ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধারাবাহিক উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৮ আগস্ট ২০১৭

ধারাবাহিক উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

দিল পসন্দের যুদ্ধ প্রস্তুতি আগ্রায় নানা ধরনের গুঞ্জন ভেসে আসছে। লোকজন বলাবলি করছে শাহজাদা আওরঙ্গজেব বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে মুরাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। কেউ বলছে গোপনে শাহ সুজাকে ক্ষমা করে বাংলা বিহার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন কান কথায় বিরক্ত বোধ করলেন শাহজাদা দারা। আসল মুঘল উত্তরসূরি তো তিনি। প্রজাদের মনোবল ঠিক রাখতে ও নিজের নির্বাহী ক্ষমতার প্রমাণ দিতে দারা আদেশ দিলেন হাতির লড়াইয়ের আয়োজন করতে। একমাত্র স্বয়ং মুঘল বাদশাহ পারেন এই রাজকীয় প্রতিযোগিতাটির আদেশ দিতে। কিন্তু সম্রাট শাহজাহান দারা’কে একই ক্ষমতা অর্পণ করেছিলেন রোগ শয্যায় থাকার সময়। শীতের আমেজ কেটে গরমের প্রকোপ বেড়েছে। এপ্রিল মাসে দুপুরের রোদ বেশ কড়া থাকে। রোদের তেজ কমলে বিকেলে দারা প্রিয় ঘোড়া দিল পসন্দে সওয়ার হয়ে সভাসদদের নিয়ে জাঁমকপূর্ণভাবে যমুনার পাড়ে উপস্থিত হলেন। দিল পসন্দ দারার সবচেয়ে প্রিয় ঘোড়া। সাদা-কালোর মিশ্রণে অপূর্ব বলিষ্ঠ আরবী ঘোড়াটি তার প্রভুর সান্নিধ্যে এলেই কেশর ফুলিয়ে দুই পা উঁচু করে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকে। ঘোড়াটির লাফিয়ে উঠে আনন্দ প্রকাশ করা দেখে শাহজাদা দারা এর নাম দিয়েছিলেন দিল পসন্দ বা অন্তরের আনন্দ। শুধু তাই নয়, ওস্তাদ শিল্পী দিয়ে প্রিয় ঘোড়ার ছবি আঁকিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছেন। দরবারের বিবি-বাঈজীদেরও সেই সৌভাগ্য হয়নি। হাতির লড়াইয়ে আরও উপস্থিত করা হলো সম্রাট শাহজাহানের প্রিয় হাতি খালিকদাদকে। কোন উন্মত্ত বা হিংস্র হাতিকে বাগে আনতে খালিকদাদের বিকল্প নেই। খালিকদাদের বিশ্রামের জন্য আলাদা তাঁবু টাঙ্গানো হয়েছে। হাতিটির সারা শরীর ঢাকা আছে রঙিন মখমল আর জরির পোশাকে। কপাল আর শুঁড়ে জড়ানো হয়েছে মূল্যবান মণি-মানিক্য। যেন সম্রাটের সাক্ষাৎ প্রতিনিধি। হাতির লড়াই দেখতে পুরো আগ্রা ছাড়িয়ে আশপাশের ফতেহপুর সিক্রি, মথুরা, বৃন্দাবন থেকে জনতার ঢল নেমেছে। যমুনার দুই পাড় লোকে লোকারণ্য। দিল পসন্দের পিঠে বসে প্রাণীটির অস্থিরতা টের পান দারা। হাতির লড়াইয়ের উত্তেজনা নয়, আসন্ন যুদ্ধের গন্ধ যেন নাকে লেগেছে ঘোড়াটির। জয়ঢাক ও রাজকীয় সানাই-এর আওয়াজ ছাপিয়ে জনতার উল্লাস মাখা চিৎকারে সম্রাট শাহজাহানের দিবা নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটল। -পুত্র আমার আজকেই হাতির লড়াই শুরু করে দিল? ধর্মাতে যুদ্ধ জয়ের কোন সংবাদ আসা পর্যন্ত তর সইলো না? মনে মনে বিড়বিড় করলেন বৃদ্ধ সম্রাট। আগ্রায় দারা যখন হাতির লড়াই নিয়ে প্রজাদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত তখন ধর্মাতপুরে মহারাজ যশোবন্ত সিং মুখোমুখি হয়েছেন এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। দুই শাহজাদাকে যার যার এলাকায় ফিরে যেতে অনুরোধ করে একটি ব্যক্তিগত চিঠি পাঠিয়েছিলেন কিছুদিন আগে। তিনি লিখেছিলেন, “মহামান্য, আমি আপনাদের সেবাদাস এই চিঠি লিখে মূল্যবান সময়ক্ষেপণ করছি। কিন্তু হিন্দুস্তানের অভিভাবক মহামান্য বাদশাহের নির্দেশ মোতাবেক আপনাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ সৈন্য সামন্ত নিয়ে নিজ প্রদেশে ফিরে গিয়ে পূর্বের ন্যায় রাজকীয় সুবিধাদি উপভোগ করতে থাকুন। আমাকে ভুল বুঝবেন না, কারণ আমি জীবনের মূল্যবান পঁয়ত্রিশটি বছর তৈমুরের বংশধরদের সেবা ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে হেরাতের বরফ আচ্ছাদিত পর্বত হতে বাংলার গহীন জঙ্গলে যুদ্ধ করে তৈমুরের বংশধরদের সুরক্ষা করে এসেছি। আজ জীবনের অন্তিম মুহূর্তে কোনভাবেই কামনা করি না যে আমি মহান তৈমুরের বংশধরদের জীবন রক্ষা করে এসেছি তাদেরই কারও রক্তে আমার তরবারী রঞ্জিত হোক। বরং আমি চাই, বাকি জীবন চন্দ্র-সূর্যকে সাক্ষী রেখে তৈমুরের বংশধরদের সেবা করে কাটিয়ে দিতে ...।” চিঠি পড়ে আওরঙ্গজেবের ঠোঁটে স্বস্তির হাসি ফুটে উঠলো। যা বোঝার তিনি বুঝে গেছেন। যতটা মূর্খ মনে করেছিলেন অভিজ্ঞ রাজপুত ততটা নন। মহারাজ যশোবন্ত সিং এই অভিযান নিয়ে আক্ষরিক অর্থে দ্বিধায় আছেন তাও টের পেলেন আওরঙ্গজেব। গুপ্তচর মারফত গোপন চিঠিতে আরও জানতে পেরেছেন আসন্ন যুদ্ধে সম্রাটের সেনাপতি কাশিম খান নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখবেন। এখন রাজপুত যোদ্ধাদের মনোবল ভেঙ্গে দিতে পারলে যথেষ্ট। দেরি না করে আওরঙ্গজেব লিখলেন, ‘মহারাজা সাহেব, হিন্দুস্তানের মহান সম্রাট অসুস্থ পিতাকে দর্শনের জন্য এতদূর চলে এসেছি আমরা, কিন্তু কেন আপনি আমাদের পিতা-পুত্রের পবিত্র মিলনে বাধা দিতে চাচ্ছেন? আমি জানি আপনাদের রাঠোর শরীরে রাজপুতদের বিশ্বস্ততার রক্ত বইছে। আমরা সবাই জানি তৈমুরের বংশধরদের জন্য সারা জীবন আপনি ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং আপনি কোনভাবেই আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে চান না বলেছেন। আপনার কথাটি আমার মনে ধরেছে। এখনও সময় আছে আমার পাঠানো ব্যক্তি নজবত খানের সঙ্গে চলে আসুন। তারপর আমার পুত্র মোহাম্মদ সুলতানের কাছে আত্মসমর্পণ করুন। সে আপনাকে সরাসরি আমার কাছে নিয়ে আসবে। এই অভিযানে আসার জন্য আমার কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। কথা দিচ্ছি আপনাকে ক্ষমা করে ভবিষ্যতে আমাদের বংশের সেবা অব্যাহত রাখার সর্বোচ্চ সুযোগ করে দেব...।’ আওরঙ্গজেবের এমন জবাবে মহারাজ যশোবন্ত সিং-এর আত্মসম্মানে সাংঘাতিক ধাক্কা লাগল। এটা তো সরাসরি হুমকি প্রদান! সম্রাট শাহজাহান ছাড়া কারও নিমক তিনি আর খেতে চান না। যথেষ্ট হয়েছে। যদি তিনি যুদ্ধে ফয়সালা চান তবে তাই হোক। জরুরী ভিত্তিতে যশোবন্ত সিং তাঁবুতে ডেকে পাঠালেন বিভিন্ন গোত্রের রাজপুত সেনাপতিদের। একে একে জড়ো হলেন রাজা রাই সিং, মুকুন্দ সিং হাদা, রতন সিং রাঠোর, দয়াল সিং ঝালা, অর্জুন সিং গৌড়, অমর সিং চন্দ্রবত, দেবী সিং