ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সম্প্রতি থিয়েটার নাট্যদলের দলীয় প্রকাশনা কার্যক্রমের গবেষণা করতে ঢাকায় এসেছিলেন নাট্যসমালোচক-গবেষক-প্রাবন্ধিক ও লেখক ড. আশিষ গোস্বামী। গবেষণা কার্যক্রম, দুই বাংলার নাট্যচর্চা, নাট্য সমালোচনার প্রসঙ্গ, তাপস সেন উৎপল দত্ত স্মরণ প্রভৃতি বিষয়ে একান্তে কথা বল

উৎপল দত্ত একরকম সন্তান জ্ঞানই করতেন আমায় ॥ আশিষ গোস্বামী

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৮ আগস্ট ২০১৭

উৎপল দত্ত একরকম সন্তান জ্ঞানই করতেন আমায় ॥ আশিষ গোস্বামী

আপনি তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা নাট্য সমালোচনার ইতিহাস বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেছেন। এ নিয়ে কিছু বলুন। দেখুন বাংলার ছাত্র হিসেবে আমি যেমন সাহিত্য অনুরাগী তেমনই তাপস সেন উৎপল দত্তের স্নেহ ছায়া পেয়ে আমি গভীরভাবে নাট্যানুরাগী। নাটকের অনুরাগী হিসেবে নাটকটাকে সব সময় চেয়েছি বিচারের কষ্টিপাথরে ঘষে দেখতে। সেই দেখতে চাওয়ার পথ পরিভ্রমণে কখন যেন সকলের কাছে পরিচিতি পেলাম নাট্য সমালোচক হিসেবে। অভিজ্ঞতার আলোকে বুঝেছি, নাট্য সমালোচক মূলত দুটি কাজ করে থাকেন। প্রথমত, নাট্য প্রযোজনার মাহাত্ম্য তিনি সকলকে অবগত করতে চান। দ্বিতীয়ত, প্রযোজনার ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে শোধরানোর পথ খুঁজে দেখতে চান। এবার আমি বাংলার নাট্য সমালোচনার ইতিহাস বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দুটি বিষয়ে নিমগ্ন হলাম। প্রথমটি হলো, সত্যিই নাট্য প্রযোজনার প্রকৃত সমালোচনা হয়েছে কিনা। দ্বিতীয়ত, এই সমালোচনার কোন ধারাবাহিকতা গড়ে উঠেছে কিনা। আর এই কাজটি করতে গিয়ে আমি ভারতের গণনাট্য সংঘ প্রতিষ্ঠার সময় থেকে শুরু করে ২০০০ সাল অবদি সময় কালকে বিবেচনায় নিয়েছি। এই চলতি সময়ের মাঝেই তো আপনি পেলেন তাপস সেনকে এবং উৎপল দত্তের মতো মানুষদের সান্নিধ্য। হ্যাঁ আমি সৌভাগ্যবান, আমার জন্য গৌরবের যে তাপস সেন এবং উৎপল দত্ত এক রকম সন্তান জ্ঞানই করতেন আমায়। তাদের কাজ করার ধরন, কাজের বৈশিষ্ট্য ভুলবার নয়। আমার মনে হয় বলব না বরং বলব শম্ভু মিত্রের নির্দেশিত নাটকের অনেকটা অসম্পূর্ণ থাকত যদি না মঞ্চ নির্মাণে খালেদ চৌধুরী থাকতেন। একইভাবে উৎপল দত্ত নির্দেশিত নাটকের অনেকটা অসম্পূর্ণ থাকত যদি না আলোক সৃজনে তাপস সেন থাকতেন। এই নেপথ্যের মানুষ তাপস সেন প্রসঙ্গে আমি একটা নেপথ্যের কথা এখানে বলে রাখি। তখন আমি নাট্য সংশ্লিষ্ট মানুষের ধারাবাহিক সাক্ষাতকার নিতাম। সাক্ষাতদাতার কথা রেকর্ড রাখার জন্য বিশাল সাইজের এক টেপ রেকর্ডার যা প্রায় তখনকার দিনে আমার ওজনের সমান তা নিয়ে ঘুরতাম। ঘুরতাম তো ঘুরতাম তাতে খুব যে কারও হেলদোল দেখতাম তা কিন্তু নয়। কিন্তু একদিন কি হলো, তাপস সেন আমায় খবর পাঠালেন যেন আমি তার সঙ্গে শীঘ্রই দেখা করি। দেখা করলে বিস্ময়, এক হাজার টাকার একটা চেক হাতে তুলে দিয়ে বললেন, সর্বাধুনিক ছোট টেপ রেকর্ডার এই টাকায় তুমি কিনতে পারবে। তোমার কাজের জন্যেই সেটা দরকার। কিনে নাও। আমি আর কি বলব, ভেতর থেকে একটা কান্না এসেছিল সেদিন। আজও তা ভুলিনি। ভোলেন নি বলেই তো ‘আলোর ছায়া পথ’ লিখলেন। লিখলাম আলোর ছায়া