ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইয়াবার আগ্রাসন ঠেকাতে সাঁড়াশি অভিযান চলবে সারাদেশে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৯ জুলাই ২০১৭

ইয়াবার আগ্রাসন ঠেকাতে সাঁড়াশি অভিযান চলবে সারাদেশে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দেশে ইয়াবার আগ্রাসন ঠেকাতে জল, স্থল ও সীমান্ত পয়েন্টগুলোতে এবং দেশের ভেতরে একযোগে সাঁড়াশি অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি ভেজাল ইয়াবা তৈরিতে ব্যবহৃত অন্যতম প্রধান উপকরণ সিওড্রএফিড্রিন আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কাশির ওষুধ তৈরিতে বিকল্প রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে। মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়া ইয়াবা চোরাচালান বন্ধ করতে কোস্টগার্ড, বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ), পুলিশ, র‌্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে একটি সম্মিলিত কৌশল ঠিক করা হয়েছে। ইয়াবা চোরাচালান ঠেকাতে নাফ নদীতে মাছ ধরা পরীক্ষামূলকভাবে সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। ওই সময় জেলেদের সরকারীভাবে খরচ চালানোরও। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পর ইয়াবা চোরাচালান ঠেকাতে করণীয় ঠিক করতে আগামী ২০ থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসছে বাংলাদেশের ১২ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল। বৈঠকে কূটনৈতিক সম্পর্কের আরও উন্নয়ন, সন্ত্রাসী ও অস্ত্রগোলাবারুদ সংক্রান্ত বিষয়াদি ছাড়াও ইতোপূর্বে হস্তান্তর করা মিয়ানমারে থাকা ইয়াবা তৈরির ল্যাবরেটরি বন্ধ ও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারসহ নানা ইস্যুতে আলোচনা হবে। ইতোমধ্যেই সরকারের আইন মন্ত্রণালয় ইয়াবাকে দেশের এক নম্বর মাদক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দুই শ’ গ্রামের বেশি ইয়াবা বহনকারীদের শাস্তি যাবজ্জীবনের পরিবর্তে মৃত্যুদ- করে আইন পাস হচ্ছে। দীর্ঘ অনুসন্ধান, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। ইয়াবা আসলে কি? চিকিৎসা বিজ্ঞান মতে, ইয়াবা মূলত একটি ওষুধ। বহু যুগ থেকেই এ ওষুধ ব্যবহারের প্রচলন লক্ষণীয়। এটি মানুষের ওজন কমাতে এবং ক্ষুধামন্দায় ব্যবহৃত হয়। এ ট্যাবলেট সেবন করলে ক্ষুধামন্দা হবে। কিছু খেতে ইচ্ছে করবে না। আর না খাওয়ার ফলে স্বাভাবিকভাবেই শরীর দুর্বল হওয়ার কথা। কিন্ত তা হবে না। শরীর, মন, মেজাজ সবই ফুরফুরে থাকবে। এর ফলে ওজন কমবে। আগে ডাক্তাররা কোন কোন রোগীকে সপ্তাহে বা পনের দিনে একটি করে ট্যাবলেট সেবন করার অনুমতি দিতেন। তবে অতিরিক্ত সেবন করলে আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। হালে চিকিৎসকরা আর কোন রোগীকে ওষুধ হিসেবে ইয়াবাকে আর প্রেসক্রাইব করছেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিকদের মধ্যে সরকারীভাবে এ ট্যাবলেট সরবরাহ করা হতো। এটি এমন একটি ট্যাবলেট, যা সেবন করলে অন্তত ৭২ ঘণ্টা ঘুম আসবে না। শরীর ক্লান্ত হবে না। অথচ শরীর থাকবে সুস্থ ও সবল। যুদ্ধ ময়দানে আপদকালীন মুহূর্ত মোকাবেলা করে টিকে থাকতে সৈন্যদের এ ওষুধ সরবরাহ করা হতো। ইয়াবা সেবনকারীদের ভাষ্য রাজধানীর ইস্কাটন এলাকায় অবস্থিত