ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়াহিদ নবি

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ১৫ আগস্ট ২০১৭

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র বহুদিনের। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালে জানতে পেরেছিলেন তাঁকে হত্যা করার জন্য দুজন হত্যাকারীকে পাঠানো হয়েছিল। দেরিতে প্রকাশিত মার্কিন কাগজপত্র মারফত আমরা অনেককিছুই জানতে পেরেছি, যা আমাদের আগে জানা ছিল না। দুর্ভাগ্যবশত এই ধরনের দলিলপত্রের বিশেষত্বই এমনি। সান্ত¡না হচ্ছে, ইংরেজীতে যেমন বলা হয়ে থাকে, ‘ইবঃঃবৎ ষধঃব ঃযধহ হবাবৎ’। মার্কিন কাগজপত্র ও অন্যান্য উৎস থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে যা জানা যায়, তাতে কিছু কিছু বিষয় সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা করা যায়। কিন্তু এখনও জল ঘোলা করার চেষ্টা করা হয়। অবশ্য জল ঘোলা করার এই কাজটি করে একটি বিশেষ মহল এবং তাদের আন্তর্জাতিক মিত্ররা। কিন্তু তবু আশ্চর্য লাগে যে, এই জল ঘোলা করার কাজটি তারা এখনও করে যাচ্ছে। কর্নেল ফারুক রহমান ও কর্নেল রশিদ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে যায়। সেখানে তারা অস্ত্র ক্রয় ও সরকার পরিবর্তনের কথা বলে। সত্যি আশ্চর্য হতে হয়। কোন এ্যাপয়েনমেন্ট ছাড়াই দুজন বিদেশী নাগরিক একটি দূতাবাসে যায় এবং দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচন করে! পশ্চিমা দেশগুলোর অফিস ইত্যাদি সম্পর্কে যাদের কিছু ধারণা আছে তারাই জানেন যে, এ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া আলাপ-আলোচনা একটি অসম্ভব ব্যাপার। তার চেয়েও আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, এই দুই ব্যক্তি সরকার পরিবর্তন ও অস্ত্র ক্রয় সম্বন্ধে আলোচনা করে। এদের একজন সিনিয়র অফিসারের পক্ষ থেকে এসেছে, বলেছে। এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর কী হতে পারত! এরপর কী হওয়া উচিত ছিল? সরকারকে কি ঘটনাটি জানানো উচিত ছিল না? বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের বিষয় হলে সরকার কি একজন মধ্যপদস্থ কর্মচারীকে পাঠাত কোন এ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া? মার্কিন দূতাবাসের কর্মচারীরা কি এসব বোঝেন না? কেন তারা বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের গোচরে আনল না? মুদ্রার অপর দিকটি হচ্ছে এই যে, যখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও তাদের সুহৃদের ক্ষমতা থেকে দূর করা হলো তখন বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক সরকার কি দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করার চেষ্টা করেছিল? বাংলাদেশের প্রথম সামরিক কর্মচারীর মার্কিন দূতাবাস পরিদর্শনের বেশ কয়েক বছর পর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। সে কি দৃশ্য! সেনাবাহিনীর দিশাহারা নেতৃত্বের অধীন সেনাবাহিনী সেনানিবাসে। উৎসাহী মধ্যপদস্থ সেনাবাহিনী রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে। শুনেছিলাম যে, এক মেজর, যিনি ছিলেন অন্যতম নেতা, প্রধান সেনাপতির কলার ধরে চেয়ার থেকে টেনে তুলে তাঁকে চেয়ারচ্যুত করেন। প্রধান সেনাপতির আসনে বসানো হয় সেই সিনিয়রকে, সেনা কর্মচারী হিসেবে যার কথা বলা হয়েছিল, যিনি অস্ত্র ক্রয়ের জন্য একজন মেজরকে পাঠিয়েছিলেন। এরপর কতসব কাহিনী! সেনাবাহিনীর ভেতরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অপারগ বা অনিচ্ছুক সেনাপ্রধানের কার্যকলাপ। একজন ব্রিগেডিয়ারের পদোন্নতি। মেজর থেকে কর্নেল হওয়া ব্যক্তিদের দেশত্যাগ। অফিসারদের মধ্যে খুনোখুনি। শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির জয়, যিনি নাকি মেজরদের পাঠিয়েছিলেন মার্কিন দূতাবাসে! পরে তিনি তাদের বাংলাদেশ হাইকমিশনে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন। এরপর দেখা গেল ক্ষমতার লড়াই। অভ্যুত্থানের পর অভ্যুত্থান। সেনাবাহিনীর শত শত ব্যক্তির ফাঁসির কাষ্ঠে