ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আইএসআইয়ের লম্বা হাত ও ট্র্যাপে কাদেরের পা -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:০২, ১৭ আগস্ট ২০১৭

আইএসআইয়ের লম্বা হাত ও ট্র্যাপে কাদেরের পা -স্বদেশ রায়

মি. সিনহার অবজারভেশনে যখন বলা হলো পার্লামেন্ট অকার্যকর, তখন সরকারের অস্তিত্ব নিয়ে একটা প্রশ্ন তোলা হয়। যদিও ওই অবজারভেশন তার একার, এর কোন আইনগত ভিত্তি নেই, তারপরেও সেটা দেয়া হয়েছে প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসে। মি. সিনহা শুধু এখানেই থামেননি, তিনি পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করার আগেই সুপ্রীমকোর্টের রায়ে যে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কথা বলা হয়েছে, ওই কাউন্সিলের সভাও করেছেন। এ ধরনের কাজ সরাসরি রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা। রাষ্ট্রকে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ কেউ করলে তার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হবে সেটা সম্পূর্ণ রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। তবে এ ধরনের পরিস্থিতি যখন মি. সিনহা তৈরি করেছেন একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্রের ভেতর সর্বোচ্চ পদে বসে, সে সময়ে সব থেকে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তাঁর মন্ত্রীদেরকে, দলের নেতাদের বলেছেন জনগণের কাছে যান। জনগণকে বোঝান। কারণ সর্বোপরি এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। মি. সিনহা জনগণের কাছ থেকে বেতন নেন, কিন্তু জানেন না তিনি জনগণের নিয়োগকৃত একজন সেবক মাত্র। শেখ হাসিনা জানেন এবং বার বার বলেন, আমরা জনগণের সেবক মাত্র। তাই ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে মি. সিনহার অবজারভেশনের ভেতর দিয়ে যে সুদূরপ্রসারী দুরভিসন্ধির খেলা শুরু হয়েছে, তা মোকাবেলার জন্য জনগণকে সজাগ করতে বলেছেন শেখ হাসিনা তাঁর নেতাকর্মীদের। এমনকি ঘটনা প্রবাহ যে দিকে এগুচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীকে নিজে থেকে দ্রুত সজাগ হতে বলতে হবে জনগণকে। প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ চরম সত্য কথাটি বলেছেন মি. সিনহার দেয়া এই অবজারভেশন সম্পর্কে। তিনি বলেছেন, তার এ কাজ মূলত বিএনপিকে গর্ত থেকে বের করে আনার প্রচেষ্টা। বিএনপিকে কেন গর্ত থেকে বের করে আনা হলো? বিএনপি পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই দ্বারা নির্দেশিত। অন্যদিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে কার সম্পর্ক বা জনকণ্ঠের মানহানির মামলার কথা সকলের মনে আছে। এর থেকে স্পষ্ট হয় বিএনপিকে গর্ত থেকে বের করে আনার পেছনে আইএসআইয়ের লম্বা হাত কাজ করেছে। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের আগের রাজনীতিতে গেলে এর একটি উদাহরণ পাওয়া যাবে। জাসদ যদিও সিআইএ নির্দেশিত দল ছিল তারপরেও সিআইএর ছোট ভাই হিসেবে আইএসআই এবং এই উপমহাদেশে আইএসআই ও সিআইএর চরম বিরোধীরাও সেদিন সমানভাবে জাসদের কাজকে সমর্থন করে যাচ্ছিল। এর ভেতর সিআইএ ও আইএসআই চাচ্ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের পতন, অন্যরা চাচ্ছিল শেখ মুজিবের ওপর একটি প্রেসার সৃষ্টি করতে। কারণ শেখ মুজিবুর রহমান কোন একক গ-িতে বন্দী থাকেননি। তিনি সমানভাবে প্রতিবেশী দেশ, ইসলামিক বিশ্ব, সোভিয়েত ব্লক ও আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে এগুচ্ছিলেন। তিনি বেঁচে থাকলে কিছু দিনের ভেতর চীনের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক হতো। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া ও শেখ মুজিবের সঙ্গে বন্ধুত্বের বিষয়ে চীন অনেকখানি এগিয়ে এসেছিল। শেখ হাসিনাও তাঁর পিতাকে অনুসরণ করে ঠিক একইভাবে নিজ যোগ্যতায় বিশ্ব নেতা হয়ে উঠছেন। অন্যদিকে বর্তমানের বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর আমলের থেকে। এর পরেও সাম্প্রতিক চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড, ডোকলাম বর্ডার- যার মাধ্যমে সেভেন সিস্টারের চিকেন নেকের ভবিষ্যত, সব মিলে বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল অবস্থানে। এ ধরনের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, কোন ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশে যখন কোন দৃঢ়চেতা ও আন্তর্জাতিক মানের জাতীয়তাবাদী নেতা থাকে তখন ওই দেশের ভূমিকা হয় স্বাধীন ও নিজ দেশের অনুকূলে। শেখ হাসিনা সেই আন্তর্জাতিক মানের নেতা। দিল্লীতে প্রকাশ্য সভায় ভারতের প্রবীণ রাজনীতিবিদ এল. কে আদভানি বলেন, ‘এ মুুহূর্তে আপনিই (শেখ হাসিনা) দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নেতা।’ তাই এ ধরনের নেতার ওপর যখন কোন চাপ আসে তখন সকলেই চায় যে তিনি একটু চাপে থাকুন। তবে শেখ হাসিনার কাছ থেকে বা এ ধরনের নেতার কাছ থেকে ভাল কিছু পেতে হলে, তাঁর ওপর এই ধরনের চাপ এলে ওই চাপের পক্ষে থাকা ভুল কূটনীতি। কৌটিল্য কিন্তু বলেননি কোথাও বন্ধুকে দুর্বল অবস্থানে ফেলে সুবিধা নিতে। আর সে সুবিধা পাওয়াও যায় না। দুর্বল অবস্থানে ফেলে সুবিধা নিতে হবে শত্রুর কাছ থেকে, বন্ধুর কাছ থেকে নয়। সৈয়দ মুজতবা আলী শেখ মুজিবের কূটনীতি সম্পর্কে সংজ্ঞা দিয়ে গেছেন, ‘শেখ গাঁয়ের পোলা, তিনি সহজে বুঝতেন কত ধানে কত চাল। তাকে কূটনীতি শিখতে ভুট্টোর মতো অক্সফোর্ডে যেতে হয়নি।’ আমরাও বঙ্গবন্ধুর মতো গাঁয়ের পোলা, আমরাও সহজে বুঝি, আমার বন্ধু যদি ভাল থাকে আমি তাঁর কাছ থেকে ভাল সুবিধাটাই পাব। বন্ধুকে খারাপ অবস্থায় ফেলে ভাল সুবিধা পাওয়া যাবে না। ১৯৭৫ সালে শেষ বিচারে লাভ হয়েছিল আইএসআইয়ের। আর যারা বঙ্গবন্ধুর ওপর শুধু চাপ রাখতে চেয়েছিলেন, তাদের আমও গিয়েছিল ছালাও গিয়েছিল। এটাও আমাদের গাঁয়ের কথা। মডার্ন ডিপ্লোমেসির যে সব বই সেলফে আছে, সেখানে কোথাও পাইনি বাংলাদেশের চাষাভুষার মুখের এই কথাটি। যাহোক, শেখ হাসিনা তাঁর সঠিক পথ নিয়েছেন। তিনি জনগণের কাছে গিয়েছেন। রাষ্ট্রের যারা মালিক তাদের তিনি জানিয়ে দিতে বলেছেন, তাদের ঘরে চোর ঢোকার চেষ্টা চলছে। শেখ হাসিনার দলের অধিকাংশ নেতা ও মন্ত্রী ইতোমধ্যে যোগত্যার সঙ্গে চোরকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। শুধু তাই নয়, দলের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু একটি চরম সত্য বলেছেন, যাদের ঘরে চুরি করতে আসছে চোর, সেই ঘরের মালিক আওয়ামী লীগ কী তা তিনি জনগণের কাছে তুলে ধরেছেন। এমনকি পাকিস্তান থাকলেও আওয়ামী লীগের অবস্থান কী থাকত, সেটাও তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর মানুষকে। এ ছাড়া শেখ হাসিনার দলের অন্যতম নেতা কামরুল ইসলাম, হাসান মাহমুদ, দীপু মনি, মাহাবুবুল আলম হানিফ জনগণকে সঠিকভাবে সচেতন করার কাজ করে চলেছেন। আর অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী আইএসআইয়ের আরেকটি অপকর্ম যে তাঁর সরকার ও দল ঠেকিয়ে দিতে পেরেছে, তাও জনগণকে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ম্যাপ ঢেকে দিয়ে সুপ্রীমকোর্টে আপনার মানসীর মূর্তি স্থাপন করে ঈদের দিন রায়ট লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন আপনি। আমরা তা প্রতিহত করেছি। আপনার মতলব আমরা জানি।’ জনগণকে জানানোর পাশাপাশি শেখ হাসিনার সরকার এবং দলকে ঠেকাতে হচ্ছে বিএনপিকে গর্ত থেকে বের করে আনার এই ষড়যন্ত্র। আবার ওই অবজাভেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করার যে কাজটি করা হয়েছে, তা আইনগত মোকাবেলার পথে এগোতে হচ্ছে। তাঁর আইনমন্ত্রী অত্যন্ত মার্জিত ভাষায় এবং আইনগত দিক তুলে ধরে প্রেস কনফারেন্স করে জনগণকে জানিয়েছেন কীভাবে আইনগতভাবে তারা বিষয়গুলো মোকাবেলা করবেন। বাস্তবে এই রায়ের পর্যবেক্ষণ যদিও মি. সিনহার একার, তার পরেও তা বাদ দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, এখানে আইএসআইয়ের সব থেকে বড় উদ্দেশ্যটি সফল হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের আদালতের রায় আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ও তিনি স্বাধীনতার নেতা। এটাকে বিতর্কিত করে বিএনপি যে জিয়ার কথা বলে তাকে আবার এস্টাবলিশ করার জন্য বলা হয়েছে ‘কোন একক নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়নি।’ বিএনপি এই রায় নিয়ে যে এত খুশি তার আরও একটি কারণ এটা। তবে শেখ হাসিনা, তাঁর দল ও সরকার যখন সঠিক পথে এগুচ্ছিল, তখনই কিন্তু মি. সিনহার আরেকটি ট্র্যাপে পা দিয়েছেন শেখ হাসিনার দলের জেনারেল সেক্রেটারি। মি. সিনহা তাকে ডিনারের দাওয়াত দিয়েছিলেন। তিনি যেতে পারেন। তবে তিনি বেরিয়ে এসে যে কথা বলেছেন, তাতে স্পষ্ট, তিনি সিনহার একটি ট্র্যাপে পা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তাঁর রায় নিয়ে আলাপ হয়েছে। তিনি তাঁর দলের অবস্থান প্রধান বিচারপতিকে জানিয়ে এসেছেন। শেখ হাসিনাই বাংলাদেশে একমাত্র সরকারপ্রধান, যিনি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর মর্যাদা দেন ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন। ষোড়শ সংশোধনীও ছিল বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করার একটি উদ্যোগ। আমরা অর্থাৎ এ দেশের নাগরিকরা গণতান্ত্রিক কালচার থেকে সামরিক কালচারে বেশি অভ্যস্ত। পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে সৃষ্ট এলিটদের প্রায় ৯০ ভাগ ওই কালচারে অভ্যস্ত –তাই ওই এলিট ক্লাসের প্রতিনিধি বিচারকরা এটা বাতিল করেছেন। বাকি তথাকথিত এলিটরা সমর্থন করছেন। যাহোক, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এখানে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মি. সিনহা কিন্তু খুবই সুচতুরভাবে বিচার বিভাগ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে নষ্ট করলেন। ভবিষ্যতে তার কোর্টে যাবে এমন একটি বিষয় নিয়ে একজন মন্ত্রীর সঙ্গে, একজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে আলাপ করলেন। মি. কাদের শুধু একজন মন্ত্রী বা একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি এ মামলার একটি পক্ষও। মি. সিনহার এ ট্র্যাপে পা দিতে মি. ওবায়দুল কাদেরকে যারা উৎসাহিত করেছেন, তাঁরা সিনহার পক্ষ হয়ে শেখ হাসিনার একটি ক্ষতি করেছেন। এখন বিপক্ষরা বলতে পারবে, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান নষ্ট করে। বিপক্ষরা না বললেও ঘটনা কিছুটা তেমনই ঘটে গেছে। তাই এখনও সময় আছে ওবায়দুল কাদেরের পক্ষ থেকে বিষয়টি পরিষ্কার করে দেয়া যে, তিনি সামাজিক প্রোগ্রামে গিয়েছিলেন। সিনহা তাঁর কাছে এ কথা বলেছেন। তিনি শুধু তাঁর পার্টির অবস্থান বলেছেন। তবে রিভিউ আপীল বা সুয়োমটোর কোন বিষয় নিয়ে কোন সংলাপ হতে পারে না। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আরও সংলাপ হবে। প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে হলে ওবায়দুল কাদেরকে এ কথা ও কাজ থেকে ফিরে আসতে হবে। ওই কথা বন্ধ করতে হবে। সংলাপও বন্ধ করতে হবে। বিচার বিভাগের সঙ্গে এ ধরনের কোন সংলাপ হয় না। এটা আইনবহির্ভূত কাজ। আশা করি আইনমন্ত্রী তাকে ফিরতে সাহায্য করবেন। তা ছাড়া আরও একটা বিষয়, ওবায়দুল কাদের খোঁজ নিতে পারেন, তাঁর এ প্রোগ্রাম একটি মহলে আগে থেকেই জানাজানি হলো কীভাবে? অন্যদিকে তিনি যে রাষ্ট্রপতিকে সব কিছু জানিয়েছেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তাঁর যে বৈঠক হয়েছে, সেটা এর সঙ্গে জড়ানো ঠিক হবে না। রাষ্ট্রপতির ওখান থেকে বের হয়ে ওবায়দুল কাদের যা বলেছেন তা খুবই যুক্তিযুক্ত। তিনি বলেছেন- ‘রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অভিভাবক ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগদাতা, তাই তাঁকে তিনি সব বিষয়ে জানাতে গিয়েছিলেন।’ বাস্তবে ঘটনা প্রবাহ যে দিকে এগুচ্ছে তাতে রাষ্ট্রের মর্যাদা, বিচার বিভাগকে রক্ষা করতে হলে এখন অবশ্যই রাষ্ট্রপতিকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিই সে ক্ষমতার অধিকারী। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি একজন প্রবীণ ও দক্ষ রাজনীতিবিদ। রাষ্ট্রের বিচার বিভাগকে এক ব্যক্তির স্বৈরাচারী আচরণের ফলে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখান থেকে দ্রুত তিনি রক্ষা করবেন বলেই সকলে আশা করে। [email protected]
×