ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হজ সম্পৃক্ত স্থানসমূহ

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ১৮ আগস্ট ২০১৭

হজ সম্পৃক্ত স্থানসমূহ

(গত শুক্রবারের পর) আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু হযরত আদমকে (আ) সস্ত্রীক জান্নাতে থাকবার নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ করলেন : ইয়া আদামুসকুন আন্তা ওয়া যাওজুকাল্ জান্নাতা ওয়া কুলা মিন্হা রাগাদান্ হায়ছু শি’তুমা ওয়ালা তাকরাবা হাযিহিশ্্ শাজারাতা ফাতাকুনা মিনাজ জলেমীন হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর এবং যেখানে ইচ্ছে স্বচ্ছন্দে আহার-বিহার কর কিন্তু এই গাছটির কাছে যেও না, যদি যাও তাহলে তোমরা অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। (সূরা বাকারা : আয়াত ৩৫)। কিন্তু শয়তান তাদেরকে বিভ্রমে ফেলে ওই নিষিদ্ধ গাছের কাছে নিয়ে গেল, ফলে তাদেরকে পৃথিবীতে অবতরণ করানো হলো। হযরত আদম (আ) বর্তমানে শ্রীলঙ্কার একটি পাহাড় চূড়ায় এবং হযরত হাওয়া (আ) জেদ্দায় অবতরণ করলেন। প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছর ধরে তওবা-ইস্তিগ্ফার করায় হযরত মুহম্মদ (সা)-এর উসিলায় আল্লাহ্ তাঁদের তওবা কবুল করলেন। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর তাঁরা মিলিত হলেন যে স্থানটিতে সেই স্থানটির নামকরণ হয় আরাফাত। আরাফাত অর্থ পরিচিত হওয়া। তারপর তাঁরা সেখানটিতে এসে রাত্রি যাপন করেন সেই স্থানটির নামকরণ হয় মুয্দালিফা। এর অর্থ একান্ত সান্নিধ্য বা নিকট থেকে নিকটতর হওয়া। সকাল বেলা তাঁরা মিনা হয়ে যে পাহাড়বেষ্টিত সমতল ভূমিতে এসে উপনীত হন এবং বসত স্থাপন করেন সেই স্থানটির নাম বাক্কা- যা মক্কা নামে পরিচত হয় পরবর্তীকালে। এখানে আদম (আ) সপ্ত আসমানে অবস্থিত ফেরেশ্তাদের কা’বা বায়তুল মামুরের মতো একটি ইবাদত গৃহ নির্মাণের জন্য আল্লাহ জাল্লা শানুহুর নিকট দোয়া করলে আল্লাহ বায়তুল মামুরের বরাবর নিচে ফেরেশ্তাদের দ্বারা একটি গৃহের ভিত্তি স্থাপন করিয়ে দেন এবং সেই গৃহের দেয়ালের এক কোণে জান্নাতী একটি পাথর স্থাপন করা হয়। সেই গৃহই কা’বা গৃহ আর সেই পাথরই হাজরে আসওয়াদ। এই গৃহ সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই মানব জাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ (ইবাদত গাহ্) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো বাক্কায় (মক্কায়), তা বরকতময় ও বিশ্ব জগতের জন্য দিশারী। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৯৬)। হযরত নুহ আলায়হিস্ সালামের সময় ঘটে যাওয়া মহাপ্লাবনে এই গৃহ ধসে পড়ে এবং দীর্ঘকাল এই স্থান বিরান অবস্থায় থাকে। হযরত আদম (আ)-এর বংশধররা পৃথিবীর নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। বহু বছর পর নিঃসন্তান হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজিরার গর্ভে একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে যাঁর নাম রাখা হয় ইসমাঈল। আল্লাহর হুকুমে হযরত ইব্রাহীম (আ) ৮৬ বছর বয়সে আল্লাহর রহমতে প্রাপ্ত শিশুপুত্র ইসমাঈলকে ও স্ত্রী হাজিরাকে কয়েকদিনের খাবার ও পানি দিয়ে মক্কার এই বিরান স্থানে রেখে আসেন ফিলিস্তিনের কানআন থেকে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে। তিনি দোয়া করেছিলেন : হে আমার রব্! এই নগরীকে (মক্কা) নিরাপদ রেখ এবং আমাকে ও আমার বংশগণকে প্রতিমা পূজা থেকে দূরে রেখ। (সূরা ইব্রাহীম : আয়াত ৩৫), হে আমার রব! আমি আমার বংশধরদের কতককে বসবাস করালাম অনুর্বর উপত্যকায় তোমার গৃহের নিকট। (সূরা ইব্রাহীম : আয়াত ৩৭) কয়েক দিনের মধ্যে খাবার-দাবার ও পানি ফুরিয়ে গেলে পানির জন্য সমতলভূমিতে শিশু ইসমাঈলকে রেখে মা হাজিরা পাগলিনীর মতো সাফা-মারওয়া পাহাড়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন আর সন্তানের দিকে তাকাতে থাকেন, হঠাৎ দেখতে পান শিশু ইসমাঈলের পায়ের কাছে ঝিরঝির করে পানি বের হচ্ছে তিনি ছুটে এসে সেই পানির উৎসের চারদিক পাথর দিয়ে বেঁধে দিলেন। আস্তে আস্তে সেখানে একটি কূপের সৃষ্টি হলো যার নাম যমযম- অফুরন্ত পানি। বেশ কয়েক বছর পর হযরত ইব্রাহীম (আ) স্বপ্নে একদিন তাঁর পার্থিব সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবানি করার জন্য আদিষ্ট হয়ে প্রিয়তম পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। পুত্রকে তিনি স্বপ্নের কথা বললে পুত্র ইসমাঈল বললেন : আব্বা, আপনি আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করুন, আমাকে ইনশাআল্লাহ্ আপনি ধৈর্যশীল পাবেন। পুত্রকে তিনি সঙ্গে নিয়ে মক্কার অদূরে মিনা স্থানে পৌঁছলেই শয়তান তিনটি স্থানে তাঁদের আল্লাহর এই হুকুম পালন করা থেকে নিবৃত্ত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করলে তাঁরা পাথর তুলে শয়তানকে মারলেন এই বলে : দূর হ শয়তান, আল্লাহর সন্তুষ্টিই আমাদের কাম্য। তারপর মিনার একটি স্থানে পুত্র ইসমাঈলকে কাত করে শুইয়ে দিয়ে তাঁর গলায় ছুরি চালালে আল্লাহর তরফ থেকে তা করতে নিষেধ করা হলো এবং এটা যে পরীক্ষা ছিল ইব্রাহীমের জন্য তা ঘোষিত হলো। পুত্রের বদলে একটি দুম্বা কোরবানি দেয়ার নির্দেশ এলো। হযরত ইব্রাহীম (আ) তাই করলেন। সেই কোরবানি দেয়ার রীতি এখনও চালু আছে। লক্ষ্য করা যায় হজের বিধানগুলো পালিত হয় নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট নিয়মে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামকে নির্দেশ দেন তাঁর গৃহ বা কা’বা ঘর পুনর্নির্মাণের জন্য। কিন্তু সেই গৃহের ভিত্তি যে যমযমের অতি নিকটে তা তাঁর জানা ছিল না। ফেরেশ্তা জিব্রাঈল এসে তা দেখিয়ে দেন এবং এক খ- মেঘ তার ওপর ছায়াপাত করে। হযরত ইব্রাহীম সেই স্থান খুঁড়ে ভিত পেয়ে যান, সেই ভিতের ওপর তিনি তঁাঁর পুত্র ইসমাঈলের সহযোগিতায় কা’বা শরীফের দেয়াল তোলেন। যে পাথরের ওপর দঁাঁড়িয়ে তিনি এই দেয়াল তোলেন সেই পাথরে তঁাঁর পায়ের চিহ্ন গভীর হয়ে পড়ে যায়। সেই পায়ের চিহ্নের পাথরখানি আজও কা’বা শরীফের পাশে রক্ষিত আছে, যাকে মাকামে ইব্রাহীম বলা হয়। কা’বা ঘর পুনরায় নির্মিত হয়ে গেলে আল্লাহ্ হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামকে এখানে এসে হজ করার ঘোষণা করতে নির্দেশ দেন। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী হযরত ইব্রাহীম (আ) হজের ঘোষণা দেন আবু কুবায়স পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে। তারপর থেকে জিলহজের নির্দিষ্ট তারিখগুলোতে হজ পালিত হতে থাকে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ইব্রাহীম ও ইসমাঈল বায়তুল্লাহর দেয়াল তোলার সময় বলেছিল : হে আমাদের রব! আমাদের এই কাজ কবুল কর নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞাতা। (সূরা বাকারা : আয়াত ১২৭)। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি যখন কা’বা ঘরকে মানব জাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম তখন বলেছিলাম : তোমরা মাকামে ইব্রাহীমকে সালাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ কর এবং ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে তওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকু ও সিজ্দাকারীদের জন্য আমার গৃহকে পবিত্র রাখতে আদেশ দিয়েছিলাম। (সূরা বাকারা : আয়াত ১২৫)। হজের ঘোষণা দেয়ার হুকুম প্রসঙ্গ এনে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : মানুষের নিকট হজের ঘোষণা দিয়ে দাও, ওরা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটের পিঠে, ওরা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে। (সূরা হজ : আয়াত ২৭)। (সমাপ্ত) লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা)
×