একটি বিখ্যাত স্কুলের কয়েকজন ইয়াবা সেবী ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে পিলে চমকানোর মতো তথ্য। তারা বলছে, স্কুলটির অনেকেই ইয়াবায় আসক্ত। এর মধ্যে মেয়েরাও রয়েছে। যার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তারা ইয়াবা পাচ্ছে পাশের হাতিরঝিল লাগোয়া বস্তি থেকে। বাংলামোটরসহ আশপাশের এলাকায় ইয়াবার ছড়াছড়ি। হাত বাড়ালেই ইয়াবা পাওয়া যায়। মান ভেদে দাম ২শ’ থেকে চার শ’ টাকা। তাদের বক্তব্য, সেবনের তিনদিন পর আর সেবন না করলে গভীর ঘুম আসবে। টানা প্রায় দুইদিন ঘুমালেও ঘুম শেষ হবে না। চোখে সব সময় ঘুম ঘুম ভাব থাকবে। যারা আর জীবনে সেবন করবেন না, তারা ঘুমিয়ে হয়তো নেশা কাটিয়ে থাকেন। কিন্তু ইয়াবার নেশা এমন নেশা, যা বারবার মানুষকে আকৃষ্ট করে। ফলে সেবন করার একদিন বা দুইদিন পরেই আবার সেবন করে। ইয়াবা সেবনের পর মানুষের মধ্যে এক ধরনের বাড়তি উত্তেজনা কাজ করে। এমন উত্তেজনা থেকেই নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। ইয়াবাসেবীদের মধ্যে একক বা গণধর্ষণ করার প্রবণতা বেশি। তারা নিজেরাও স্কুলের সহপাঠী মেয়েদের সঙ্গে ইয়াবা সেবন করে স্কুল ফাঁকি দিয়ে অবৈধ শারীরিক মেলামেশা করেছে। কোন কোন দিন থেকে তিনজন ছাত্র মিলে এক বা একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে আবার কোন কোন দিন এক বা দুইজনের সঙ্গে চার থেকে পাঁচজন ছাত্র মিলে অবৈধ মেলামেশা করেছে। ইয়াবা সেবনের পর এমন অবৈধ মেলামেশাকে তাদের অপরাধ বলে মনে হয়নি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে ইয়াবা সেবনের প্রবণতা বেশি। ইয়াবার জনপ্রিয়তার নেপথ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গবেষণা ও নিরোধ শাখার তথ্য মোতাবেক ইয়াবা আকারে অত্যন্ত ছোট। সহজে বহনযোগ্য। একটি ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম দুই থেকে চার শ’ টাকা। সহজলভ্য। গাঁজার চেয়েও হালে ইয়াবা বেশি পাওয়া যায়। চোখ কান খোলা রাখলে হাত বাড়ালেই ইয়াবা মেলে। সিগারেট টানলে গন্ধ করে। আর ইয়াবা সেবন করলে মুখে বা গায়ে বা কাপড়ে কোন গন্ধ থাকে না। শরীর বা মুখ থেকে কোন প্রকার খারাপ বা সন্দেহজনক গন্ধ বের হয় না। উল্টো মুখ থেকে বিস্কুট বা কোন সুগন্ধির মতো গন্ধ বের হয়। এতে করে ইয়াবা সেবনের পর যে কোন পরিবেশে গিয়ে কথাবার্তা বলা বা চলাফেরা করা সহজ। ইয়াবা গাঁজা সেবন করলে চোখ লাল হয়। চোখে নেশার ভাব থাকে। এ্যালকোহল সেবন করলে মুখে দুর্গন্ধ বের হয়। চোখে নেশার ভাব থাকে। আর ইয়াবা সেবন করলে এর কিছুই পরিলক্ষিত হয় না। এ জন্য ইয়াবা হালে এত জনপ্রিয়। বিশেষ করে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে ইয়াবা হালের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেশা। ইয়াবার ক্ষতিকর দিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল মেডিসিন বিভাগের ডিন ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ এ বি এম আব্দুল্লাহ জানান, ইয়াবা সেবনে শরীরে নানা নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে লিভার, কিডনী, হার্ট ও মস্তিস্ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে। দীর্ঘ সময় ইয়াবা ট্যাবলেট সেবনে মানুষের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যায়। কোন