ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মনোয়ারুল হক

ট্রিবিউট টু কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৭ আগস্ট ২০১৭

ট্রিবিউট টু কনসার্ট ফর বাংলাদেশ

১৯৭১ সাল, ২৫ মার্চ কালরাত। শুরু“ হলো পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের নামে নিরীহ মানুষ শিকারের অভিযান। দলে দলে মানুষ ছুটছে, কেউ পালাচ্ছে বাঁচার তাগিদে, কেউ যাচ্ছে যুদ্ধের ময়দানে। শুরু“ হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। তবে এ যুদ্ধ যে শুধু অস্ত্র হাতেই হয়েছিল তাও কিন্তু নয়, কেননা আরেক দল বাদ্যযন্ত্র হাতেও যুদ্ধে পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন প-িত রবিশংকর আমেরিকায় যান তৎকালীন জনপ্রিয় রক গানের দল বিটলসের জর্জ হ্যারিসনের কাছে। তিনি বাংলাদেশের জন্য সাহায্য চাইতেই গিয়েছিলেন। তখন জর্জ হ্যারিসন এ ব্যাপার নিয়ে ভাবা শুরু“ করলেন। তিনি আমেরিকা ও ইউরোপের খ্যাতিমান বিভিন্ন সঙ্গীতশিল্পীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো একটি কনসার্টের আয়োজন করার। সেই কনসার্ট করা হবে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য অর্থ ও জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে। সেই কনসার্টের শিরোনাম ছিল কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। এ কনসার্ট ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট আমেরিকার ম্যাডিসন স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হয়। চল্লিশ হাজার মানুষ সেদিন বাংলাদেশের সঙ্গে একাত্ম হন কনসার্টে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। কনসার্ট ফর বাংলাদেশে অংশ নেন বিলবোর্ড টপচার্টে স্থান পাওয়া সব শিল্পী। এদের মধ্যে ছিলেন জর্জ হ্যারিসন, রবিশংকর, বব ডিলান, জোয়ান বায়েজ, এরিক ক্ল্যাপটন, লিয়ন রাসেল, রিংগো স্টার, ব্যাড ফিংগার (রক গানের দল) কস ফোরম্যান, বিলি প্যাটারসন, পেট হ্যাম, টম ইভানস, জোয়ে মোল্যান্ড, মাইক গিবনস, এলেন বুচার, জেস এড ডভিস, চাক ফিনলে, মার্লিন গ্রিনি, জেনি গ্রিনি, জো গ্রিন, ডলার্স হল, জিম হর্ন, কমলা চক্রবর্তী, জ্যাকি কেলসো, জিম কেল্টনার, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, ক্লডিয়া লিনার, ল’ ম্যাকক্রেয়ারি, ওলি মিশেল, ডন নিক্স ডন প্রেস্টন, কার্ল রাডলে, আল্লা রাখা প্রমুখ। মঞ্চের সামনে ও পেছনে কলাকুশলী ছিলেন অনেক। এ কনসার্ট থেকে তাৎক্ষণিকভাবে উঠে আসে ২৪৩,৪১৮.৫০ মার্কিন ডলার যা ইউনিসেফের মাধ্যমে দেয়া হয় বাংলাদেশকে। সেই টাকা অস্ত্র, রসদ ক্রয় রিফিউজি ক্যাম্প চালানোর খাতে যুক্ত হয়। মার্কিন সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এ কনসার্টের আয়োজন করায় অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের পড়তে হয় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। জর্জ হ্যারিসনের কনসার্ট করার তিন বছরের সমস্ত চুক্তি বাতিল করে দেয়া হয়। এর ফলে সেই সময়ে তাকে অর্থকষ্টে কাটাতে হয়। কিন্তু দমে যাননি তারা। ১৯৭৪ সালের মন্বন্তরের সময় কনসার্ট ফর বাংলাদেশের রেকর্ড বিক্রির অর্থ ইউনিসেফের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অনুদান দেয়া হয়। গঠন করা হয় জর্জ হ্যারিসনের নামে তহবিল, যা থেকে এখনও প্রতিবছর বাংলাদেশ ও আফ্রিকার দুস্থ শিশুদের জন্য সাহায্য পাঠানো হয়। বাংলাদেশে