ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে পংক্তিভোজ, কলাপাতায় খাওয়ার মজাই আলাদা

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ১৯ আগস্ট ২০১৭

হারিয়ে যাচ্ছে পংক্তিভোজ, কলাপাতায় খাওয়ার মজাই আলাদা

বিশ্বজিৎ মনি ॥॥ হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার কৃষ্টি চিরচেনা সেই পংক্তিভোজ। চেহলাম, আকিকা, বিয়ে বা হরিবাসরে আমন্ত্রিত লোকজনদের কলাপাতায় করে খাওয়ানোর রেওয়াজ সেই আদিকালের। লম্বা লাইন করে মাটিতে আসন পেতে বসিয়ে কলাপাতা বিছিয়ে খাবার পরিবেশন করার রীতি প্রচলিত ছিল। শুধু তাই নয়, কলাপাতার পাশাপাশি পদ্মপাতা বা শালপাতাতেও খাবার পরিবেশন করা হতো। কিন্তু পদ্মপাতা বা শালপাতা এখন আর মোটেও চোখে পড়েনা। এই পদ্মপাতা বা শালপাতায় খাবার পরিবেশনের রেওয়াজ কয়েক যুগ আগেই হারিয়ে গেছে। তবে গ্রামাঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এই কলাপাতায় খাবার পরিবেশনের রীতিটা কিছুটা হলেও চালু আছে। কিন্তু আগে যেমন মাটির গ্লাসে পানি দেয়া হতো, সেটি এখন একদমই নেই। বাড়ির আঙিনায়, খোলায় বা কোন মন্দির প্রাঙ্গণে লম্বা করে আসন পেতে আমন্ত্রিত লোকজনদের সেখানে সারিবদ্ধ করে বসিয়ে কলাপাতায় খাবার পরিবেশন করা হতো। কালের পরিবর্তনে এখন প্লাস্টিক, মেলামাইন, কাচ বা স্টিলের থালা-গ্লাসে পানি ও খাবার পরিবেশন করা হয়ে থাকে। তবে এ ব্যবস্থাও এখন পুরনো হয়ে গেছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন চলছে ‘ওয়ানটাইম গ্লাস-প্লেটে খাবার পরিবেশন। এর মাঝেও গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ও কৃষ্টি কলাপাতায় পংক্তিভোজ হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কদাচিত চোখে পড়ে। এদিকে দিনের পর দিন কলাগাছও হারিয়ে যাচ্ছে। যে সামান্য গাছ কদাচিত চোখে পড়ে, প্রাকৃতিক কারণে তার পাতাগুলোও ছিঁড়ে যায়। ফলে ভাল পাতাও মিলেনা। কলাপাতায় করে ভাত বা হরিবাসরের খিচুরি খাওয়া আজ যেন প্রবীণদের কাছে শুধুই স্মৃতি। কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রবীণরা এক জায়গায় মিলিত হলে শোনা যায় তাদের স্মৃতি রোমন্থনের কথা। নতুন প্রজন্মের কাছে এই পংক্তিভোজের কথাগুলো রসিয়ে রসিয়ে বলতে শোনা যায়। প্রবীণদের মতে, কলারপাতায় খাওয়ার মজাই আলাদা। নওগাঁ জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি নির্মল কৃষ্ণ সাহা জানান, কলাপাতায় খাবার পরিবেশন একটি কৃষ্টিমাত্র। এক্ষেত্রে ধর্মীয় কোন বাধ্যবাধকতা নেই। প্রাচীনকালে খাবার পাত্র অপ্রতুল থাকায় মানুষ প্রাকৃতিক বস্তু হিসেবে কলাপাতা, পদ্মপাতা, শালপাতা এবং মাটির গ্লাস অনুষ্ঠানে ব্যবহার করত। এই মাটির গ্লাস ব্যবহারের রেওয়াজটিও অনেক আগে হারিয়ে গেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পদ্মপাতা ও শালপাতার মতো কলাগাছও হারিয়ে যাচ্ছে। আগে বাড়ির আশে-পাশেই হাত বাড়ালেই কলাগাছের পাতা পাওয়া যেত। কিন্তু এখন আর তা পাওয়া যায়না। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেশি দামে কলাপাতা কিনতে হয়। যারা ডেকোরেটরের প্লেট-গ্লাস ব্যবহার করে, তাদেরও সেগুলো পরিস্কারের জন্য রীতিমত টাকা দিয়ে লোক রাখতে হয়। সবক্ষেত্রেই অর্থব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনা করে এই আধুনিক যুগে এসে মানুষ ওয়ানটাইম থালা-গ্লাস ব্যবহারের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তার পরেও গ্রামে-গঞ্জে দু’একটি পরিবার ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে এখনও সেই পুরনো কৃষ্টি ধরে রাখতে কলাপাতায় খাবার পরিবেশন করেন। তবে এই ডিজিটাল যুগে এসে ওয়ানটাইম প্লেট-গ্লাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কলাপাতায় খাবার পরিবেশনের পুরনো প্রচলনটি হয়তো অল্পদিনেই হারিয়ে যাবে।
×