজ্য যখন দিন দিন কেবলই বিস্তৃত হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশী নৌ অফিসার, ক্যাডেট ও নাবিক সংখ্যা কমতে কমতে বেকার সংখ্যা বাড়ছে। কয়েকটি দেশে নৌ অফিসার ও ক্যাডেট, নাবিকদের সাইন অব এবং সাইন অন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়ার পর যে স্থবিরতা নেমে এসেছে তাতে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার অন্যতম কারণ। পাশাপাশি দেশে সরকারী মেরিন একাডেমির প্রশিক্ষণ গ্রহণের মতো বেসরকারী পর্যায়েও গজিয়ে উঠেছে আরও ১৮টি একাডেমি। এসব বেসরকারী একাডেমির কার্যক্রম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি না মেলার পরও এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিনিয়ত যেসব ক্যাডেট বেরিয়ে আসছে তাদের চাকরির সংস্থান একেবারেই সঙ্কুচিত হয়ে আছে। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে এ জাতীয় অবৈধ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ফলে বাংলাদেশী ক্যাডেটদের মান নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলাচলরত জাহাজ কর্তৃপক্ষ সমূহের মাঝে দিন দিন সন্দেহের দানা বাঁধার ঘটনা কেবলই দৃঢ়তর হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জাল এনওসি (অনাপত্তি সনদ) দিয়ে মানবপাচার, জিএমডিএসএস (গ্লোবাল মেরিটাইম ডিসট্রেস এ্যান্ড সেফটি সিস্টেম) প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা, জাহাজের ফিটনেস সার্ভে ও পরীক্ষা কার্যক্রমে নজিরবিহীন দুর্নীতি, অকেজো নৌশিক্ষা প্রশাসন, ভুয়া সিডিসি (কন্টিনিওয়াজ ডিসচার্জ সার্টিফিকেট) প্রদানসহ নানা অপকর্মের কারণে সংস্থার মধ্যে নেতিবাচক ঘটনাগুলোর জন্ম হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের এ সেক্টরটি ডুবছে। সূত্র জানায়, সর্বশেষ চলতি বছরের ১৮ জুলাই নৌপরিবহন অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী দুদকের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। দুর্নীতির অন্যতম নায়ক হিসেবে চিহ্নিত এ কর্মকর্তা গ্রেফতার হওয়ার পর অপকর্মের সিন্ডিকেট সদস্যরা অত্যন্ত কৌশলে স্থবিরতা নেমে আসা এ সংস্থার কার্যক্রমকে আরও নেতিবাচক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অতিসম্প্রতি চট্টগ্রামে অবস্থিত নৌবাণিজ্য দফতর আন্তর্জাতিক ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি ডিএন-ভিজিএলের (আন্তর্জাতিক ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি) ভুয়া সনদ দিয়ে কয়েকটি কোস্টাল ট্যাঙ্কারের রেজিস্ট্রেশন প্রদানের ঘটনা দুর্নীতির সর্বশেষ বড় একটি রেকর্ড হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সূত্র জানায়, এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় দুর্নীতির যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটার সঙ্গে জঙ্গী পাচার ও নাবিকদের চাকরির বাজার সঙ্কুচিত হওয়ার বিষয়টিও অন্যতম কারণ। নৌ অধিদফতরের অনাপত্তি সনদে মানবপাচার বিষয়টি ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন সংস্থার কাছে একজনের অবৈধ এনওসি ধরা পড়ার পর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে আসে। এ ঘটনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তার পক্ষে নৌ অধিদফতরে যে পত্র দেয়া হয় তাতে প্রকাশ পায় নানা গোপন তথ্য। বেরিয়ে আসে ১ হাজারও বেশি এ ধরনের ভুয়া এনওসি প্রদান করেছে নৌ অধিদফতরের এক ইঞ্জিনিয়ার সার্ভেয়ার। যার