পথ। দীর্ঘদিন তাপস সেনের আলোর কাজ করা যেমন দেখেছি, তার ব্যক্তি জীবন দেখেছি আবার তার দর্শনও জেনেছি। সে সবই কাছ থেকে দেখে, হৃদয় দিয়ে আত্মস্থ করে, তারই আত্মজীবনীর আদলে আমার লেখা বই আলোর ছায়াপথ। নাটকের নেপথ্যের মানুষকে জানা ও জানানোর তীব্রতায় এই লেখা। পরবর্তীতে উৎপল দত্ত, বিভাস চক্রবর্তী, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের মতো ব্যক্তি যারা সরাসরি তাপস সেনের সঙ্গে কাজ করেছেন তাদের অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে লিখেছি সুজনেষু তাপস সেন। মঞ্চ ও আবহের রূপকার খালেদ চৌধুরীকে নিয়ে একই আঙ্গিকে লিখছি সুজনেষু খালেদ চৌধুরী। শম্ভু মিত্রকে নিয়েও লিখছি যা আশা করছি ফেব্রুয়ারির বইমেলায় আসবে। আমার সব সময় মনে হয়েছে, জীবন্ত অনুভূতি দেয় যে মঞ্চনাটক তার ডকুমেন্টেশন রাখাটাও ইতিহাসের স্বার্থেও জরুরী। আমিতো ভাবতেই পারি না, বাংলা নাটকের ইতিহাস তাপস সেন কিংবা খালেদ চৌধুরীর প্রসঙ্গ ছাড়া লিখিত হতে পারে বা হবে। এ কারণেই কি আপনাকে রতন থিয়ামের এত পছন্দ। আরও অনেকের মতো তাকেও আমার বিশেষ পছন্দ। তার প্রোডাকশন শুধু সর্ব ভারতীয় পর্যায়েই নয় বরং উপমহাদেশ জুড়ে আলোচিত ও আদৃত। ফলে তার কাজের ডকুমেন্টেশন এবং কাজের আলোচনা বই আকারে ধরা থাকুক যা সমকালের পাঠক অনুরাগীদের চাহিদা মিটিয়েও ভবিষ্যত গবেষকদের গবেষণায় সহযোগিতা করবে। আর এ কাজটি করানোর ক্ষেত্রে তার পছন্দ কাজটি যেন আমি করি। আপনিতো বিকল্প নাট্যচর্চা নিয়েও কাজ করছেন। হ্যাঁ করেছি। থিয়েটার যেহেতু ব্যয়বহুল ফলে সব সময় ব্যয় ভার বহন করে থিয়েটার চর্চা সেভাবে করা যায় না। ফলে ১৯৬৯ সাল থেকে বাংলায় বাদল সরকার, বাংলার বাইরে কানাইলাল স্বল্প ব্যয়ে, সহজ পরিবহনে, স্বল্প আয়োজনে যে নাট্যচর্চা শুরু করল তা প্রবল বেগে সর্বভারতে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু সেই চর্চার তেমন কোন গ্রন্থ আমাদের নজরে এলো না। ফলে এই কাজটা আমাকে শুরু করতেই হতো এবং আমি তা শুরু করলামও। বাংলাদেশে মুক্ত নাটক চর্চা ছিল আজ নেই। গ্রাম থিয়েটার বৃহৎভাবে শুরু হলেও এখন স্তিমিত প্রায়। পথনাটক বলিষ্ঠ ভূমিকা এক সময় রাখলেও এখন প্রভাব অনেকটাই কমেছে। এই বিকল্প দিকগুলো নিয়ে ভাবা দরকার। বিকল্প নাট্য চর্চা এবং রতন থিয়ামকে নিয়ে লেখা বই বাংলাও ইংরেজিতে হবে। বাংলাতেই আপনি লিখেছেন “আরণ্যক: একটি নাট্যদলের কথা”। পশ্চিমবঙ্গে নাট্য একাডেমী থেকে আমার লেখা বাংলায় ব্রেখটের নাট্য সমালোচনার ইতিহাস বইটি প্রকাশ পেলে মামুনুর রশীদের দৃষ্টি পড়ে। তিনি আরণ্যক নাট্যদলের প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর পূর্তিতে আমাকে বলেন, আরণ্যকের সকল প্রযোজনা তথ্য নিয়ে যেন আমি কিছু একটা করি। আমি আমার ভাবনা, বোঝাপড়া আর আরণ্যকের সার্বিক সহযোগিতায় লিখলাম, ‘আরণ্যক : একটি নাট্যদলের কথা’। দলের চল্লিশ বছর পূর্তিতে নতুন নাটক সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত নিয়ে নতুন কলেবরে বের হলো একই নামে নতুন সংস্করণ। বাংলাদেশে আরণ্যককে নিয়ে করা কাজই আমার প্রথম কাজ। বাংলাদেশে আর কোন কোন নাট্যদলের প্রকাশনা নিয়ে কাজ করছেন? বন্ধুবর লিয়াকত আলী লাকীর নাট্যদল লোক নাট্যদল নিয়ে কাজ করছি। কাজ করছি শ্রদ্ধেয় রামেন্দু মজুমদারের নাট্যদল থিয়েটার নিয়ে। পাশাপাশি ঢাকার পরেই নাট্য চর্চায় চোখ পড়ে যে চট্টগ্রামে সেখান থেকে তির্থক নাট্যদল নিয়ে গবেষণা করছি। এখানে একটা কথা বলে রাখি, কাজের জন্যে কাজ করাটাই একামাত্র উদ্দেশ্য না। আমি আমার পিএইচ.