ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম হোতা রাশেদ গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৯ জুলাই ২০১৭

হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম হোতা রাশেদ গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অবশেষে বহুল আলোচিত ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গী হামলার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড রাশেদ ওরফে র‌্যাশ ওরফে আবু জাররা গ্রেফতার হয়েছে। হামলার নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে রাশেদ অন্যতম। তাকে ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। শুক্রবার ভোরে পুলিশ সদর দফতরের এলআইসি (লফুল ইন্টারসেপশন) শাখা, পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট, বগুড়া ও নাটোর জেলা পুলিশ সম্মিলিতভাবে অভিযান চালায়। অভিযানে নাটোর জেলার সিংড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে রাশেদ গ্রেফতার হয়। নিজস্ব সংবাদদাতা কালিদাস রায় নাটোর থেকে জানান জেলার পুলিশ সুপার মোঃ আসাদুজ্জামানের বরাত দিয়ে জানান, রাশেদ সিংড়া থেকে অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিল। এ সময় আসলাম হোসাইন ওরফে মোহন ওরফে মোহন রানা ওরফে রাশেদুল ইসলাম রাশেদ ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। নিজস্ব সংবাদদাতা বিশ্বজিৎ মনি নওগাঁ থেকে জানান, গ্রেফতারকৃত রাশেদের পিতার নাম আব্দুস সালাম। বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের কাঞ্চনপুর গ্রামে। রাশেদ ও তার বাবা আব্দুস সালাম গত বছরের জুনে মান্দার নিজ বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়। এরপর থেকে পরিবারের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ নেই বাবা-ছেলের। রাশেদের পরিবার ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, পরিবার ও এলাকাবাসীর কাছে মোহন নামেই বেশি পরিচিত আসলাম। ৭ থেকে ৮ বছর আগে আর্থিক অনটন ও মামলার কারণে আব্দুস সালাম তার স্ত্রী নাসিমা বেগম, ছেলে আসলাম ওরফে মোহন ও মেয়ে জেসমিন আক্তারকে নিয়ে রাজশাহীর নওহাটা এলাকার মথুরা নওদাপাড়ায় তার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বসবাস শুরু করে। আসলামের মা নাসিমা বেগম জানান, গত বছরের ১১ রোজায় (জুন মাস) ঢাকা যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয় মোহন। এর দুই-তিন পর তার বাবাও নিখোঁজ হয়। এরপর থেকেই তাদের সঙ্গে পরিবারের আর কোন যোগাযোগ নেই। এখন তারা কোথায় কী অবস্থায় আছে তারা কিছুই জানেন না। ছেলে গ্রেফতার হয়েছে কি-না তাও এখন পর্যন্ত জানেন না বলে তিনি দাবি করেন। তিনি আরও জানান, আসলাম রাজশাহীর নওহাটা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে। পরে রাজশাহী মডেল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়। উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করা অবস্থায় নিখোঁজ হয় সে। এর কয়েকদিন পরে তার বাবাও নিখোঁজ হয়। তার চাচা আবুল কালাম আজাদ জানান, মোহনের বাবা আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে ৭ থেকে ৮ বছর আগে চেক ডিজঅনারের একটি মামলা হয়। মামলার পরপরই পরিবার নিয়ে তিনি রাজশাহীতে শ্বশুরবাড়ি চলে যান। এরপর থেকে ভাই ও তার পরিবারের সঙ্গে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। তারাও আর কোনদিন গ্রামের বাড়িতে আসেননি। মান্দা থানার ওসি আনিছুর রহমানের বরাত দিয়ে নাটোর থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা আরও জানান, রাশেদ বা আবু জাররা নামে মান্দায় কেউ তাকে চেনে না। ধারণা করা হচ্ছে, আসলাম হোসেনই জঙ্গী রাশেদ। তাদের পরিবার কাঞ্চনপুর গ্রাম থেকে রাজশাহীতে চলে গেছে। আসলামের বাবা আব্দুস সালাম চেক ডিজঅনার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। তারা পারিবারিকভাবেই জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আব্দুস সালাম বর্তমানে পলাতক। পরে তাকে ঢাকায় নিয়ে যায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। শীঘ্রই গুলশান হামলার চার্জশীট শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর গুলিস্তানে অলিম্পিক ডে উপলক্ষে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, নাটোর থেকে গ্রেফতারকৃত জঙ্গী রাশেদ গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ডদের অন্যতম। হামলার সময় সে নেতৃত্ব দিয়েছিল। গুলশান হামলা মামলার পলাতক আরও যেসব আসামি আছে তাদের ধরার চেষ্টা চলছে। আশা করি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পলাতকদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হবেন। পুলিশ হলি আর্টিজান হামলা মামলার চার্জশীট তৈরির কাজ করছে। শীঘ্রই গুলশানের হলি আর্টিজান মামলার চার্জশীট দেবে পুলিশ। গত বছরের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা করে জঙ্গীরা দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও সতেরোজন বিদেশী ও তিন বাংলাদেশীসহ মোট ২২ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে তিনজন নারী রয়েছেন। হত্যার দায় স্বীকার করে ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএসের নামে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। হলি আর্টিজানের ঘটনার পর সারাদেশে চলমান সাঁড়াশি অভিযানের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট রাজধানীর আজিমপুরের লালবাগ সড়কের ২০৯/৫ নম্বর পাঁচতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় অভিযান চালায়। অভিযানের সময় আত্মহত্যা করেন নব্য জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য তানভীর কাদেরী। গ্রেফতার হয় তার স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা আশা ওরফে খাদিজা ও তার ছেলে তাহরিম কাদেরী ওরফে আবির ওরফে রাসেল ওরফে অনিক ওরফে মুয়াজ ওরফে ইসমাইল, পলাতক নব্য জেএমবির শীর্ষপর্যায়ের নেতা জামান ওরফে বাসারুজ্জামান ওরফে চকলেটের স্ত্রী শায়লা আফরিন ও গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজানের স্ত্রী আফরিন ওরফে প্রিয়তি। ইতোমধ্যেই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নুরুল ইসলাম মারজান, তামিম চৌধুরী ও মেজর জাহিদসহ অনেক জঙ্গী নিহত হয়েছে। আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া তিন শিশুকে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আজিমপুর থেকে এক বছরের শিশুপুত্র নিয়ে পালিয়ে যায় মেজর মুরাদের স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা। গ্রেফতারকৃত তিন নারী ও এক কিশোর সবাই নব্য জেএমবির আত্মঘাতী দলের সদস্য। গ্রেফতারকৃত আবেদাতুল ফাতেমা এক মাস পর গত বছরের ১০ অক্টোবর ঢাকার সিএমএম আদালতের বিচারক মোঃ নূর নবীর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। এর আগে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর আশার ছেলে আজিমপুরের আস্তানা থেকে গ্রেফতারকৃত আত্মঘাতী কিশোর জঙ্গী তাহরিম কাদেরী ঢাকার সিএমএম আদালতের বিচারক মোহা. আহ্সান হাবীবের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়। তাহরিম কাদেরীর (১৪) জবানবন্দীতে প্রকাশ পায় হলি আর্টিজানে হামলার নানা অজানা কাহিনী। তাহরির তার জবানবন্দীতে জানায়, ঢাকার পল্লবীর বাসায় থাকার সময় বাসারুজ্জামান চকলেট (গুলশান হামলার পলাতক আসামি), মুসা ও রাশেদ ওরফে র‌্যাশ (শুক্রবার নাটোর থেকে গ্রেফতারকৃত) আসত। র‌্যাশকে উত্তরার বাসা থেকে চিনতাম। র‌্যাশ পল্লবীর বাসায় থাকার সময় বাসারুজ্জামান ও কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গী আকিফুজ্জামানের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। কল্যাণপুরের অপারেশনের দিন তানভীর কাদেরী জানায়, চকলেট, মুসা ও র‌্যাশ তাদের জিহাদের সাথী ভাই। তারা তাদের