অফিশিয়াল নথি গায়েব করা ফেলা হয়েছে। এ ব্যাপারে যে তদন্ত কমিটি হয় তার আহ্বায়ক ছিলেন নাবিক প্রবাসী কল্যাণ পরিদফতরের সাবেক পরিচালক। কিন্তু প্রভাবশালী চক্রের চাপের কারণে তিন মাসের মধ্যে তিনি তদন্ত কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হন। ঘটনাটি শেষতক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত গড়ায় এবং তা গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তদন্ত হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে নৌ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত হয় এক সদস্যের তদন্ত কমিটি। তদন্ত শেষে এ সংক্রান্তে একটি রিপোর্ট নৌ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে দাখিল করা হয়েছে। কিন্তু এ রিপোর্টও ধামাচাপা পড়ে আছে। সর্বশেষ নৌ অধিদফতরের অবসরপ্রাপ্ত ডিজি চট্টগ্রামস্থ নৌবাণিজ্য দফতরের প্রধান কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেন। কিন্তু তার পক্ষেও রিপোর্ট প্রদান করা হয়নি। এরপর থেকে বিদেশে চাকরির নামে এনওসি প্রদান বন্ধ রয়েছে। কিন্তু বন্ধের এ নির্দেশনা না মেনে নৌ অধিদফতরের পক্ষে এখনও এনওসি দেয়া অব্যাহত রয়েছে। আরও পরবর্তীতে নৌ অধিদফতরের দুর্নীতির একটি চিত্রে প্রকাশ পেয়েছে সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে। কোরীয় সরকারের সহায়তায় ৩৭৫ কোটি টাকার জিএমডিএসএস (গ্লোবাল মেরিটাইম এ্যান্ড ডিসট্রেস সেফটি সিস্টেম) প্রকল্পে বড় ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। সূত্র জানায়, জিএমডিএসএস প্রকল্পের কাজ চলতি বছরের শুরুতে হওয়ার কথা থাকলেও তা দৃশ্যমান নয়। অধিদফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, টেন্ডার জটিলতায় প্রকল্পটি এখন স্থবির। কাগজে-কলমে এ প্রকল্পের জন্য ৫০ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে কর্মরত রয়েছে ৫ জন। যার মধ্যে ২ কর্মচারী মতিঝিলের প্রকল্প অফিস পাহারা দেয়। আর ৩ সার্ভেয়ার নৌ অধ্যাদেশ পরিপন্থী নাবিকদের পরীক্ষা কার্যক্রমে ন্যাস্ত রয়েছেন। এ বিষয়ে স্থায়ী পরীক্ষকদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এ খাতে ইতোমধ্যে ৩২ কোটি টাকা খরচের হিসাব দেখানো হলেও তা মূলত লোপাটই হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আরও অভিযোগ আছে নাবিক ও অফিসারদের পরীক্ষা গ্রহণ ও পাস করানোর বিষয়টির নেপথ্যে রয়েছে মোটা অঙ্কের ঘুষের লেনদেন। এদের একটি অংশ দেশে বিদেশে আইএমও (ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন) মনোনীত সার্ভেয়ারদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে দেশের সুনাম কেবলই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এছাড়া অবাধে জাল সার্টিফিকেট ইস্যু ও অবৈধ সার্টিফিকেট অব রিকগনিশন (সিআরও) দেয়ার বিষয়টি তদন্তে ধামাচাপা পড়েছে। সূত্র জানায়, নৌপরিবহন অধিদফতরের ৬ সার্ভেয়ারের মধ্যে চারজন প্রতি মাসে সমুদ্রগামী জাহাজ ও অভ্যন্তরীণ নৌযানের ৬ শতাধিক নাবিকের বিভিন্ন গ্রেডের অফিসার, ইঞ্জিনিয়ার, মাস্টার ও ড্রাইভারদের পরীক্ষা কার্যক্রম চালানোর কাজে ন্যাস্ত। এদের কার্যক্রম মূলত চলছে উল্টো পথে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনায় নিবন্ধিত প্রায় ১১ হাজার অভ্যন্তরীণ নৌযানের ফিটনেস প্রদান কাজে রয়েছেন মাত্র ৪ ইঞ্জিনিয়ার সার্ভেয়ার। এ চার ইঞ্জিনিয়ার সার্ভেয়ার এত বিপুল সংখ্যক নৌযানের সনদে স্বাক্ষর দিচ্ছেন