ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

ব্যুত্থানের উত্থানে ইউরি বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৫:০২, ১৬ আগস্ট ২০১৭

ব্যুত্থানের উত্থানে ইউরি বিপ্লব

‘ব্যুত্থানে আদর্শ নিয়ে নির্ভয়ে/জীবন জয়ের পথচলা/বুদ্ধি, শক্তি ও প্রশান্তি ঘিরে/আত্মরক্ষার কলা’। চার লাইনের এই কবিতাটি যার লেখা তার পিতৃপ্রদত্ত আসল নামটি বেশ বড়, মোহাম্মদ আনোয়ারুল কামাল ইউরি (বিশ্বের প্রথম মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিনের নামানুসারে মা আমিনা আলম এবং বাবা শামসুল আলম তাদের প্রথম সন্তানের নাম রাখেন ইউরি)। এই নামে তাকে পাঠকদের চেনার কথা নয়। যদি বলি তার নাম আচার্য ইউরি বজ্রমুনি অথবা গ্র্যান্ডমাস্টার ড. ম্যাক ইউরি অথবা ব্যুত্থান মার্শাল আর্টের প্রতিষ্ঠাতা ও ১০ ডিগ্রী ব্ল্যাক বেল্ট সুপার হিউম্যান, তাহলে নিশ্চয়ই চিনে ফেলবেন তাকে। হ্যাঁ, ৫৩ বছর বয়সী ইউরি হচ্ছেন ব্যুত্থান মার্শাল আর্টের জনক, বজ্রপ্রাণ ধ্যান-সাধনা পদ্ধতির প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশ ব্যুত্থান এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক। বার্মিজ ব্যান্ডো মার্শাল আর্টসে সপ্তম ডিগ্রী ব্ল্যাক বেল্ট, বানশে মার্শাল আর্টসে পঞ্চম ডিগ্রী ব্ল্যাক বেল্ট আর ব্যুত্থান মার্শাল আর্টসের সর্বোচ্চ দশম ডিগ্রী ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া এই বিরল আশ্চর্য চল্লিশটিরও বেশি বিভিন্ন ধরনের ফাইটিং স্টাইলে পারদর্শী। মার্শাল আর্ট জগতে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচিত। পৃথিবীর ছয়টি শীর্ষস্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সর্বোচ্চ ক্যাটাগরিতে গ্রান্ডমাস্টার অফ দি ইয়ারহিসেবে অভূতপূর্ব স্বীকৃতি অর্জন করে পৃথিবীব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। ডিসকভারি চ্যানেলের দৃষ্টিতে বিশে^র সেরা পাঁচ শক্তিশালী মানুষের একজন তিনি। লাথি দিয়ে ভেঙ্গে ফেলতে পারেন টানা তিনটি বেসবল ব্যাট যা সাধারণ মানুষের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ব্যুত্থানের উত্থানের জন্য অনেক নীরবে-নিভৃতেই বিপ্লব ঘটিয়ে যাচ্ছেন প্রচারবিমুখ এই মানুষটি। অনেকের কাছেই ‘ব্যুত্থান’ খেলাটি অজানা। ভারত উপমহাদেশেই মার্শাল আর্টের আদি পীঠস্থান। কালক্রমে উপমহাদেশের গ-ি ছাড়িয়ে ‘আত্মরক্ষা কৌশল’ চর্চা ব্যাপক প্রসার ও পূর্ণতা পায় চীনের হুনান প্রদেশে শাওলিন টেম্পলে। পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়লেও ভারতীয় উপমহাদেশ তার মার্শাল আর্টের ঐতিহ্য ক্রমশ হারিয়ে ফেলে। প্রায় দীর্ঘ আড়াই হাজার বছর পর ড. ইউরি তার নিরলস প্রচেষ্টা ও একনিষ্ঠ গবেষণার মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় আত্মরক্ষামূলক পদ্ধতির হারানো গৌরব ও সোনালী ঐতিহ্য, ‘ব্যুত্থান’ পতাকাতলে পুনরুদ্ধারে ব্রতী হন। ব্যুত্থান চর্চা মানসিক চাপ কমায় এবং মনকে স্থির করে সজাগ ও মনোযোগী করে তোলে। ফলে দেহ ও মন হয়ে ওঠে নিরোগ। প্রতিরোধ ক্ষমতা হয় শক্তিশালী। এছাড়া আত্মরক্ষার বিষয়টি তো আছেই। যুব সমাজ- বিশেষ করে শিশুদের মানস গঠন ও নারীর ক্ষমতায়নে ব্যুত্থানের ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যুত্থান মাশাল আর্ট হলো প্রাচীন দক্ষিণ এশিয়ার আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধকলার ঐতিহ্যের ধারায় বিজ্ঞানভিত্তিক এক বাস্তবধর্মী আত্মরক্ষার পদ্ধতি, নিরাপদ ক্রীড়া ও সার্বিকভাবে জীবনকে কল্যাণময় করার কলা। ‘ব্যুত্থান’ সংস্কৃত শব্দ থেকে উদ্ভূত একটি বাংলা শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে প্রতিরোধ বা সনাতনকে সত্যদ্বারা প্রতিস্থাপন করবার এক বৈপ্লবিক পদ্ধতি। এর মাধ্যমে মানসিক ভীতি, বাধা, জড়তা এবং পেশী শক্তিবর্ধন ও সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত উন্নতি সাধন করা যায়। এছাড়াও ব্যুত্থান প্রশিক্ষণ মানুষের সদাচরণ, নেতৃত্বদান, নিয়মানুবর্তিতা, আত্মবিশ্বাস, মূল্যবোধ, সুস্বাস্থ্য, মনোসংযোগ ইত্যাদিরও উন্নয়ন ঘটায়। স্ব-ইচ্ছায় প্রতিরোধ ও পরিবর্তন সাধনের উদ্দেশ্যে মাদক, ধূমপান এবং সমজাতীয় অন্যান্য ক্ষতিকর বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে শক্তিশালী হতে সাহায্য করে এবং একটি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এবং পূর্ণাঙ্গ জীবন গঠনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন ইউরির নামের সঙ্গে ‘বজ্রমুনি’ শব্দটি কেন? বজ্রমুনি হচ্ছে শত বছরে ফোটা এক ফুলের নাম। ইউরি ভারতের ভার্মা কালাই আর চীনের শাওলিন মার্শাল আর্টের ঐতিহাসিক সম্পর্ককে পুনরাবিষ্কার করেন। এই অসামান্য অবদানের কারণে ভারতের প্রখ্যাত মার্শাল আট গুরু আসান ভাস্করন তার ছাত্র ইউরিকে ‘বজ্রমুনি’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ইউরি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় তার সহপাঠী ও জুনিয়রদের নিয়ে একটা ক্লাব গঠন করে শারীরিক প্রশিক্ষণের ওপর হাতে লিখে একটা ছোটখাটো হ্যান্ডবুক সবার মাঝে বিতরণ করেন। ১১ বছর বয়সে তিনি বার্মিজ বানশে ও ব্যান্ডো মার্শাল আর্টের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন। সেখানে নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় গঠন করেন ‘সেলফ ডিফেন্স সোসাইটি’। যেখানে আত্মরক্ষা, ইয়োগা ও ধ্যানচর্চা করা হতো। মার্শাল আর্টের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা আছে। সেগুলো জানতে ও শিখতে ইউরি তিব্বতের হিমালয় থেকে দক্ষিণ ভারত, মায়ানমার থেকে সুইজারল্যান্ড, প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্যÑ ৫০টিরও বেশি দেশে গিয়েছেন। মায়ানমারের প্রসিদ্ধ গ্র্যান্ডমাস্টার এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ব্যান্ডো এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খিং মং জি-এর সান্নিধ্য পেয়েছেন। তার কাছ থেকেই উত্তরাধিকারী এবং গ্র্যান্ডমাস্টার মনোনীত হন ইউরি। ইউরি দক্ষিণ ভারতের কেরালার মার্শাল আর্ট কালারিপায়াত্তুও রপ্ত করেছেন। মার্শাল আর্টের টানে কেবল ভিনদেশী মুসাফির হয়েই থেমে থাকেননি, এদেশের কিংবদন্তিদের সাহচর্যেও এসেছেন। কুষ্টিয়ার প্রখ্যাত প্রয়াত সিরাজুল হক চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশে লাঠি খেলার জনপ্রিয়করণের পথিকৃৎ। ‘ওস্তাদ ভাই’ বলে পরিচিত সিরাজুলের কাছে ইউরি শিখেছেন লাঠিখেলা। শুধু মার্শাল আর্টেই সীমাবদ্ধ ছিল না ইউরির আগ্রহ। সেই সঙ্গে তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে ভিন্ন ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন। ইংল্যান্ড থেকে ‘কাউন্টার সারভেলিয়েন্স’ ওয়ার্কশপ, লাটভিয়া থেকে স্পেশাল ফোর্সের কাছে সামরিক অস্ত্রের প্রশিক্ষণ গ্রহণ, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি একাডেমি থেকে কমিশন অফিসার্স কোর্স, ইংল্যান্ডের নিউ সুইন্ডন কলেজ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা দানের ওপর সর্বোচ্চ ‘এসআইএ লেভেল-৩’ ডিগ্রী অর্জন ... আরও কত কি! আরও আছেÑ তিনি বিস্ফোরক অনুসন্ধান ও চিহ্নিতকরণ, অগ্নিনির্বাপণ ও প্রতিরোধকরণ, বিভিন্ন স্থাপনা ও ক্ষেত্রে (যেমন বিমান, ব্যাংক, সুউচ্চ দালান) পরিপূর্ণ নিরাপত্তা প্রদানের ওপরও বিশেষভাবে পারদর্শী। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, সশস্ত্র বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। তার উদ্ভাবিত ‘ম্যাক ইউরি ব্যাটন’ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার করছে। তিনি আমেরিকান সোসাইটি অব ল’ এনফোর্সমেন্ট ট্রেনার্স অর্থাৎ এ্যাসলেটের প্রশিক্ষক সদস্য। ব্রিটিশ আর্মি রয়েল ইঞ্জিনিয়ার্সের অধীনে বিস্ফোরক সার্চ এ্যান্ড রিকগনিশন কোর্সও সম্পন্ন করেন। ফায়ার ট্রেনিং একাডেমি, ইংল্যান্ড থেকে ফায়ার মার্শাল কোর্স সম্পন্ন করেন ও ব্রিটিশ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিনি (এভিয়েশন লেভেল-৪) প্রশিক্ষণ শেষে সনদ অর্জন করেন। কোন সন্দেহ নেইÑ এসব যোগ্যতাই তাকে পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ক্ষেত্রে ‘আইকন’ ব্যক্তিতে পরিণত করে। ইউরি মার্শাল আর্ট ও ধ্যানবিজ্ঞানের ওপর একাধিক বই লিখেছেন (সহজ বজ্রপ্রাণ, হাইট অব জিরো, ডোর টু ইনফিনিটি, লাইট অব ডার্কনেস, ব্যুত্থান মেডিটেশন, এসেন্স অব মাস্টারি প্রভৃতি)। ২০০৬ সালে ভুটানের রাজকীয় পরিবার তাকে বাংলাদেশস্থ ভুটান দূতাবাসের বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে ‘সোনালি নখের শান্তির ড্রাগন’ উপাধিতে ভূষিত করে। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড গ্রান্ডমাস্টার্স কাউন্সিল কর্তৃক গ্র্যান্ডমাস্টার পিনাকল পুরস্কারসহ বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের পাঁচটি প্রধান হল অব ফেমে গ্র্যান্ডমাস্টার অব দ্য ইয়ার মনোনীত হন। এটি একটি বিরল রেকর্ড। সার্কভুক্ত দেশসমূহের দু শ’ কোটি মানুষের মধ্যে ইউরিই প্রথম ও একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ‘ওয়ার্ল্ড মার্শাল আর্ট হল অব ফেম আমেরিকা’ পদক লাভ করে গ্র্যান্ডমাস্টার অব দ্য ইয়ার-২০০৭ নির্বাচিত হন। ইউরির মাধ্যমে বাংলাদেশে ব্যুত্থান খেলার চর্চা শুরু ১৯৮১ সালে। শুরুটা হয় রাজশাহীর শিরোইল স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে। এরপর ধাপে ধাপে দেশের বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে-উপজেলা-জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। স্কুল-কলেজ এমনকি ক্যাডেট কলেজগুলোতেও (১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের আদেশক্রমে) খেলাটির অনুশীলন হয়েছে। গত দুই বছরে ব্যুত্থান এ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি একাডেমির সহযোগিতায় ৬৪ জেলার প্রায় ১২ হাজার প্রশিক্ষণার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ২০১০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এসএ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইভেন্ট হিসেবে ব্যুত্থান উপস্থাপন করা হয়। ২০১২ সালে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে বিষয় হিসেবে ব্যুত্থানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ব্যুত্থানের উত্থান ঘটাতে ইউরি তার নিজের জমি পর্যন্ত দান করেছেন। বান্দরবানের মেঘলায় ‘ব্যুত্থান বিদ্যাপীঠ’ নামের একটি স্কুল চালু করেছেন। এখানে আপাতত ২৫ জন ছাত্র আছে। ইউরি- ব্যুত্থান মার্শাল আর্টের ইতিহাসে এক বিস্ময়ের নাম। তার হাত ধরেই বাংলাদেশের নাম বিশ্ব দরবারে বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে। বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা পেলে খেলাটির আরও প্রসার ঘটবে বলে দৃঢ়বিশ^াস ইউরির।
×