ইয়াবাসেবী নির্ধারিত সময়ে বা ইয়াবাসেবী যে সময়ে ইয়াবা সেবন করে, সেই সময়ে ইয়াবা সেবন করতে না পারলে উত্তেজিত হয়ে মানুষকে হত্যাও করতে পারে। ইয়াবাসেবীরা এ মাদক সেবনের টাকা যোগাড় করতে অনেক সময়ই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তারা খুন থেকে শুরু করে হেন কোন অপরাধ নাই, যা তারা করতে পারে না। দীর্ঘ সময় ইয়াবা সেবনে শরীর শুকিয়ে যায়। শরীরে ঘা হয়। যা আস্তে আস্তে শরীরে ক্যান্সারের সৃষ্টি করে। ইয়াবার কারণে মারাত্মক ধরনের সামাজিক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে খ্যাতিমান অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলছেন, ইয়াবা সেবনে সমাজে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, খুন ও ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। দেশের স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইয়াবার প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঘিরে ইয়াবার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইয়াবাসেবী ছাত্রদের মানবিক গুণাবলী আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। তারা নেশার ঘুরে অনেক অনৈতিক ও অবৈধ কাজকে বৈধ বলে জ্ঞান করছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজে। স্বল্প সময়ের মধ্যে ইয়াবার আগ্রাসন বন্ধ করা না গেলে, অদূর ভবিষ্যতে দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মরণ নেশা ইয়াবা মারামারি আকারে ছড়িয়ে পড়বে। দেশ মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। আস্তে আস্তে মেধাহীন হয়ে পড়বে শিক্ষার্থীরা। ভবিষ্যতে দেশের ওপর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যেই ইয়াবার কারণে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ, জাতি, সমাজ, শিক্ষাব্যবস্থাসহ অনেক কিছুই। যেভাবে অভিনব পন্থায় মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসে কোস্টগার্ড, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আনার সবচেয়ে অভিনব কৌশল হচ্ছে রশ্মি পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে প্রতিটি নৌকার নিচের তলায় একটি লোহা বা স্টিলের বা কাঁঠের রিং লাগানো থাকে। সেই রিংয়ের সঙ্গে থাকা লম্বা রশি। আর রশির মাথায় ইয়াবা প্যাকেট পলিথিনে মুড়িয়ে তার সঙ্গে ইট বা পাথর বা ভারী কোন জিনিস বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। নৌকা মাছ ধরতে ধরতে ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত নৌকার কাছে এসে বা কোন কোন সময় সরাসরি কক্সবাজারে এসে ইয়াবার চালানটি হস্তান্তর করে চলে যায়। নৌকার তলায় এ পদ্ধতিতে ইয়াবা আনার কারণে সমুদ্রের ভেতরে পানিতে নেমে নৌকার তলায় কি আছে তা তল্লাশি করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এমন সুযোগটিকে কাজে লাগায় চোরাকারবারীরা। এছাড়া মাছের পেটে পলিথিনে মুড়িয়ে এবং নৌকার কাঠের পাটাতনের ফাঁকেও ইয়াবার চালান আসে। দেশের ভেতরে ইয়াবা স্থানান্তরের অভিনব কৌশল মাছের পেটে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে পলিথিনে মুড়িয়ে ইয়াবার প্যাকেট আনা হয়। ওই মাছের চালান আড়তে আনার পর ইয়াবা বের করে তা বিক্রি করে দেয়া হয় সিন্ডিকেটের কাছে। চট্টগ্রাম