দিনরাতে অফিসে ঘরেও বাইরে। বিনিময়ে পাচ্ছেন মোটা অঙ্কের অর্থ। সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীকে দুদক নক্সা অনুমোদনের অনিয়মের কারণে যে গ্রেফতার করেছে জাহাজের ফিটনেস ও পরীক্ষা খাতে অনিয়মের বিষয়টি এখন আরও বহুগুণ বেশি। অপরদিকে, ৪০টি সমুদ্রগামী জাহাজ, ২শ’ ফিশিং ট্রলার, ৫ হাজার ফিশিং ও কার্গো বোট, ৩শ’ উপকূলীয় তেল, মালবাহী জাহাজে ফিটনেস প্রদানের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন নৌবাণিজ্য দফতরের দুই সার্ভেয়ার। এদের মধ্যে একজন আবার খ-কালীন। অভিযোগ রয়েছে, সংঘবদ্ধ একটি দালাল চক্রের সহযোগিতায় চট্টগ্রামের নৌবাণিজ্য দফতরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা দিনে ন্যূনতম পক্ষে ১০ থেকে ১৫টি ভুয়া সনদ ইস্যু করে থাকে। এ ধরনের ভুয়া সনদ নিয়ে সমুদ্র ও নৌপথে নৌযানসমূহ মাদক ও চোরাচালানের কাজে নিয়োজিত। আরও অভিযোগ রয়েছে, শুধু অনিয়মের কারণে পরীক্ষা কার্যক্রম ও ফিটনেস কার্যক্রমে বছরে ৮ কোটি টাকার রাজস্ব সরকারের হাতছাড়া হচ্ছে। পাশাপাশি দুর্নীতিবাজরা পকেটস্থ করছে কমপক্ষে ৫ কোটি টাকা। সূত্র আরও জানায়, নৌবাণিজ্য দফতর দুর্নীতির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে আছে। তথ্য জালিয়াতি করে পিএসসিকে (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) ধোকা দিয়ে সার্ভেয়ার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার ঘটনাও রয়েছে। এ ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষে শোকজের নোটিস প্রদানের রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু সুরাহার ঘটনাটি নেই। অপরদিকে, অস্তিত্বহীন নৌযান, নৌযান নিবন্ধন ও ফিটনেস প্রদান সুপারভিশন ছাড়াই অধিদফতরের নিবন্ধিত প্রায় ৩ শতাধিক কোস্টাল ট্যাঙ্কার, কার্গো ও ফিশিং ট্রলারের ডকিং সনদ প্রদান ও সুপারভিশন ফি আদায়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের দুর্নীতি রয়েছে। নৌবাণিজ্য দফতর নিবন্ধিত ৪০ সমুদ্রগামী জাহাজ, ৩শ’ কোস্টাল ও তেলবাহী জাহাজ, ১৫০ ট্রলার এবং ৫ হাজার ফিশিং ও কার্গো বোটে ফিটনেস প্রদানের ক্ষেত্রে মাত্র ২ জন সার্ভেয়ারের কার্যক্রমে বেহাল দুর্নীতি বিদ্যমান। সূত্র জানায়, গত ২০ জুলাই নৌ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুল কুদ্দুস খানের নেতৃত্বে একটি টিম নৌবাণিজ্য দফতরের অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তে নেমেছে। অধিদফতরের বিগত ৩ বছরের কার্যক্রম চিত্রে বেরিয়ে এসেছে মানবপাচারে অবৈধ অনাপত্তি সনদের বিষয় উদ্ঘাটনে ব্যর্থতা জিএমডিএসএস প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া, কর্মকর্তাদের ভ্রমণের নামে মোটা অঙ্কের অর্থের অপচয়ের বিষয়টি। অপরদিকে, নৌ শিক্ষা প্রশাসনেও দুর্নীতি ও অনিয়ম বিস্তৃত হয়ে আছে। যে কারণে নৌ শিক্ষা নীতি পুরোপুরি ধসে আছে। বিশ্বব্যাপী জাহাজে নাবিক অফিসার ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদার দিকে নজর না দিয়ে মেরিন একাডেমির পাশাপাশি ১৮টি বেসরকারী মেরিটাইম ইনস্টিটিউটকে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০১২-১৩ সালে দেয়া হয়েছে ১৪টি। অভিযোগ, এর নেপথ্যে রয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থের লেনদেন। মোটা অঙ্কের অর্থের চাকরির লোভ দেখিয়ে এসব একাডেমিতে প্রতিবছর শয়ে শয়ে ক্যাডেট ভর্তি করিয়ে সনদ প্রদান করা হচ্ছে। এসব বেসরকারী একাডেমিতে প্রতিটি ক্যাডেটকে ন্যূনতম