ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুই কোটি টাকার চিংড়ি পোনা আটকের নেপথ্যে ঘের মালিক সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৯ জুলাই ২০১৭

দুই কোটি টাকার চিংড়ি পোনা আটকের নেপথ্যে ঘের মালিক সিন্ডিকেট

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে গত দুই মাসে কোটি টাকার বাগদা চিংড়ির পোনা পাচারের সময় আটক করেছে উপজেলা প্রশাসন। সীতাকু-ের সহকারী কমিশনার ভূমি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রুহুল আমীনের নেতৃত্বে দফায় দফায় অভিযান পরিচালিত হয়েছে। পর্যাপ্ত চাহিদা আর ঘের মালিকদের অপতৎপরতার কারণে চট্টগ্রাম থেকে চিংড়ি পোনা পাচার হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলে। নদী ও সমুদ্র থেকে এসব চিংড়ি পোনা অবৈধভাবে ধরা হচ্ছে তাদের নিয়োজিত লোক দিয়ে। পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে রাতের আঁধারে এসব চিংড়ির পোনা ধরা হচ্ছে কর্ণফুলী নদী ও সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা বাঁশখালী, আনোয়ারা, চর পাথরঘাটা, দক্ষিণ কাট্টলী ও কুমিরার বিভিন্ন স্পট থেকে। তবে চিংড়ি পোনা পাচারের সঙ্গে জড়িতদের ধরেতে ওৎপেতে আছে জেলা মৎস্য অধিদফতর ও জেলা প্রশাসন। তবে পাচারকারীরা অতি মুনাফা অর্জনের নেশায় মেতে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, রাস্তায় মেট্রো ও জেলা পুলিশের চেক পোস্ট থাকার পরও কিভাবে এসব পোনা পাচার হচ্ছে। এসব মূল্যবান পোনা পাচারের পেছনে যারা কাজ করছে তাদের আইনের আওতায় এনে কোন পদক্ষেপ না নেয়া হলে মৎস্য সম্পদ ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মৎস্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, আটককৃত প্রায় ৪৫ লাখ চিংড়ি পোনার আনুমানিক বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৯০ লাখ টাকা হলেও ভবিষ্যত মূল্য প্রায় কয়েক কোটি টাকা। কারণ এসব চিংড়ি খুলনার সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট এলাকার হাজারো ঘেরে এসব চিংড়ি পোনা বড় হওয়ার পর যখন কেজিতে ১২/১৪টিতে রূপ নেয় তখনই আবার কেজি ১ হাজার টাকা থেকে ১২শ’ টাকায় চট্টগ্রামের নামীদামী বাজারগুলোতে বিক্রি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী মৎস্য সম্পদকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। সিন্ডিকেট করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মিঠা পানির চিংড়ি পোনার পাশাপাশি চট্টগ্রামসহ সমুদ্র উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকা থেকে চিংড়ি পোনা দ্রুতগামী পরিবহনের মাধ্যমে সংগ্রহ করছে। বিশেষ করে খুলনাকেন্দ্রিক চিংড়ি ঘেরগুলোতে সামুদ্রিক চিংড়ির কদর বেশি থাকায় চট্টগ্রামের ওপর এসব সিন্ডিকেটের নজরদারি অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, বিশেষ করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চল থেকে পিকআপে করে চিংড়ি পোনা পাচার হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলে। মশারি জাল দিয়ে নদী ও সমুদ্র থেকে এসব পোনা ধরতে গিয়ে বিভিন্ন জাতের মাছের পোনা ধরা হচ্ছে। মূলত, একমাত্র চিংড়ি পোনা ছাড়া অন্য জাতের পোনাগুলো দীর্ঘ সময় পরিবহনযোগ্য না হওয়ার কারণে পথিমধ্যে মরে যাচ্ছে। তবে সিন্ডিকেটের টার্গেট করে চিংড়ি পোনা নদী ও সমুদ্র থেকে হাতছাড়া হলেও ঘের মালিকদের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামে এসব চিংড়ি পোনা প্রতি হাজার দেড় হাজার টাকা হলেও দক্ষিণাঞ্চলে এসব চিংড়ি পোনা প্রতি হাজার ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সড়ক পথে দ্রুতগামী পিকআপ ও মিনি ট্রাকযোগে কক্সবাজার থেকেও চিংড়ি পোনা চলে যাচ্ছে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন স্থানের ঘেরগুলোতে। এদিকে, সড়ক পথে পুলিশ প্রশাসন চেকপোস্ট বসিয়ে মাদকসহ অস্ত্রের চালান আটকের ঘটনা ঘটলেও চিংড়ি পোনা আটকের কোন নজির নেই। পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করেই ঘের ব্যবসায়ীরা চিংড়ি পোনা পাচারের সঙ্গে জড়িত। এ ব্যাপারে মোবাইল টিমের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সীতাকুন্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুহুল আমিন জনকণ্ঠকে জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার উপস্থিতিতেই অভিযান পরিচালিত হয়েছে। বাসের চালক ও সহকারী আরও কয়েকদফায় এ ধরনের চালান পাচার করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়। মৎস্যসম্পদ বিনষ্ট হওয়া বন্ধে ও সামুদ্রিক চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধিতে কুমিরা ঘাটে এসব পোনা প্রায় একঘণ্টা সময়ের মধ্যে অবমুক্ত করা হয়। সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের ধরতে পারলে এ ধরনের পাচার রোধ করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় তথা আনোয়ারা, বাঁশখালী, কাট্টলী, কুমিরা ও কর্ণফুলী নদী এলাকায় খুলনাকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটের লোকজনই এসব পোনা ধরছে। সীতাকুন্ড উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে খুলনাগামী সাউদান পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে ৬ লাখ বাগদা চিংড়ির পোনা উদ্ধার করা হয়েছে। ৩০টি পাতিলে করে নেয়ার সময় প্রায় ১২ লাখ টাকা মূল্যের এসব পোনা জব্দ করার পর কুমিরা ঘাটে আবার অবমুক্ত করা হয়। এ ঘটনায় বাসের চালক, দুই সুপারভাইজার ও দুই হেলপারকে মোট ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একইভাবে বুধবার রাতেও সীতাকু-ের বাস স্টপেজ থেকে শাহপরাণ পরিবহন নামক একটি বাসের লাগেজ পকেট ও ছাদ থেকে ৫৩টি পাতিল ও ২০টি ড্রামে ভর্তি ১৫ লাখ বাগদা চিংড়ি উদ্ধার করা হয়। এসব চিংড়ি পোনার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৩০ লাখ টাকা। এর আগে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত দুমাসে খুলনাগামী এসপি লাইন (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৯৫৫১) পরিবহন থেকে ১২৫টি ড্রামভর্তি প্রায় ৪০ লাখ টাকা মূল্যের সাড়ে ২৪ লাখ চিংড়ি পোনা এবং আরেক অভিযানে, সীতাকু-ের বড় দারোগা হাট এলাকায় খুলনাগামী মীম জাল পরিহনের (খুলনা-ব-১১-০১০৫) গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ১৬টি ড্রাম ভর্তি সাড়ে চার লাখ টাকা মূল্যের ৩ লাখ চিংড়ি পোনা উদ্ধার করা হয়। এসব গাড়ির সুপারভাইজার, ড্রাইভার ও হেলপারদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়। পরে এসব চিংড়ি পোনা কুমিরা ঘাটে অবমুক্ত করা হয়।
×