ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বই ॥ নাট্য আন্দোলনের দীপ্ত কণ্ঠ

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৮ আগস্ট ২০১৭

বই  ॥ নাট্য আন্দোলনের দীপ্ত কণ্ঠ

অভিক ওসমানের লেখা ‘নাট্য চতুষ্টয়’ প্রকাশ পায় ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি ২০১৭। বইটি প্রকাশ করেছে খড়িমাটি প্রকাশন। প্রচ্ছদ এঁকেছেন মোস্তাফিজ কারিগর।’৭০-এর দশক আর ’৮০-এর দশক গত শতাব্দীর আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পালাক্রমে এক ঝড়-ঝঞ্জা আর সংঘাতময় পরিস্থিতির উত্তেজক সময়। ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সাড়ে তিন বছরের যুগসন্ধিক্ষণে সপরিবারে (দুই কন্যা ছাড়া) বাঙালী জাতির স্থপতির মর্মান্তিক মহাপ্রয়াণ তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার এক কঠিনতম অধ্যায়। যার সময়োপযোগী প্রভাব পড়ে মননশীল জগতে। সৃষ্টিশীল মানুষও তাড়িত হয় সমাজের অস্থিরতা, টানাপোড়েন, সাংস্কৃতিক বলয়ের চরম বিপর্যয়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আর আদর্শহীনতার মারাত্মক অবক্ষয়ে। আর সেভাবে আশির দশকে তোলপাড় শুরু হয়ে যায় আবহমান ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির বেড়াজালে আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের এক বলিষ্ঠ প্রত্যয়ে। নাটকের আঙ্গিকেও আসে এক যুগান্তকারী রদবদল। অভিক ওসমান সেই সময়েরই একজন বলিষ্ঠ নাট্যজন। যার লেখায় সেই পলাশীর যুদ্ধে এদেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের নারকীয় ভূমিকা থেকে শুরু করে ’৪৭-এর দেশ বিভাগে ও এর থেকে ব্যতিক্রমী কোন কিছু দেখতে না পারার বেদনার্থ যে আকুতি তারই জীবন্ত চালচিত্র তার এই ‘নাট্য চতুষ্টয়’-এর আঙ্গিকে আর বৈশিষ্ট্য। চারটি নাটকের অভিযোজনে গ্রন্থটির যে সুসংবদ্ধ রূপ সেখানে ‘শঙ্খ উপাখ্যান’ দিয়ে শুরু প্রথম নাটকটি। এখানে বিধৃত আছে বাংলার শেষ নবাব সিরাজদ্দৌলা নাটকের শেষ দৃশ্য যেখানে নবাব সভাষদ কর্তৃক নিগৃহীত এবং মোহাম্মদী বেগ কর্তৃক নিহত হওয়ার ঘটনার অবতারণা করা হয়। পরের কাহিনী সময়ের গতিতে এগিয়ে যাওয়া ব্রিটিশ রাজন্যবর্গের ঔপনিবেশিক শাসনের তীব্র কষাঘাত থেকে বেরিয়ে এসে কিভাবে ’৪৭ সালে আর এক নতুন শাসন-শোষণের জাঁতাকলে আপামর বাঙালীর নীরব আত্মাহুতি দেয়ার নিঃশব্দ যন্ত্রণা। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের দায়ভাগে ভারাক্রান্ত বাঙালীর ভাষা আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক সংগ্রামে রক্ত ঝরানোর এক অগ্নিঝরা অধ্যায়ের বিশেষ কালপর্ব নাটকটির গতিপথকে স্বচ্ছ আর স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে যায়। যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের মতো এক গৌরবোজ্জল আখ্যানকে ইতিহাসের অনুষঙ্গ করে। নাট্যকার যেমন সমাজ সচেতন একইভাবে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও তার নাটককে নানামাত্রিকে বিশিষ্টতা দান করে। ব্যক্তি মানুষের দেশপ্রেম, হঠকারিতা, ন্যায়-অন্যায় বোধ, সময়ের গতিতে পরিবর্তনের পালাক্রম সবই নাট্যকারের সূক্ষ্ম সৃষ্টি চেতনায় অনবদ্য হয়ে ওঠে। ‘অবশেষে জেনারেল’ নাটকে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের বিশিষ্ট জেনারেলদের ব্যক্তিক চরিত্রের যে নির্মমতা, অবিবেচকের চিত্র ফুটে ওঠে তা যেমন তৎকালীন সময়ের এক জীবন্ত চালচিত্র একইভাবে সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর বিড়াম্বনারও এক নিখুঁত প্রতিবেদন। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, ’৭৫-এর নৃশংসতা সর্বোপরি সামরিক বাহিনীর একরোখা আর কঠিন শাসনের আবর্তে পড়া এ দেশের মানুষের জীবনে হরেক রকম টানাপোড়েনের এক বিদগ্ধ সামাজিক চিত্র অভিক ওসমানের নাটকগুলো। নাটক শুধু তৎকালীন সামাজিক অবয়বের স্বচ্ছ প্রতিবেদনই নয়, তা ব্যক্তি মানুষের বিচিত্র ভূমিকা, দ্বন্দ্ব, অন্তর্দ্বন্দ্ব, এমনকি ঐতিহাসিক ধারা নির্ণয়ে এর ইতি এবং নেতিবাচক অবদানগুলোও স্পষ্টতই ধরা পড়ে। যা বাংলাদেশের যথার্থ ইতিহাসকে সর্বসাধারণের সামনে হাজির করে। সঙ্গত কারণে বিভ্রান্ত হওয়ার কোন সুযোগই থাকে না। অভিক ওসমানের চারটি নাটকই ইতিহাসের দায়বদ্ধতার ওপর নির্মিত। যেখানে তিনি সময়ের দাবি মেটাল থেকে আরম্ভ করে বর্তমান অবস্থারও এক সুসংবদ্ধ সংলাপ পাঠক সমাজকে উপহার দিয়েছেন। যে নাটক মানুষের কথা বলে, তার চারপাশের আশীর্বাদ-অভিশাপকে চেনাতে সাহায্য করে, সঠিক ইতিহাসের প্রত্যয় ব্যক্ত করে তা অবশ্যই সর্বজনীন এবং মাঙ্গলিক। সুস্পষ্ট নির্দেশনার গতিপথ যদি অবাধ, মুক্ত আর মানবিক না হয় তা মানুষের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না। অভিক ওসমান সেই বোধেরই একজন যথার্থ নির্দেশক যার মনন আর সৃষ্টিশীলতা সাধারণ মানুষের জীবন ঘনিষ্ঠ, মানুষের কল্যাণে সম্পর্কিত সর্বোপরি সুস্থ আর স্বাভাবিক সমাজ ব্যবস্থার স্বচ্ছ দলিল। গ্রন্থটি পাঠক সমাজে সমাদৃত হবে এ আশা ব্যক্ত করাই যায়। গ্রন্থটির সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করি।
×