পক্ষে ১৪ লাখ টাকা প্রদান করতে হয়। এসব ক্যাডেটদের জাহাজে চাকরি পাওয়ার সংখ্যা একেবারেই কম। অপরদিকে, সরকারী মেরিন একাডেমি ও ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের অবস্থারও অবনতি ঘটেছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী নাবিক ও ক্যাডেটদের চাহিদা নানা কারণে হ্রাস পাওয়ার পরও এ দুটি প্রতিষ্ঠান নিয়মের বাইরে ক্যাডেট ও নাবিক ভর্তি করায়। চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে ২০১২-২০১৬ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে পাস করা ক্যাডেট সংখ্যা ১৩ শতাধিক। এদের ৮৫০ জনেরও বেশি এখনও বেকার। আরও দুঃখজনক হলেও সত্য, মেরিন একাডেমিতে নারী ক্যাডেট ভর্তি করিয়ে তাদের অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ শিপিং অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩ অনুসারে, জাহাজে যোগদানের জন্য শুধু পুরুষ ক্যাডেটদের কথা বলা থাকলেও মেরিন একাডেমি তা মানছে না। ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট ও মাদারীপুর মেরিটাইম ইনস্টিটিউট থেকে গত ৫ বছরে পাস করা ৪৫০ নাবিকের মধ্যে ৩৭৫ জনই এখন বেকার। এ অবস্থায় ২০১৬, ২০১৭ ব্যাচে ১০০ নাবিক ভর্তির উদ্যোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বেসরকারী মেরিন একাডেমিগুলো ৫ বছরে তিন হাজার ক্যাডেটকে পাসের সনদ দিয়ে ৪শ’ কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়েছে। অপরদিকে, বেসরকারী একাডেমিগুলো থেকে পাস করা ২ সহস্রাধিক ক্যাডেট এখন বেকার। আর সরকারী মেরিন একাডেমি থেকে ৫ বছরে পাস করা ১ হাজার ৩০০ ক্যাডেটের মধ্যে ৮৫০ জন রয়েছে অনিশ্চিত বেকার জীবনে। সূত্র আরও জানায়, সরকারী মেরিন একাডেমিতে ৫০ জনের স্থলে সর্বোচ্চ ৩৭৫ জন ক্যাডেট ভর্তির রেকর্ড রয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশী ক্যাডেটদের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় গত বছর ৫০ ক্যাডেটের জন্য আবেদনপত্র পড়েছে মাত্র ৫৬। এর মূল কারণ ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকায়। সূত্র মতে, বর্তমানে বিদেশে আড়াই হাজারেরও বেশি অফিসার বিভিন্ন জাহাজে কর্মরত। আর নাবিক রয়েছে ১ হাজারেরও বেশি। কিন্তু দেশে সরকারী মালিকানার জাহাজ এখন আর নেই। বেসরকারী পর্যায়েও কমতে কমতে ২৫টিতে নেমে এসেছে। ফলে নৌ নাবিক, ক্যাডেট ও অফিসারদের চাকরির বাজার সঙ্কুচিত হয়ে আছে। আর বিদেশে সঙ্কুচিত হয়েছে যেনতেনভাবে ক্যাডেটদের সনদ প্রাপ্তির ঘটনা ও কর্মক্ষেত্রে অদক্ষতার বিষয়টি ধরা পড়ায়। সার্বিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে চাকরির এ খাতটি এখন বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ সৌদি আরব, ভারত, কুয়েত, সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশী নাবিক, ক্যাডেট ও অফিসারদের সাইন অব ও সাইন অন করার প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে সেসব দেশের সরকার। ফলে ফিলিপিন্স, মিয়ানমার ও ভারতের নাবিক, ক্যাডেট ও অফিসাররা চাকরির এসব স্থান দখলে নিয়েছে। সাইন অন ও সাইন অফের ক্ষেত্রে সেসব দেশে বাংলাদেশীদের জন্য ভিসা জটিলতা সৃষ্টি হয়ে আছে দীর্ঘদিন থেকে। বিভিন্ন পর্যায়ে নানাভাবে দেনদরবার করেও এ ব্যাপারে সুফলতা মিলছে না। ফলে প্রকৃত অর্থে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে যেসব ক্যাডেট সনদ পেয়েছে তারাও তাদের ভবিষ্যত নিয়ে বর্তমানে বড় ধরনের শঙ্কায় রয়েছেন।
×