সিডর যখন আঘাত হানে তখন ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য হ্যারিসন পরিবার থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য দেয়া হয়। বাংলাদেশের জন্য তাই কনসার্ট ফর বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যার সুফল এদেশ এখনও পাচ্ছে। যদিও সেই কনসার্ট আয়োজনকারী বা অংশগ্রহণকারী মহান বন্ধুদের আমরা বিনিময়ে তেমন কিছুই দিতে পারিনি, নতুবা দেয়ার কথা ভাবিনি। তবে ব্লাডোরিয়া নামক বাংলাদেশী হেভি মেটাল গানের দলের রুমন হায়াৎ অনেক বছর সময় দিয়ে একটি ট্রিবিউট এলবাম বের করেন। সেই এলবাম জি সিরিজের ব্যানারে ২০১৫ সালের মে মাসে বাজারে আসে। এর আগে ওই বছরের জানুয়ারি মাসের এক তারিখে এলবামটি আইটিউনসে ছাড়া হয়। এলবামের শিরোনাম ‘ট্রিবিউট টু কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। ব্লাডোরিয়া নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকের একটি মেটাল ব্যান্ড। ঈশা খান দূরের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত ‘দিন বদল’ শীর্ষক মিশ্র এলবামে তাদের প্রথম গান প্রকাশ পেয়েছিল। এরপর দীর্ঘ বিরতি দেয়ার পর ২০১৪ সালে তিনি আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এ এলবামের কাজ করেন। কেননা ব্লাডোরিয়ার মূল সদস্যদের মধ্যে একমাত্র রুমন হায়াৎ অবশিষ্ট ছিলেন। রুমন হায়াৎ আক্ষেপ করে বলেন এ এলবাম বের করে তিনি দেশের চেয়ে বিদেশেই বেশি সাড়া পেয়েছিলেন। এদেশের মানুষ এই ট্রিবিউট এলবাম নিয়ে খুব একটা মাতেনি। বিভিন্ন সিনিয়র মিউজিসিয়ানকে এ এলবাম শুনতে দিয়েও পরবর্তীতে কোন সাড়া পাননি। বেশ কিছু টিভি চ্যানেলেও এলবাম জমা দিয়ে কোন প্রকার সহযোগিতা পেতে ব্যর্থ হন তিনি। কিছু টিভি চ্যানেলে এই ট্রিবিউট এলবাম জমা দিয়ে আসার পর অন্য নামকরা শিল্পীদের দিয়ে সেসব চ্যানেলে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের কিছু গান টিভি লাইভে পরিবেশিত হলেও রুমন হায়াৎ সেখানে ডাক পাননি। যেখানে তার চাওয়া ছিল শুধু সেসব মহান শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো যারা ‘কনসাট’ ফর বাংলাদেশ’ এ অংশ নিয়েছিলেন। ‘ট্রিবিউট টু কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এলবামে তারা জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ, জোয়ান বায়েজের দ্য স্টোরি অফ বাংলাদেশ, জর্জ হ্যারিসনের হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলি হুইপস, বব ডিলানের ব্লোইং ইন দ্য উইন্ড ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের মাগো ভাবনা কেন?, নঈম গওহরের নোঙর তোল তোল - এ ছয়টি গান সংযুক্ত করেছেন। গানগুলোর মূল সুর ঠিক রেখে ব্লাডোরিয়ার নিজস্ব ছাপ দেয়া হয়েছে। তাই গানগুলো শুনলে শ্রোতারা নতুন এক স্বাদ পাবেন। আর সিডির মোড়ক তথ্যবহুল। সেখানে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ সম্পর্কে জানা অজানা বেশ কিছু তথ্য সংযুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশী মেটাল ভক্ত শ্রোতাদের উচিত এই এলবামটি শুনা আর আমাদের দেশের সরকারের উচিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’- এ অংশ নেয়া যেসব শিল্পী এখনও জীবিত আছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা ও বাংলাদেশেই আরেকবার সেই কনসার্টের আয়োজন করার। যেখানে সেই সব শিল্পীকে সম্মাননা দেয়া হবে।
×