ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায় ॥ পাল্টা কর্মসূচী

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১৩ আগস্ট ২০১৭

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায় ॥ পাল্টা কর্মসূচী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দল দুটির সমর্থিত আইনজীবীরা আজ রবিবার থেকে সারাদেশের আইনজীবী সমিতিতে তিন দিনের অভিন্ন কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতির কিছু পর্যবেক্ষণের পক্ষে ও বিপক্ষে অবস্থান নেয়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আইনজীবীরা আজ রবিবার এবং আগামী বুধ ও বৃহস্পতিবার সারাদেশের আইনজীবী সমিতিতে অভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচী ঘোষণায় দেশব্যাপী আদালতপাড়ায় টানটান উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। দুপক্ষই পরবর্তীতে আরও কঠোর কর্মসূচী পালনের হুমকি দেয়ায় সর্বোচ্চ আদালতের রায় নিয়ে ‘মাঠের রাজনীতি’ জমে উঠেছে। শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের ঐক্যবদ্ধ সংগঠন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ তিন দিনের কর্মসূচী ঘোষণা করে অভিযোগ করেছে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনার পথ সুগম করবে। রায়ে যেসব ‘আপত্তিকর, অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক, অপ্রাসঙ্গিক’ পর্যবেক্ষণ রয়েছে, সেগুলো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। এ দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আজ রবিবার এবং আগামী বুধ ও বৃহস্পতিবার (১৩, ১৬ ও ১৭ আগস্ট) দুপুরে সারাদেশের আইনজীবী সমিতিতে তিন দিনের প্রতিবাদ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা এবং আগামীতে কঠোর কর্মসূচী পালনের হুমকি দিয়েছে এ সংগঠনটি। এর আগের দিন শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিষয়ে বক্তব্য রাখায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের পদত্যাগের দাবিতে ওই তিন দিনের অভিন্ন কর্মসূচী ঘোষণা করেন বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলটির যুগ্ম-মহাসচিব ও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আদালতকে হেয় করে বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ এনে আজ রবিবার এবং আগামী বুধ ও বৃহস্পতিবার দেশের সব আইনজীবী সমিতিতে বিক্ষোভ কর্মসূচী পালনের এ কর্মসূচী ঘোষণা করেন। শনিবার সকালে ধানম-ির আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ অভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচী ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এমপি। উপস্থিত ছিলেনÑ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের আহ্বায়ক এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, কেন্দ্রীয় সদস্য এ্যাডভোকেট কাজী নজিবুল্লাহ হিরুসহ সিনিয়র আইনজীবীরা। আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতি যেসব অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য এবং পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা দেশের আইনজীবী সমাজকে সংক্ষুব্ধ এবং ব্যথিত করেছে। রায়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় সংসদ এবং অধস্তন আদালতের প্রতি মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচন কমিশন নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।’ ফজলে নূর তাপস বলেন, “ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে একটি দল ও মহল বিচারাঙ্গনকে ‘বিতর্কিত করার পাঁয়তারা’ করছে। আমরা আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে দেশবাসী দায়িত্বশীল আচরণ আশা করেন। বঙ্গবন্ধুকে ইঙ্গিত করে তিনি যে বক্তব্য লিখেছেন তাতে আইনজীবীসহ সারাদেশের মানুষ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। বিষয়টি আমাদের পবিত্র সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত ও মীমাংসিত। এছাড়া পর্যবেক্ষণে জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কটূক্তি করে এই প্রতিষ্ঠানকে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়েছে। সংসদকে হেয় করা মানেই গণতন্ত্রকে হেয় করা, জনগণকে হেয় করা। আমরা আইনজীবী অঙ্গন এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি।” তিনি বলেন, এমন পর্যবেক্ষণ অসাংবিধানিক ব্যক্তিদের ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করে। ফলে এসব মতামত-পর্যবেক্ষণ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে। রায় নিয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়াকে সমর্থনও জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ। এ প্রসঙ্গে ফজলে নূর তাপস বলেন, আমরা মনে করি গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক যথার্থই বলেছেন। তিনি বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক অপশক্তিকে ইস্যু তৈরি করে দিতে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি করার অপচেষ্টা চলছে। যারা দেশের স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করে না, দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে চায়, সরকার ও বিচার বিভাগকে যারা মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায়, বিচারাঙ্গনকে যারা অস্থিতিশীল করতে চায়, তাদের আইনজীবীরা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করবে।’ ফজলে নূর তাপস বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। আইনমন্ত্রী, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছেন। এতে আমরা মনে করেছি এ রায় নিয়ে কোন মহল বিচারাঙ্গনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কোন বক্তব্য দেবে না। কিন্তু একটি দল বিচারাঙ্গনকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করছে। আমরা আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মাননীয় প্রধান বিচারপতির প্রতি দেশবাসী দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে। বঙ্গবন্ধুকে ইঙ্গিত করে তিনি যে বক্তব্য লিখেছেন তাতে আইনজীবীসহ সারাদেশের মানুষ ক্ষুব্ধ। এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের আহ্বায়ক প্রবীণ আইনজীবী এ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, আমাদের এ বক্তব্য আদালতের বিরুদ্ধে নয়। রায়ে কিছু অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য এসেছে, যা দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। রায়ে বলা হয়, ‘এ দেশ একক নেতৃত্বে স্বাধীন হয়নি।’ এটা অসত্য ও বেদনাদায়ক। আদালতের বিরুদ্ধে নয়, আমরা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের বিরুদ্ধে কর্মসূচী দিয়েছি। বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট আবদুল বাসেত মজুমদার বলেন, রায়ের পর্যবেক্ষণে অপ্রাসঙ্গিক, অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক কিছু মন্তব্য করা হয়েছে। সেগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের কর্মসূচী। সূচনা বক্তব্যে আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আদালতের এ ধরনের পর্যবেক্ষণ অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত ও অপ্রাসঙ্গিক। আদালতের অনাকাক্সিক্ষত পর্যবেক্ষণের সুযোগ নিয়ে এবং রায়ের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে বিএনপি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা সারাদেশে আইনজীবীদের নিয়ে কর্মসূচী দিয়েছে। এ পর্যবেক্ষণ আমাদের ব্যথিত করেছে। স্বাধীনতায় বিশ্বাসী আইনজীবীরাও কর্মসূচী ঘোষণা করবে, সে কারণেই সাংবাদিকদের ডাকা হয়েছে।
×