ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাবনা-সিরাজগঞ্জে ২২ হাজার খামার

দুই লাখ কোরবানির পশু প্রস্তুত

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১৮ আগস্ট ২০১৭

দুই লাখ কোরবানির পশু প্রস্তুত

নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনা, ১৭ আগস্ট ॥ ঈদ-উল-আজহাকে সামনে রেখে পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে প্রায় দুই লাখ কোরবানির গরু প্রস্তুত করা হচ্ছে। এ অঞ্চলের গো-খামারি, চাষি ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজা করছে। খামারীরা মোটাতাজাকরণের বিশেষ পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত ইউরিয়া, লালিগুড় মাখানো খড় গরুকে খাওয়াচ্ছে। আবার কিছু অসাধু মৌসুমি ব্যবসায়ী অল্প সময়ে অধিক লাভের আশায় ক্ষতিকর হরমোন ইনজেকশন, স্টেরয়েড, ডেক্্রামেথাসন, ডেকাসনসহ বিভিন্ন ওষুধ ধাপে ধাপে গরুর দেহে প্রয়োগ করে মোটাতাজাকরণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এসব ওষুধ আর ইনজেকশনে মোটা হওয়া গরুর মাংস খাওয়ার ফলে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রকম দুরারোগ্য ব্যাধি। পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসসূত্রে জানা যায়, পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী জেলা দুটিতে তালিকাভুক্ত প্রায় ২২ হাজার গোখামার গড়ে উঠেছে। এছাড়া গ্রামগুলোর প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গবাদিপশু পালন করা হয়। এ অঞ্চলে গোখামারের পাশাপাশি প্রায় ২৭ হাজার মৌসুমি ব্যবসায়ী ও কৃষকের গোয়ালে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার প্রায় দুই লাখ গরু প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করা হচ্ছে। কোবানির ঈদ বাজারে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, মুন্সীগঞ্জ থেকে বেশি গরু সরবরাহ হয়ে থাকে। পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের খামারিরা ও চাষিরা জানান, হাট-বাজারে প্রকৃতিক নিয়মে মোটাতাজা গরুর মধ্যে রয়েছে, পাবনা ব্রিড, অস্ট্রেলিয়ান-ফ্রিজিয়ান ব্রিড, ইন্ডিয়ান হরিয়ান ব্রিড, পাকিস্তানী সাহিয়াল ব্রিড। পাশাপাশি রয়েছে স্থানীয় ব্রিডিং পদ্ধতি যা লোকাল ক্রস ব্রিড নামে পরিচিত গরু। এসব ব্রান্ডের সব গরুই মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়ায় বড় করে বাজারে তোলা হয়। গরু মোটাতাজাকরণ একটি নিয়মিত ও প্রচলিত পদ্ধতি। বিশেষ পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত ইউরিয়া, লালিগুড় ও খড়ের একটি বিশেষ মিকচার আট দিন কোন পাত্রে বন্ধ করে রেখে তা রোদে শুকিয়ে গরুকে খাওয়াতে হয়। তিন মাস এটা খাওয়ালে গরু খুব দ্রুত মোটাতাজা হয়ে ওঠে। এই গরুর মাংস মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। খামারি ও চাষিরা জানান, সাধারণত গরুকে প্রাকৃতিক পন্থায় মোটাতাজা ও সুস্থ রাখতে খড়, লালিগুড়, ভাতের মার, তাজা ঘাস, খৈল, গম, ছোলা, খেসারি, মাষকলাই ও মটরের ভুসিসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার দেয়া হয়। গরুর জন্য এটা বিজ্ঞনসম্মত। এ নিয়মে গরু মোটাতাজা করা হলে ক্রেতা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন না। এ ধরনের গরুর মাংস খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। প্রাকৃতিক উপায়ে মোটাতাজা গরুর চাহিদা ও দাম ভাল পাওয়া যায়। খামারিরা জানান, এ অঞ্চলের কিছু কিছু অসাধু মৌসুমি ব্যবসায়ী গরুকে মোটাতাজা করতে ব্যবহার করছে নানা রকম ওষুধ। তারা রোজার ঈদের পর থেকেই কোরবানির বাজার ধরার টার্গেট