বাসায় সিরিয়ার যুদ্ধের ভিডিও দেখাত। আইএসের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত দাবিক ম্যাগাজিন পড়তে দিত তাদের। দাবিক ম্যাগাজিনের কয়েকটা বাংলাতেও ছিল। রমজান মাসের সময় রাশেদ তার পিতা তানভীর কাদেরীকে পল্লবীর বাসার পাশাপাশি বসুন্ধরায় বাসা নিতে বলে। টেনামেন্ট-৩ নম্বর বাড়ির ছয়তলার এ/৬ নম্বর ফ্ল্যাটে ওঠে তারা। ওই বাসায় সাদ, মামুন, উমর, আলিফ ও শুভ নামে পাঁচজন পরবর্তীতে থাকা শুরু করে। পরে তামিম চৌধুরী ও মারজান ওই বাসায় যায়। পরে তামিম, মারজান ও চকলেট তাদের বাসায় ব্যাগে করে অস্ত্র নিয়ে যায়। তারা একটি বড় অপারেশন করবে বলে জানায়। গুলশান হামলার পর বিষয়টি সে বুঝতে পারে। ওই দিন বিকেলে সাদ, মামুন, উমর, আলিফ ও শুভ কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বের হয়। তারা বের হওয়ার সময় তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করে বলে, ‘জান্নাতে গিয়ে দেখা হবে ইনশা আল্লাহ’। এরা বের হওয়ার পর তামিম আর চকলেট বের হয়ে যায়। যাওয়ার সময় চকলেট তার পিতা তানভীর কাদেরীকে দ্রুত বাসা ছেড়ে চলে যেতে বলে। পরে তারা বাসা ছেড়ে পল্লবী চলে যায়। সেখানে যাওয়ার পর জানতে পারি হলি আর্টিজানে গোলাগুলি হচ্ছে। তখন বুঝতে পারি হলি আর্টিজানে অপারেশন হচ্ছে। সকালে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহতদের ছবি প্রকাশের পর দেখি সাদ হচ্ছে মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসের ছাত্র নিবরাস ইসলাম, মামুন হচ্ছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, উমরের আসল নাম খায়রুল ইসলাম পায়েল বাঁধন, আলিফের প্রকৃত নাম শফিউল ইসলাম উজ্জ্বল ও শুভর মূল নাম স্কলাসটিকার ছাত্র মীর সালেহ মোবাশ্বের। এরপর কয়েকদিন পর র‌্যাশ জানায়, চকলেটকে পাওয়া যাচ্ছে না। র‌্যাশ দ্রুত তাদের বাসা পরিবর্তনের কথা বলে। তারা রূপনগর ও আজিমপুরে দুটি বাসায় থাকা শুরু করে। তাহরিম কাদেরীর জবানবন্দীতে প্রকাশ পাওয়া হলি আর্টিজানের র‌্যাশই হচ্ছে রাশেদ, যাকে বহুদিন ধরেই গ্রেফতারের চেষ্টা করছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্টাফ রিপোর্টার রাজশাহী থেকে জানান, গুলশান হামলার মূল পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম আসলাম হোসাইন ওরফে মোহন ওরফে রাশেদুল ইসলাম রাশেদ ওরফে ‘জঙ্গী র‌্যাশ’ প্রায় দেড় বছর ধরে নিখোঁজ ছিল। গত বছরের ১১ রমজান (জুন মাস) থেকে সে নিখোঁজ। চিকিৎসক হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে রাজশাহী শহরে লেখাপড়া করতে আসা জঙ্গী আসলাম ওরফে র‌্যাশ শুক্রবার ভোরে নাটোরের সিংড়া থেকে গ্রেফতার হয়। টুন্ডা সোহেলের তথ্যে রাশেদ গ্রেফতার ॥ ডিএমপি কমিশনার বিডিনিউজ জানায়, গুলশান হামলার ‘অন্যতম পরিকল্পনাকারী’ টুন্ডা সোহেলের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই হামলার আরেক সন্দেহভাজন আসলাম হোসাইন রাশেদ ওরফে রাশেদুল ইসলাম ওরফে র‌্যাশকে নাটোর থেকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া। শুক্রবার বিকেলে মিরপুরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘হলি আর্টিজানে যেসব জঙ্গী হামলা চালিয়েছিল, তারা সবাই ঘটনাস্থলে মারা গেছে। পরে পুলিশ তদন্ত করে অনেক তথ্য পায়, ওই সব তথ্যের ভিত্তিতে এর আগে জঙ্গী টুন্ডা সোহেলকে গ্রেফতার করা হয়। সোহেল মাহফুজ পুলিশকে জানায়, সে সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দেশে এনে রাশেদকে দিত, আর রাশেদ সে সব অস্ত্র-গোলাবারুদ তামিমসহ অন্যান্য জঙ্গীদের কাছে সরবরাহ করত। এই হাতকাটা সোহেলের দেয়া তথ্য থেকে র‌্যাশকে নাটোর থেকে ধরা হয়েছে। শনিবার তাকে আদালতে তোলা হবে। পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলছেন, আদালত অনুমতি দিলে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে হামলার বিষয়ে তার কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা করা হবে।
×