জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ সব দলের অংশগ্রহণে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার পক্ষে মত দিয়েছেন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) যে ক্ষমতা আছে সেটির প্রয়োগ করার ওপরও জোর দেন তারা।
বুধবার সকাল ১০টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে সংলাপে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা এ মত দেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা সংলাপে সভাপতিত্ব করেন। এ ছাড়া চার নির্বাচন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন।
আজ বুধবার দুপুরে ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বিভিন্ন পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে সংলাপ শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন।
ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, নির্বাচন কমিশন সব পর্যায়ের অংশীজনদের মতামত জানার জন্য ধারাবাহিকভাবে সংলাপের আয়োজন করেছে। এই সংলাপ থেকে যেসব মতামত কিংবা সুপারিশ আসবে, সেসব বিষয় নিয়ে ইসি কমিশনারেরা আলাদাভাবে বসে তাঁদের করণীয় নির্ধারণ করবেন। সংলাপের মাধ্যমে কমিশন নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি এবং কীভাবে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারে, তা নির্ধারণই এই সংলাপের মূল উদ্দেশ্য।
সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, পত্রিকার মোট ৩৬ জন সম্পাদককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সংলাপে ২৬ জন সম্পাদক অংশ নিয়েছেন।
আমন্ত্রিতদের মধ্য থেকে সংলাপে উপস্থিত ছিলেন যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম, মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, প্রথম আলোর উপ সম্পাদক আনিসুল হক ও যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, বিএফইউজের একাংশের সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ও মহাসচিব ওমর ফারুক, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান প্রমুখ।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল সাংবাদিকদের বলেন, বেশিরভাগ ব্যক্তিই সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। ইসিকে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে হবে, যেন সবাই নির্বাচনে আসে। সেনাবাহিনী মোতায়েন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সার্বিকভাবে অনেকেই মনে করছেন, সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন নেই। অনেকেই বলেছেন, অনেক দেশে সেনাবাহিনী সুষ্ঠূ নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। তাহলে আমাদের দেশে সমস্যা কিসের? তবে আমি বলেছি, এটি সিভিল প্রশাসনের বিষয়, সেনা মোতায়েন দরকার নেই। তবে তারা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকতে পারে।
মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, নির্বাচনে সেনাবাহিনী, ‘না’’ ভোট, সীমানা পুনঃনির্ধারণসহ বিভিন্ন ষিয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমি সেনাবাহিনী মোতায়েনের পক্ষে মত দিয়েছি। বলেছি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হয়। আমরা কোনও বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নই যে, আমাদের এখানে সেনা মোতায়েন করা যাবে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাবগুলো এসেছে, সেগুলো হলো—কিভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু করা যায়। সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। একইসঙ্গে নির্বাচনে সেনাবাহিনী থাকবে কিনা, তা নিয়েও কথা হয়েছে। ইসি যদি মনে করে সেনাবাহিনীর দরকার, তাহলে মোতায়েন করবে, না চাইলে নয়। তবে, আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাকে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছি।
নির্বাচনে সেনা মোতায়েনে বিপক্ষে মত দিয়েছেন প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, নির্বাচনে নয়, সেনা মোতায়েন হতে পারে একমাত্র জাতীয় বিপর্যয়কালে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট। ২০০১ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনী ছিল। সেনাবাহিনী থাকার পরও সেখানে দেখেছি নির্বাচনের পরপরই জামায়াত-শিবির ও বিএনপি সংখ্যালঘুদের ওপর হামলে পড়েছিল। কাজেই নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে জঙ্গি দমনে ভূমিকা রাখছে, তেমনি সুষ্ঠু নির্বাচনেও তারা যথেষ্ট। নির্বাচন কমিশনই এসব বিষয়ে ভূমিকা রাখবে। আমি কমিশনকে অযোগ্য মনে করি না।
সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমুলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক ঐক্য জরুরি উল্লেখ করে ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলার চেষ্টা করেছি। সুষ্ঠু ও নিরেপক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো—সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এ জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য খুবই জরুরি।
প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার কথা বলেছি। প্রত্যেক দল যেন ৩৩ শতাংশ নারীর নেতৃত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করে, সে বিষয়ে কমিশনকে পদক্ষেপ নিতে বলেছি। ভিন্ন কোনও নামে যেন জামায়াত নিবন্ধিত হতে না পারে, কমিশনকে তার জন্য সতর্ক থাকতে বলেছি।
বৃহস্পতিবার বিভিন্ন টেলিভিশন, রেডিও ও অনলাইন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপে বসবে ইসি।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ৩১ জুলাই থেকে সংলাপ শুরু করে ইসি। প্রথম দিন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সংলাপে অংশ নিয়ে নির্বাচনে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া, ‘না’ ভোট প্রবর্তন করাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন।
আগামী ২৪ আগস্ট থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করবে ইসি। ওই দিন সকালে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফের সংগে সংলাপ হওয়ার কথা রয়েছে। আর বিকাল ৩টায় বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের (মুক্তিজোট) সংগে বৈঠক হবে। পরে ২৮ আগস্ট সকাল ১১টায় বাংলাদেশ মুসলীম লীগ-বিএমএল আর বিকাল ৩ টায় খেলাফত মজলিশের সঙ্গে বসবে ইসি। ৩০ আগস্ট সকাল ১১ টায় বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির আর বিকাল ৩ টায় জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার সঙ্গে বসবে ইসি।
যেসব সুপারিশ এসেছে:
ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ পরে সংলাপে পাওয়া সুপারিশগুলো তুলে ধরেন সাংবাদিকদের কাছে।
১. সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন প্রত্যাশা করেন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা।
২. বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগ করার পরামর্শ
৩. সেনা মোতায়েনের পক্ষে বলেছেন কেউ কেউ; অধিকাংশই বলেছেন সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।
৪. না ভোটের পক্ষে-বিপক্ষে মত; কেউ ভালো বলেছেন, কেউ কেউ বিপক্ষে বলেছেন।
৫. দেশ-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
৬. গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বাংলায় করার পরামর্শ
৭. জনসংখ্যার ভিত্তিতে সীমানা পুননির্ধারণ করার পরামর্শ
৮. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি
৯. আচরণবিধি প্রয়োগে কঠোর হওয়ার পরামর্শ
১০. প্রবাসীদের ভোটার ও ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা
১১. নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ
১২. ধর্মকে কোনোভাইবে যাবে ভোটের প্রচারে ব্যবহার করতে না পারে
১৩. অবৈধ অর্থ ও পেশি শক্তির ব্যবহার রোধ
১৪. প্রার্থীদের হলফনামা প্রকাশ ও প্রচারের উদ্যোগী হতে হবে
১৫. নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও কাউকে যেন ভোকেন্দ্রে গিয়ে ফিরে আসতে না হয়
১৬. ইসিকে দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে
১৭. অনলাইনে মনোনয়ন নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে
১৮. লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে
১৯. ভোটার ও প্রার্থীর আস্থা তৈরি করতে হবে
২০. নারী ভোটার উপস্থিতি ও নারী নেতৃত্বের অগ্রগতি ধরে রাখতে ভূমিকা নিতে হবে।