বুন্দেলা, সুজন সিং শিশোদিয়া’ প্রমুখ রাজপুত যোদ্ধা। আওরঙ্গজেবের পাঠানো চিঠির জবাব শুনে সবার আগে উঠে দাঁড়িয়ে কথা বলার অনুমতি চাইলেন রাজা রতন সিং রাঠোর। -মহামান্য মহারাজ, পরিস্থিতি যতটা সহজ মনে করছেন তার চেয়েও বেশি ঘোলাটে। আমাদের সেনা মোতায়েনে অনেক ফাঁক আছে। জলা-জঙ্গল সামনে রেখে এভাবে শত্রুর মুখোমুখি হওয়া ঠিক হয়নি। - দুশ্চিন্তা করবেন না। জ্যোতিষি’র সঙ্গে আলাপ করেছি। এখন থেকে ঠিক চারদিন পর যুদ্ধযাত্রা করলে আমাদের বিজয় নিশ্চিত। এমন পরিস্থিতিতে আমরাও ইতোপূর্বেও যুদ্ধ জয় করেছিলাম। গঙ্গার পাড়ে একই রকম নদীবেষ্টিত এলাকায় যুদ্ধ কি আগেও করিনি? যশোবন্ত মনে করিয়ে দিলেন। - কিন্তু সেটা ছিল দুর্বল শত্রু বাহিনীর বিপক্ষে। আওরঙ্গজেব আর মুরাদের সম্মিলিত বাহিনী চল্লিশ হাজারেরও বেশি ও সবাই সুশিক্ষিত যোদ্ধা। ওদের পক্ষে আছে মুর্শিদ কুলি খানের মতো কাবিল গোলন্দাজ সেনাপতি। তা ছাড়া ভাড়াটে ইংরেজ ও ফরাসী গোলন্দাজ সৈন্য রয়েছে। বিনিময়ে আমাদের অনুগত রাজপুত বাহিনীর অশ্বারোহীরাই একমাত্র ভরসা। -একমাত্র বলছেন কেন? -আমি ব্যাখ্যা করছি মহারাজ। পাশ থেকে বললেন অমর সিং। -কি সেটা যেটা আমি এখনও জানি না? অবাক হলেন যশোবন্ত। -খবর পেয়েছি সেনাপতি কাশিম খান হাত মিলিয়েছেন আওরঙ্গজেবের সঙ্গে। -আর সেনাপতি ইফতিখার খান? -তিনি এই গোপন সংবাদটি দিয়েছেন আমাদের। ইফতিখার খান আমৃত্যু সম্রাটের পক্ষে থাকবেন বলে ওয়াদা করেছেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের যুদ্ধের ছক অন্য ভাবে সাজাতে হবে। ধরেই নিতে হবে কাশিম খানের সৈন্য দল আমাদের কোন কাজে আসবে না। -তার মানে আপনারা বলতে চাইছেন যুদ্ধ হবে মূলত বিদ্রোহী শাহজাদার গোলন্দাজ বাহিনী বনাম রাজপুত সেনাদের অশ্বারোহী বাহিনীর সঙ্গে? -অনেকটা তাই মহারাজ। ইতোমধ্যে বিদ্রোহী বাহিনী পরিখা খনন করে আমাদের অশ্বারোহী বাহিনীর গতিরোধের পরিকল্পনা করছে। অমর সিং মাথা নাড়ালেন। -তবে তাই হোক। যুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্র মুঘলদের যুদ্ধ কায়দায় আমাদের অশ্বারোহী বাহিনী দুই পাশ থেকে অর্ধ চন্দ্রাকারে গোলন্দাজ বাহিনীকে ঘিরে রেখে প্রথম আক্রমণ চালাবে। তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারলে বাকি পদাতিক তীরন্দাজ সৈন্যদের তাড়িয়ে নদীর দিকে নিয়ে যেতে পারবো। -মুরাদের সৈন্যদল যদি আলাদাভাবে আক্রমণ করে? জানতে চাইলেন রাঠোর সিং। -ঐ বেয়াদব শাহজাদাকে আমি নিজ হাতে সামলাবো। দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিজ্ঞা করলেন যশোবন্ত সিং। ১৪ এপ্রিল আওরঙ্গজেব ও মুরাদের বাহিনী মিলিত হলেন দিপালপুরে। যুদ্ধ অনিবার্য। আশপাশের স্থানীয় গ্রামবাসীরা দুই পক্ষের হাজারো সৈন্য সামন্ত আর গোলা-বারুদের বহর দেখে এলাকা ছেড়ে নিরাপদে পালাতে শুরু করেছে। আকাশে এখন মৌসুমী মেঘের ঘনঘটা। চম্বল নদী তীরে ও জঙ্গলে ময়ূরের দল বিক্ষিপ্তভাবে পেখম মেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আসন্ন যুদ্ধ নিয়ে পাখিগুলোর কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই। (চলবে)
×