ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পোশাক রফতানিতে বাড়ছে না মুল্যসংযোজন

প্রকাশিত: ২৩:৫৬, ১৭ আগস্ট ২০১৭

পোশাক রফতানিতে বাড়ছে না মুল্যসংযোজন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ স্থানীয় শিল্পের ব্যবহার বা মূল্য সংযোজন বাড়ছে না তৈরি পোশাক রফতানিতে। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে মূল্য সংযোজন ৭৪ থেকে ৭৬ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। বরং তিন বছর ধরে এ হার আরও কমছে। গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) আগের অর্থবছরের তুলনায় মূল্য সংযোজন কম হয়েছে শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ। মোট মূল্য সংযোজন হয়েছে ৭৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। তৈরি পোশাক খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে এ পরিসংখ্যান রয়েছে। তবে এ পরিসংখ্যান নিয়েও সন্দেহ আছে বাণিজ্য বিশ্লেষকদের। তাদের মতে, প্রকৃত মূল্য সংযোজন এত বেশি হওয়ার কথা নয়। তৈরি পোশাকে মূল্য সংযোজন বলতে বোঝায় রফতানি মূল্য থেকে আমদানি করা কাঁচামালের মূল্য বাদ দিয়ে বাকি যে পরিমাণ স্থানীয়ভাবে জোগান দেওয়া হয়। অর্থাৎ স্থানীয় কাঁচামাল ও সেবাকে মূল্য সংযোজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মূল্য সংযোজন না বাড়ার কারণ সম্পর্কে পোশাকের রফতানিকারক এবং এ খাতের স্থানীয় কাঁচামাল সরবরাহকারী, অর্থাৎ পশ্চাৎ সংযোগ খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে দ্বিমত আছে। রফতানিকারক ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন ক্রেতা চাহিদা অনুযায়ী গুণগত মানের কাপড় উৎপাদন হচ্ছে না দেশে। এছাড়া বিভিন্ন কারণে স্থানীয় কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণেও মূল্য সংযোজন বাড়ছে না। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পোশাক রফতানিতে এক সময় উৎসবিধিতে দ্বিস্তরের শর্ত ছিল। রফতানিতে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাপড় ব্যবহারের শর্ত ছিল তখন। ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে উৎসবিধি শিথিল করে এক স্তরে নামিয়ে আনা হয়। এখন যেকোনো দেশ থেকে কাপড় আমদানি করেই ইউরোপে রফতানিতে জিএসপি সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। মূল্য সংযোজন কমার এটিও একটি বড় কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, গত অর্থবছরে তৈরি পোশাকের নিট ও ওভেন মিলে আমদানি করা কাঁচামালের মূল্য মোট রফতানি আয়ের ২৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আমদানি হয়েছে ৭০১ কোটি ৪২ লাখ ডলারের কাঁচামাল। এ সময়ের মোট রফতানি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৮১৪ কোটি ডলার। আগের দুই অর্থবছরের আমদানি ও মূল্য সংযোজনের চিত্রও ছিল একই রকম। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তৈরি পোশাকের কাঁচামাল আমদানির পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বিপরীতে মূল্য সংযোজন হয়েছে ৭৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। রফতানির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৫৪৯ কোটি ডলার। পরের অর্থবছরে (২০১৫-১৬) ৭৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন হয়েছে। বাকি ২৪ দশমিক ৬৫ শতাশ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়েছে। রফতানি আয় এসেছে দুই হাজার ৮০৯ কোটি ৪২ লাখ ডলার। বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জানান, দীর্ঘদিন ধরে শিল্পে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এতে অন্যান্য শিল্পের মধ্যে তুলা থেকে সুতা এবং সুতা থেকে কাপড় উৎপাদনকারী বস্ত্রকলগুলোর উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে চাহিদা মতো জোগান পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে মূল্য সংযোজন একটা পর্যায়ে এসে আর বাড়ছে না। তিনি জানান, ওভেনের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ কাপড় স্থানীয়ভাবে পাচ্ছেন তারা। বাকি ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভারত, চীন থেকে আমদানি করতে হয়। তবে স্থানীয় কাপড় ব্যবহার করতে পারলে অনেক সুবিধা। সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা পাওয়া যায়। ইচ্ছা করলে এক ঘণ্টার ব্যবধানে কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই কাপড় সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। পোশাক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ এ সুবিধা থাকলেও অনেককে বাধ্য হয়েই আমদানি করতে হয়। তবে কাঁচামাল বিদেশ থেকে আনার জন্য ক্রেতাদের কোনো শর্ত থাকে না বলে জানান তিনি। তার মতে, কম সময়ে পণ্য তৈরি করা সম্ভব হয় বলে ক্রেতাদের বরং এতে আগ্রহ থাকে। তবে অন্য কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উচ্চ মূল্যের পোশাক উৎপাদনের জন্য এখনও যথেষ্ট মান অর্জন করেনি স্থানীয় সুতা ও কাপড়। এ কারণে কোনো কোনো ক্রেতা নির্দিষ্ট বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে কাপড় বা সুতা আমদানির শর্ত দিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে উচ্চ মূল্যের পোশাক উৎপাদনে যাচ্ছে বলে জানান এসব উদ্যোক্তা। পোশাক খাতের মূল্য সংযোজন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক সানেমের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, প্রকৃত মূল্য সংযোজন এত বেশি হওয়ার কথা নয়। যদি বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যকে সঠিক বলে ধরে নেওয়াও হয়, তবু যে হারে রফতানি বাড়ছে, সে হারে মূল্য সংযোজন বাড়ছে না। মূল্য সংযোজন বাড়াতে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে পোশাক খাতের পশ্চাৎ সংযোগ শিল্পে বিনিয়োগকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা উচিত।
×