ডি গবেষণার সময় বিভিন্ন দলে ঘুরে ঘুরে তাদের প্রযোজনার সমালোচনা কপি বারংবার চেয়ে কখনও পেয়েছি কখনও পাইনি। দিচ্ছি দিচ্ছি করে কেউ দিয়েছে কেউ দেয়নি। ফলে আমার গবেষণা কর্মের উপলব্ধি থেকে বুঝেছি, দলীয় মূল্যায়নধর্মী প্রকাশনা থাকা জরুরী। দ্বিতীয়ত, ভেবেছি আমার কাজটা যেন কারও না কারও জন্য অনুকরণীয় হয়ে ওঠে। এখন গ্রুপ নাট্যচর্চার পাশাপাশি একাডেমিক নাট্যচর্চা চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স মাস্টার্স পর্যায়ে নাটক পড়ানো হচ্ছে। ফলে খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে এই বইগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তি হবে। গবেষণা ও ইতিহাসের সহায়ক হবে। ফলে এই বয়সে এসে অতিরিক্ত গবেষনা ও প্রকাশনা কাজ যদি করেই থাকি তবে তা একটি মহৎ ভাব ও আদর্শের কর্মধারা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। নিজের কর্মের মূল্যায়ন যেভাবে করেনÑ আমার বাবা ফনিভূষণ গোস্বামী ছিলেন ফরিদপুরের মানুষ। মা লীলাবতী গোস্বামী বরিশালের মানুষ। ৪৭ দেশ ভাগের পর তারা দেশ ছেড়ে চলে যান। আমার শৈশবের বেশকিছু সময় কেটেছে উদ্বাস্তু শিবিরের ছত্রছায়ায়। খাট থেকে পড়ে জলে না ভেসে যাই তাই কোমরে সুতা বেঁধে এক হাতে ধরে অন্য হাতে মা রান্না করেছেন। বাবা মায়ের অনিশ্চিত জীবন সংগ্রামে আমার দিদিমা চপলা বালা রায় চৌধুরী তার সীমিত উপার্জন দিয়ে আমাকে পড়িয়েছেন। স্কটিশ চার্চ কলেজের শিক্ষক কালীপদ ভট্টাচার্য্য নানা সময়ে বই কিনে দিয়েছেন। বিমল মুখোপাধ্যায়ের অধীনে পিএইচডি হল। কলেজ লাইব্রেরিয়ান শিশির বিশ্বাস সেলফ খুঁজে খুঁজে আমার গবেষণা সহায়ক বই পাইয়ে দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের নাট্যকলার বর্তমান শিক্ষক রহমত আলী ও ওয়াহিদা মল্লিক জলি একসময়ে কলকাতায় পড়ত এবং ওরা আমার বন্ধু ছিল। ওদের হাত ধরেই এখানে আসা। মামুনুর রশীদ বড় পরিসরে কাজ করানোর মাধ্যমে আমাকে চিনিয়ে দিলেন। এত এত মানুষের অবদান আজ জীবনের পিছনে ফিরে তাকালে মনে পড়ে। সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। উৎপল দত্ত, তাপস সেন হয়ে আজকে রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গে পর্যন্ত কাজ করতে পারা আমার গর্ব। আমার একটাই চাওয়া সমকালের নাট্যচর্চা যেন মহাকালের স্রোতধারায় মিশে থাকে। বিলুপ্তির চোরাস্রোতে আমরা জেন সব হারিয়ে না ফেলি। আমরা নাট্যাঙ্গনের যে যে জায়গায় থাকি না কেন আমরা জেন আমাদের কাজটা করে চলি নিজ দায়িত্বে এবং সর্বচ্চ আন্তরিকতায়। আর সেটা ঠিকঠাক মতো করে চলায় আমি তৃপ্ত। আপনি যে আপনার তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের এই ব্যস্ততম সময়ের মধ্যে থেকেও অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের সময় দিলেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ, আপনার আন্তরিক অনুসন্ধানী মনোভাবের প্রতি শুভ কামনা রইল।
×