ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ স্মরণে

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১২ আগস্ট ২০১৭

মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ স্মরণে

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ৯ম সেক্টরের সুন্দরবন সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ ২৮ জুলাই শুক্রবার দুপুরে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। জিয়াউদ্দিন আহমেদ ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি পিরোজপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক বাড়ি ভা-ারিয়ার মিয়াবাড়ী। তার পিতা আফতাব উদ্দিন আহমেদ পিরোজপুরের উকিল এবং পিরোজপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। জিয়াউদ্দিন ১৯৬৬ সালে পিরোজপুর সরকারী হাই স্কুল হতে এসএসসি এবং ১৯৬৮ সালে পিরোজপুর সোহরাওয়ার্দী কলেজ হতে এইচএসসি পাস করে একই কলেজে বিএ ভর্তি হন। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ছিলেন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে লে. জিয়াউদ্দিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটিতে পিরোজপুর আসেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তা পিরোজপুর পৌঁছে। ২৭ মার্চ পিরোজপুর আওয়ামী লীগের এমএনএ এনায়েত হোসেন খানকে বেসামরিক প্রধান এবং লে. জিয়াউদ্দিন আহমেদকে প্রতিরক্ষা প্রধান করে পিরোজপুর মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। পুলিশের ৫০০ রাইফেল দিয়ে জিয়াউদ্দিন মুক্তিফৌজ গঠন করে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। পিরোজপুর হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে তার দায়িত্ব দেয়া হয় আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সুবেদার তাজুল ইসলামকে। পিরোজপুর সংগ্রাম কমিটির সদস্য ছিলেন ডা: আবদুল হাই, ডা: ক্ষিতীশ চন্দ্র ম-ল, ডা: মোজাহার উদ্দিন এমপিএ, আলী হায়দার খান, ফজলুল হক খোকন প্রমুখ। লে. জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে সকল থানা, ইউনিয়নে মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষণ চলে। বরিশাল জেলা সচিবালয়ের সিভিল চীফ ছিলেন নুরুল ইসলাম মঞ্জু এমএনএ এবং প্রতিরক্ষা প্রধান ছিলেন মেজর এমএ জলিল। ২৫ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী বরিশাল দখল করে নেয় এবং গণহত্যা শুরু করে। ৫ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্নেল আতিক মালিক, ক্যাপ্টেন এজাজের নেতৃত্বে পিরোজপুরে গণহত্যা শুরু করে। তারা পিরোজপুরের এসডিও আবদুর রাজ্জাক, ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান, এসডিপিও ফয়জুর রহমান, ছাত্রনেতা ফজলুল হক খোকন, ছাত্র বিধান চন্দ্র হালদার, জিয়াউজ্জামান, গণপতি হালদার প্রমুখকে হত্যা করে বলেশ্বর নদীতে ফেলে দেয়। মঠবাড়িয়ার এমপিও সওগাতুল আলম সগীর তার দল নিয়ে ভারতে চলে যান। পিরোজপুর মহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি এমএনএ এনায়েত হোসেন খান মুজিবনগর সরকার গঠনে অংশ নেন। লে. জিয়াউদ্দিন আহমেদ সুন্দরবনে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার লে. জিয়াউদ্দিনকে সুন্দরবন সাব-সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করে। বাগেরহাট মহকুমা সুন্দরবন সাব-সেক্টরের অধীন ছিল। মোরেলগঞ্জের শামসুল হক তালুকদার সহঅধিনায়ক এবং কবির আহমদ মধু মোরেলগঞ্জ, শহিদুল আলম বাদল, আলতাফ মঠবাড়িয়া এবং মজিবল হক মজনু শরণখোলা থানা কমান্ডার ছিলেন। শামসুদ্দিন আজাদ লে. জিয়াউদ্দিনের সচিব ছিলেন। নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিল। তার স্টাফ অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন ওবায়দুর রহমান মোস্তফা, সেক্টরের সহঅধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা, সেক্টর এ্যাডজুটেন্ট মহম্মদ ফজলুল হক এমপিএ, সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগÑ সাতক্ষীরা, ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরÑ বরিশাল, ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমামÑ পটুয়াখালী, সেনাবাহিনীর হেমায়েত উদ্দীনÑ গোপালগঞ্জ, উত্তর বরিশাল। দক্ষিণ জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন আবদুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ। ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন সুন্দরবনে ১০০টি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প গঠন করেন। তার ছিল ১৮০ কমান্ডার, সুন্দরবনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদের মধ্যে মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিল। পাকবাহিনী জলে, স্থলে ও বিমান দিয়ে সুন্দরবন আক্রমণ করে। ১২ দিন যুদ্ধের পর পাকবাহিনী তাদের গানবোট নিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তাকে ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি দেয়। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি ২৬০০ বর্গমাইল সুন্দরবন নিয়ন্ত্রণ করেন। সুন্দরবন মুক্ত থাকায় পটুয়াখালী, বরিশালের শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে পশ্চিম বাংলায় যেতে পারে। জিয়াউদ্দিন ছিলেন সুন্দরবনের মুকুটহীন রাজা। তার অধীনে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১০ হাজারে দাঁড়ায়। তিনি জুলাই মাসে পশ্চিম বাংলার বশিরহাট নবম সেক্টর হেডকোয়ার্টারে যান। ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী ও সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তিনি ৩৪ জন নৌ কমান্ডো, ১০০০ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং ১৬০০ মাইল শক্তিসম্পন্ন বেতারযন্ত্র নিয়ে সুন্দবনের তেঁতুলবাড়িয়া ক্যাম্পে ফিরে আসেন। তার তত্ত্বাবধানে মংলা সমুদ্রে বন্দরে ১৫ আগস্ট নৌ কমান্ডো অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তানের ১৩টি জাহাজ ধ্বংস করা হয়। পুনরায় ১৫ সেপ্টেম্বর নৌ কমান্ডো মংলা বন্দর আক্রমণ করে কয়েকটি বিদেশী জাহাজ ধ্বংস করে। ১৫ অক্টোবর ক্যাপ্টেন জিয়ার নির্দেশে শহীদুল আলম ও শামসুল হক তালুকদারের নেতৃত্বে মঠবাড়িয়া তুষখালী খাদ্য গুদাম আক্রমণ করে ৬০০০ মণ খাদ্য সুন্দরবন ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন পাকিস্তানী দালাল ও রাজাকারদের কঠোর শাস্তি দিতেন। ৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী শরণখোলা থানা আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আসাদ, আলাউদ্দিন, জোবায়ের আহমদ আলতাফ, গৌরীপদ শহীদ হন। এ সময় ক্যাপ্টেন জিয়া জীবনপণ করে পুনরায় যুদ্ধ করে মোরেলগঞ্জ দখল করেন। বাগেরহাট, মোরেলগঞ্জ, ভা-ারিয়া, কাউখালী সুন্দরবন বাহিনীর দখলে আসে। ৭ ডিসেম্বর পাকবাহিনী পিরোজপুর থেকে পালিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন জিয়া পিরোজপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। জেনারেল ওসমানী ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনকে জানান যে, মার্কিন সপ্তম নৌবহর দুবলারচর থেকে ৭ মাইল দূরে সমুদ্রে অবস্থান করছে। এ সময় ক্যাপ্টেন জিয়ার বেতারযন্ত্রে সপ্তম নৌবহরের অবস্থান ধরা পড়ে এবং তিনি তা মিত্র বাহিনীকে জানিয়ে দেন। ইতোমধ্যে রাশিয়ার নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করলে সপ্তম নৌবহর পালিয়ে যায়। পিরোজপুরের জনগণ বিজয়ী ক্যাপ্টেন জিয়াকে ঐতিহাসিক সংবর্ধনা জানায়। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলো। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। ক্যাপ্টেন জিয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি মেজর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এ সময় মেজর জিয়াউদ্দিন সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত ছিলেন। খুনীদের সম্পর্কে তার নিকট গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল। ১৯৮৩ সালে তিনি সুন্দরবনের দুবলারচরে মৎস্য ব্যবসা শুরু করেন। তিনি জেলেদের নিরাপত্তা প্রদান ও ডাকাত দমনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি দুবলারচর ও সুন্দরবনে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করেন। তিনি সুন্দরবন সংরক্ষণ ও জেলে, মৎস্য ব্যবসায়ী এবং শ্রমিকদের কল্যাণে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি একবার ডাকাতের গুলিতে আহত হন এবং অল্পের জন্য বেঁচে যান। তিনি ছিলেন বনদস্যুদের নিকট আতঙ্ক। মেজর জিয়া তার জীবনের সুন্দর দিনগুলো ব্যয় করেছেন সুন্দরবনে। তিনি ১৯৭১ সালে সুন্দরবনে থেকে যুদ্ধ করে সুন্দরবনকে প্রচ- ভাল বেসেছেন। ১৯৭১ সালের রণাঙ্গন সকলে ত্যাগ করলেও মেজর জিয়া সুন্দরবন ত্যাগ করেননি। তিনি ১৯৮৯ সালে পিরোজপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আওয়ামী লীগ সংসদ নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন দেয়নি। অথচ তিনি ছিলেন পিরোজপুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। তাকে রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদান করা হয়নি। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। সাক্ষীর তালিকায় ২৮ নম্বরে লেখা আছে এএইচ জিয়াউদ্দিন আহমেদ। তিনি একজন সুবক্তা, লেখক ও টিভি ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধে সুন্দরবনের সেই উন্মাতাল দিনগুলো’। মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণের জন্য নবম সেক্টর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতি গঠন করেন। নবম সেক্টর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষায় আমৃত্যু কাজ করেছেন। তিনি বরিশাল বিভাগ ও পিরোজপুর জেলার উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তিনি ছিলেন বরিশাল বিভাগ সমিতির উপদেষ্টা। সুন্দরবনের মুকুটহীন সম্রাট বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দিনকে বীরউত্তম ও স্বাধীনতা পদক প্রদান করে সম্মানিত করার দাবি জানাচ্ছি। জয় জিয়াউদ্দিন- জয় বাংলা। লেখক : সাবেক এসডিও (১৯৭৫), বরগুনা
×