নিয়ে বাছুর, দুর্বল ও রোগাক্রান্ত গরু অল্প টাকায় কিনে থাকেন। এরপর ধাপে ধাপে গরুর দেহে প্রয়োগ করা হয় চোরাপথে আসা ভারতীয় ডেক্্িরন, স্টেরয়েড, হরমোন, উচ্চমাত্রার রাসায়নিক। এসব ওষুধ বিভিন্ন ফার্মেসিসহ গবাদিপশু চিকিৎসালয়ে পাওয়া যায়। ফার্মেসি ব্যবসায়ীরা সহজেই এসব ওষুধ গরু ব্যসায়ীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। ইনজেকশনের পাশাপাশি চরাঞ্চলের কৃষকদের কাছে ‘বালতি’ হিসেবে পরিচিত নোভারটিস কোম্পানির মেগভিট ডিভি পাউডারের কদর বেশি। ভূসি ও খৈলের সঙ্গে মিশিয়ে এই পাউডার প্রতিদিন খায়ানো হয়। এতে অল্প দিনের মধ্যে গরুর শরীর ফুলেফেঁপে মোটা হয়ে যায়। এই গরু দেখতে সুন্দর হয়। এ বছর পাবনা-সিরাজগঞ্জে কৃত্রিম পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজাকরণের হার অনেক কমে গেছে। সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামের খামারি আব্দুল জব্বার জানান, তিনি গত বছর প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ১০টি গরু মোটাতাজা করে ঈদের আগে বিক্রি করে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা লাভ করেন। এবছর তিনি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ২৫টি গরু মোটাতাজা করছেন। প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, খামারি ও ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে বর্তমানে কোরবানির উপয়োগী গরু আছে ৪০ লাখ, মহিষ ১৫ লাখ আর ছাগল- ভেড়া আছে প্রায় ৭৬ লাখ, যা দেশের মোট চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। তবে চাহিদার তুলনায় দেশের যোগানস্বল্পতা রয়েছে উল্লেখ করে ব্যবসায়ীদের ভারত থেকে গরু আমদানির অনুমতি দিয়েছে বর্ডার গার্ড। এতে লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন দেশী খামারি ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। বিশেষজ্ঞের মতে, পাম, ডেক্্রামেথাসন ও স্টেরয়েড ট্যাবলেট খাওয়ানোর পর গরুর চামড়ার ভেতরে বাড়তি পানির স্তর জমে গরুকে বেশি মোটাতাজা ও সবল দেখায়। এতে কমে যায় গরুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। পাম বড়িতে ক্ষতিকর স্টেরয়েড থাকে। স্টেরয়েড গরুর দেহে মারাত্মক বিষ ছড়িয়ে দেয়। এতে গরুর লিভার নষ্ট হয়ে যায়। স্টেরয়েড মিশ্রিত গরুর মাংস মানব শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এটি এমন পদার্থ যা মাত্রাতিরিক্ত তাপে ধ্বংস হয় না। ইনজেকশন বা ওষুধ দিয়ে দ্রুত মোটাতাজা করা গরুর গায়ে শক্তি থাকে না, মাদকাসক্ত মানুষের মতো ঝিমায়। অনেক সময় মানুষের মতো স্ট্রোক করে মারা যায় এসব গরু। বিগত দু’বছর এ অঞ্চলের খামারি ও চাষিরা কৃত্রিম পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজা করে বাজারে বিক্রি করতে না পেরে লোকসান দিয়েছেন। ফলে এ বছর পাবনা-সিরাজগঞ্জের শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ খামারি ও চাষি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজা করছেন বলে তারা জানিয়েছেন। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ মোঃ আব্দুল বাসেত খান জানান, প্রাকৃতিক উপায়ে মোটাতাজা গরুর মাংস খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। গরুকে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খাওয়ালে তা যেমন গরুর জন্য ক্ষতিকর তেমনি ওই গরুর মাংস বিষাক্ত হয়ে পড়ে। এই মাংস ফরমালিনের মতো মানুষকে ধীরে ধীরে নিস্তেজ করে ফেলে। এতে মানুষ লিভার, কিডনি, হৃদযন্ত্র, পুরুষত্ব ও মাতৃত্বহীনতাসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
×