মৃত্যুবরণ। পূর্ব পাকিস্তানকে হেনরি কিসিঞ্জার ‘তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’ বলে উপহাস করেন। এ কথার কী উত্তর আমরা দিতে পারি বাঙালী হিসেবে? উপদেশ দিতে পারি ইতিহাস পড়ার। বলতে পারি, একদিন ক্লাইভ বাংলাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী বলে বর্ণনা করেছিলেন। কিছু এসে যায় তাতে বাংলার ইতিহাসে? পাকিস্তানের ২৫ বছরের বঞ্চনার ইতিহাসে। কেন তিনি জানবেন না একাত্তর একদিনে আসেনি! অনেক আন্দোলন, অনেক কারাবরণ, অনেক রক্তপাতের পরে এসেছে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার সংগ্রাম। কিসিঞ্জারের ভাবনা কী করে সোভিয়েতবিরোধী রেখে, ভারতবিরোধী রেখে আমেরিকার পক্ষে রাখা যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে, সবকিছুর একটা সীমা আছে। কিসিঞ্জার সাহেব বাংলার স্বাধীনতা চান না। এটা তার ব্যাপার। তিনি পাকিস্তানকে নিয়ে খেলবেন। তা খেলুন। কিন্তু কিসিঞ্জার সাহেবরা তো গণতন্ত্রের কথা বলেন। বিশ্ব গণতন্ত্রের স্বনির্বাচিত নেতা তারা। ’৭০-এ পাকিস্তানের নির্বাচনের ফলাফল কী হয়েছিল কিসিঞ্জার সাহেবরা কি তা দেখেননি? পূর্ববঙ্গের মানুষ কী চায় আর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের কী দিয়েছিল, সেটা কি কিসিঞ্জার সাহেবরা দেখেননি? কিসিঞ্জার সাহেবরা কি বলতে পারেন যে, সেনাবাহিনীর ওইরূপ আচরণের পর পূর্ববঙ্গবাসী স্বাধীনতা ঘোষণা ছাড়া কী করতে পারত? কিসিঞ্জার সাহেব আইনের কথা বলেন। পিএলও ৮০ প্রসঙ্গে আইনের কথা বলেছিলেন। কিউবায় পাট রফতানি করার জন্য তিনি বাংলাদেশে চাল সরবরাহ বন্ধ করে দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা দখল করলে সেই একই কিসিঞ্জার সাহেব ঘোষণা করেন যে, পিএলও আইন আবার শুরু করা যেতে পারে। ভণ্ডামির চরম পর্যায় আমরা দেখেছিলাম। আমরা বাঙালী বলেই কি কিসিঞ্জার সাহেবের আমাদের ওপর বিরাগ? জিনিসটি ভেবে দেখার মতো। দু’-একজন বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব তার সম্বন্ধে কী ভাবেন? পাঠক আপনারা যারা হিচেনের বই ‘ক্রাইম এগেনেস্ট হিউমিনিটি’ পড়েছেন তারা জানেন হিচন কী ভাবেন কিসিঞ্জার সম্বন্ধে। কিন্তু কিসিঞ্জার সাহেবরা তো গণতন্ত্রের সোল এজেন্টের মতো। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের ইচ্ছার কোন মূল্য নেই। নির্বাচনের ফলাফলের কোন মূল্য নেই। এ কেমন গণতন্ত্র! কোন বিশেষ ব্যক্তির ইচ্ছা বেশি মূল্যবান এবং সে ইচ্ছার মূল্য দিচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষে কতজন মারা গেছে? সংখ্যা কেউ স্থির করে কিছু বলেনি। একটি স্বাধীন দেশের মানুষের ইচ্ছাকে অবজ্ঞা করে একজন বিদেশী ব্যক্তির ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করা হয়েছে। এটাই কি গণতন্ত্র? ক্রিস্টফার হিচেন তার ‘ক্রাইম এগেনেস্ট হিউমিনিটি’ বইয়ে দাবি করেছেন, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের জন্য কিসিঞ্জারের বিচার হওয়া উচিত। সিমর হার্শের বইয়ের নাম ‘দ্য প্রাইস অব পাওয়ার ঃ কিসিঞ্জার ইন নিক্সন হোয়াইট হাউস’। বইটির নামেই সব বোঝা যায়। আর কিছু বলার প্রয়োজন হয় না। লরেন্স লিপসুলজ অসংখ্য বছর কাটিয়েছেন বাংলাদেশ বিষয়ে গবেষণা করে। তার বই ‘বাংলাদেশ ঃ এ্যান আনফিনিশিড স্টোরি’ আমাদের বহু তথ্য জানায়। বঙ্গবন্ধুকে যে সময় হত্যা করা হয়েছিল অর্থাৎ গত শতাব্দীর সপ্তম দশকে, সে সময় সিআইএ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠন করে। বহু বিদেশী নেতা সিআইএ এজেন্টদের হাতে খুন হন। খোদ মার্কিন সরকার শঙ্কিত হয়ে পড়ে। চার্চ কমিটি ও পাইক কমিটি নামে নামে দুটি কমিটি গঠিত হয় তদন্ত করবার জন্য। কমিটি দুটি যথেষ্ট সহযোগিতা পায়নি। স্থানীয় জনপ্রিয় নেতাকে হত্যা করার পর একজন শিখ-ীকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। তারপর অনেক ঢাকঢোল বাজানো হয়েছে তাকে জনপ্রিয় করার জন্য। কিন্তু এসব কৌশল কাজে লাগেনি শেষ পর্যন্ত। লেখক : রয়াল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিশটের একজন ফেলো
×