থেকে আসা সামুদ্রিক মাছের পেটে সবচেয়ে বেশি ইয়াবার চালান আসে। অনেক নারীকে দিয়ে তাদের শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় ইয়াবার চালান নিয়ে আসে। নারীদের ওইসব স্পর্শকাতর জায়গায় সাধারণত তল্লাশি চালানোর কোন সুযোগ থাকে না। পলিথিনের ভেতরে ইয়াবা ঢুকিয়ে তা খেয়ে পেটের ভেতরে করেও ইয়াবার চালান আনা হয়। মোটরসাইকেলের হেলমেটের ভেতরে থাকা সাদা নরম ফোম সরিয়ে তার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয় ইয়াবার প্যাকেট। এসব হেলমেট এত সুন্দর করে মেরামত করে দেয়া হয় যে, দেখে বোঝার উপায় থাকে না। হেলমেটের ভেতরে যে ইয়াবা রয়েছে, তা সাধারণত কোন মানুষের মনে আসার কথা নয়। ওইসব মোটরসাইকেলের আরোহীরা খুবই দামী পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করে মাথায় ইয়াবা লুকিয়ে রাখা হেলমেট দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। আরোহীরা এসব হেলমেট একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে পরিবর্তন করে। তারা আবার ঠিক একই হেলমেট পরিধান করে আসে। ধরার কোন পথ থাকে না। এসব মোটরসাইকেলের সামনে পুলিশ, র‌্যাব, আইনজীবী, ডাক্তার, সংবাদপত্রসহ নানা কিছু লেখা থাকে। রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তল্লাশি এড়াতেই এমন কৌশল নেয় পাচারকারীরা। কলমের ভেতরের সবকিছু ফেলে দিয়ে তার মধ্যে ইয়াবা ঢুকিয়ে পকেটে রেখে স্থানান্তর করা হয়। গাড়ির দরজার কভার খুলে তার ভেতরে থাকা ফাঁকে ফাঁকে ইয়াবার প্যাকেট আনা হয়। এসব গাড়ির অধিকাংশই পাজেরো ও প্রাডোর মতো দামী গাড়ি। গাড়িগুলোতে ফ্লাগস্টাড লাগানো থাকে। প্রসঙ্গত, ফ্লাগস্টাড লাগানো গাড়ি সরকারী পদস্থ কর্মকর্তারা ব্যবহার করে থাকেন। এসব গাড়ির সামনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার লেখা এবং মনোগ্রাম সংবলিত নকল লগ বই রেখে দেয়া হয়। সাধারণত সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া দামী গাড়িতে এবং সরকারী গাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চালানোর নজির কম। এমন সুযোগটিকে কাজে লাগাতেই এই কৌশল নেয় ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। মেয়েদের চুলের বেণীর ফাঁকে ইয়াবা আনা হয়। আগে সিগারেটের প্যাকেট ও ম্যাচের বাক্সে করে ইয়াবা আসত। এখন এই কৌশল পুরনো। এখন সিগারেটের ভেতরের তামাক ফেলে দেয়া হয়। তার ভেতরে ইয়াবা ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আর সিগারেটের সামনের কিছু অংশে তামাক ভরে রাখা হয়। প্যাকেট থেকে যে কেউ কোন সিগারেট শলাকা বের করলে ভাবতেও পারবে না, এই সামনের তামাকের পরেই ইয়াবা ট্যাবরেট রয়েছে। প্রতিটি সিগারেটের ভেতরে ২০ থেকে ২৫টি ইয়াবা ট্যাবলেট ধরে। সে হিসেব মোতাবেক ২০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের ভেতরে ২০ করে ৪শ’ টি আর প্রতি শলাকায় ২৫টি করে সাড়ে ৪শ’ টি ইয়াবা ট্যাবলেট আনা সম্ভব। ম্যাচের বাক্সে এখন আর ইয়াবা আসে না। হালের সবচেয়ে অভিনব পন্থা বাচ্চাদের চিপসের প্যাকেটে করে ইয়াবার চালান আনা। যেসব মহিলা ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত তারা অন্তত দুইটি বাচ্চা সঙ্গে করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসে। বাচ্চাদের হাতে চিপসের প্যাকেট