ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাঁড়াশি অভিযানে জঙ্গীবাদের ঝুঁকি কমেছে

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৮ আগস্ট ২০১৭

সাঁড়াশি অভিযানে জঙ্গীবাদের ঝুঁকি কমেছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সিরিজ বোমা হামলার একযুগ পেরিয়ে গেলেও জঙ্গী তৎপরতা থেমে নেই। সাঁড়াশি অভিযানের মুখে জঙ্গীবাদের ঝুঁকি কমে এসেছে। হালে নব্য জেএমবির নামে জঙ্গীদের এককাতারে আনার চেষ্টা চলছে। জঙ্গীবাদ নিয়ে কাজ করা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গীবাদের ভীত এতটাই শক্ত যে, আগামী দশ বছর সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রাখলেও তা পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। তবে জঙ্গীবাদের ঝুঁকির মাত্রা একেবারেই সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। শুধু অভিযান নয়, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ও বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীদেরও সঠিক মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে হবে। জঙ্গীবাদ ইস্যুকে সামনে রেখে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে রাষ্ট্রকে। আর নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সিরিজ বোমা হামলার পর ক্ষমতার পালাবদল না হলে দেশ এতদিনে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক বা সিরিয়ার মতো জঙ্গী অধ্যুষিত দেশের বিশ্বের কাছে পরিচিতি পেয়ে যাওয়া বিচিত্র ছিল না। ভবিষ্যতে দেশের জঙ্গীবাদ কোন পর্যায়ে যাবে তা নির্ভর করছে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় কারা থাকছেন, তার ওপর। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা নেয়ার পর দেশে ভয়াবহ জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের সিনিয়র নেতাদের হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গীরা। দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য নিয়ে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সিরিজ বোমা হামলা চালায় জেএমবি। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় (মুন্সীগঞ্জ বাদে) বেলা এগারোটার দিকে সিরিজ বোমা হামলা চালানো হয়। মাত্র আধঘণ্টার ব্যবধানে দেশের ৩০০টি স্থানে চালানো সেই হামলায় অন্তত ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। হামলায় দু’জন নিহত হন। আহত হন দু’শতাধিক মানুষ। হামলা চালানো হয় হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেসক্লাব ও সরকারী আধাসরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কাছে। পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স শাখার সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশের বিভিন্ন থানায় ১৫৯টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। এর মধ্যে ১০টি মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। বাকি ১৪৯টি মামলায় চার্জশীট দেয়া হয়। এসব মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামি হিসেবে গ্রেফতার হয়েছে এক হাজারের বেশি আসামি। আসামিদের মধ্যে ৩৩৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। আর ২৭ জনের মৃত্যুদ- হয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, জেএমবি বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে গড়ে ওঠে। সিরিজ বোমা হামলার পরও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করার সুযোগে ভেতরে ভেতরে আরও বেপরোয়া হয়ে সংগঠিত হতে থাকে জঙ্গীরা। এমন সুযোগে ওই বছরই চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট ও গাজীপুরে আত্মঘাতী হামলায় ২ জঙ্গীসহ ১৬ জন নিহত ও দুই শতাধিক জন আহত হন। ঝালকাঠিতে বোমা হামলায় নিহত হন সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহমেদ চৌধুরী ও জগন্নাথ পাড়ে। ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যায় ২০০৬ সালের ৩০ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানি, আব্দুল আউয়াল, মাসুম, খালিদ, সাইফুল্লাহসহ সাত শীর্ষ জঙ্গীর ফাঁসি হয়। আতাউর রহমান সানির বরাত দিয়ে একজন দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, জেএমজেবি (জাগ্রত মুসলিম জনতা অব বাংলাদেশ) গঠনের সময় মধ্যপ্রাচ্যের একটি মুসলিম দেশ একসঙ্গে ২ কোটি টাকা অর্থায়ন করে। আর সিরিজ বোমা হামলা চালাতে পুরো দেশে নেটওয়ার্ক তৈরিসহ হামলা চালাতে ব্যয় হয়েছিল ১২শ’ কোটি টাকা। এসব টাকার সিংহভাগ এসেছে বিদেশ থেকে। যার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের অনেক এনজিও এর সঙ্গে জড়িত। এছাড়া স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীও নানাভাবে জড়িত। পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স শাখার সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলছিলেন, এত কিছুর পরও থেমে নেই জঙ্গীদের তৎপরতা। ভবিষ্যতে জঙ্গীবাদ কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে তা নির্ভর করছে রাষ্ট্রের পলিসির ওপর। জঙ্গীবাদ ইস্যুতে সরকার জিরোটলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে জঙ্গীবাদের ঝুঁকি কমিয়ে প্রায় শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব। জঙ্গীবাদের ঝুঁকি কমাতে রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে। পাশাপাশি পরিবার, পিতামাতা, আলেম-ওলামাসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি জানান, যে পর্যায়ে অভিযান চলছে, তা অব্যাহত থাকবে। এতে করে জঙ্গীরা নতুন করে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে না। তবে হালের জঙ্গীরা প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় এ খাতে আরও মনিটরিং বাড়ানো প্রয়োজন। পুলিশ যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থাকেও এজন্য কাজ করতে হবে। অন্যদিকে বিদেশে থাকা বাংলাদেশীদের ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। তারা জঙ্গী হয়ে দেশে প্রবেশ করে জঙ্গীবাদে মদদ দিচ্ছে কিনা সেটি গভীরভাবে মনিটরিং করা প্রয়োজন। এজন্য বিদেশে বাংলাদেশের থাকা অন্তত ১০টি দেশের দূতাবাসে জঙ্গীবাদ নিয়ে কাজ করা দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা প্রয়োজন। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতার ঘাটতির কারণেই এক যুগ আগে জেএমবির জঙ্গীরা সিরিজ বোমা হামলা চালাতে পেরেছিল। সামনের দিনগুলোতে তেমন কিছু আর জঙ্গীরা ঘটাতে পারবে না। হালে নব্য জেএমবি সক্রিয় থাকলে তারা কোন্দলে বিভক্ত। তাদের বড় ধরনের কোন নাশকতা চালানোর ক্ষমতা নেই। বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আব্দুর রশীদ জনকণ্ঠকে বলেন, জঙ্গীবাদের তৎপরতা থেমে যায় না। সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়। সর্বশেষ গুলশানে হলি আর্টিজানের ঘটনায় সেটি প্রমাণ হয়েছে। জঙ্গীবাদ বর্তমানে আর মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। তবে জঙ্গীবাদের মতাদর্শ এখনও রয়েছে। আর পেছনে রয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী। জঙ্গী তৈরিতে এ দলটি ছাড়াও পাকিস্তানের মদদ থাকার বিষয়টি দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। তাই জঙ্গীবাদ দমন করতে মতাদর্শগত তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি পাকিস্তানের বিষয়ে আরও নজর রাখতে হবে সরকারকে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জঙ্গীবাদ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকবে তা নির্ভর করছে দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় কারা থাকছেন, তার ওপর। কারণ যুদ্ধাপরাধী বা জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলে, স্বাভাবিকভাবেই আবার দেশে জঙ্গীবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। সিরিজ বোমা হামলার পর ক্ষমতার পালাবদল না হলে দেশ এতদিনে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক বা সিরিয়ার মতো জঙ্গী অধ্যুষিত দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি পাওয়া বিচিত্র ছিল না।
×