ধরিয়ে দেয়া হয়। এসব চিপসের প্যাকেটে প্রকৃতপক্ষে কোন চিপস থাকে না। চিপসগুলো বের করে তার জায়গায় ইয়াবা ট্যাবলেট ভরে দেয়া হয়। আর চিপসের প্যাকেট সুপার গ্লু দিয়ে আটকিয়ে দেয়া হয়। বাচ্চারা চিপসের প্যাকেট হাতে করে বিভিন্ন জায়গায় নেমে তা নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করে দেয়। এছাড়া ক্র্যাচের ভেতরে অভিনব পন্থায় ইয়াবার চালান আনার বিষয়টি ধরা পড়ে কক্সবাজার থেকে আসা এক যুবক বয়সী ইয়াবা ব্যবসায়ী ধরা পড়ার পর। ওই যুবক পুরোপুরি সুস্থ। অসুস্থতার ভান করে সে একটি ক্র্যাচ নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে করে কমলাপুর নামে। তার মাথায় নামাজের টুপি। পরনে পাঞ্জাবি-পায়জামা। খুবই স্বাভাবিক এবং সাধারণ একজন ধর্মপ্রাণ যুবক হিসেবে সবাই মনে করবেন। ডিবি পুলিশ তাকে ধরার পর সবকিছুই তল্লাশি করে। কিন্তু কোথাও ইয়াবা নেই। শেষ পর্যন্ত ক্র্যাচে তল্লাশি চালালে বেরিয়ে আসে ইয়াবা ট্যাবলেট। ট্যাবলেটগুলো পলিথিনে মুড়িয়ে ক্র্যাচের পাইপের ভেতরে ভরে রাখা হয়েছিল। আর হাতলের ভেতরেও একই কায়দায় রাখা হয়েছিল প্রায় চারশ’ ইয়াবা ট্যাবলেট। ওই যুবক জানায়, ইতিপূর্বে সে একই কায়দায় সাতটি ইয়াবার চালান ঢাকায় এনে বিক্রি করেছে। অষ্টম চালান আনার সময় সে ধরা পড়ে। এছাড়া পশু বহনকারী যানবাহন, বাস, মালামালসহ ট্রাক, সবজিসহ নানা মালামালের সঙ্গে ইয়াবার চালান আনা হয়। দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তরফ থেকে জানানো হয়, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ। আগামী ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। অধিদফতরের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, প্রকৃতপক্ষে দেশে মাদকসেবনকারীর সংখ্যা অন্তত দেড়কোটি। এরমধ্যে এককোটি মাদকাসক্ত। বাকি ৫০ লাখ মাদকসেবী নিয়মিত মাদক সেবন করেন না। তবে একটি পর্যায়ে তারাও নিয়মিত মাদক সেবন করে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। মাদকসেবীদের মধ্যে ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রতিদিন দেশে অন্তত একশ’ কোটি টাকার মাদক সেবন হয়। এরমধ্যে ইয়াবা সেবন হয় প্রায় ৭৫ কোটি টাকার। বাকি টাকায় অন্যান্য মাদকের পেছনে ব্যয় করে মাদকসেবীরা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ সারাদেশের মাদক নিরাময় কেন্দ্রের চিত্র সারাদেশে সরকার অনুমোদিত ১৬০টি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। এর দেখভাল করে থাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এগুলোকে হাসপাতালও বলা হয়। এমনই একটি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মূল ভবনের ভেতরেই। নিরাময় কেন্দ্রটিতে মাদকাসক্ত সাবালক পুরুষদের জন্য ৪০টি এবং শিশু মাদকাসক্তদের জন্য ১০টি সিট রয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এছাড়া মাদকাসক্ত নারীদের চিকিৎসার জন্যও নিরাময় কেন্দ্রটিতে বেশ কিছু সিট রয়েছে। নিরাময় কেন্দ্রে ৮ বছরের মাদকাসক্ত শিশু রয়েছে জানিয়ে সেখানকার একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, এটিকে নিরাময় কেন্দ্র বলা মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ এখানে যারা আসেন তারা সারাজীবনের জন্য মাদক থেকে দূরে সরে যান, তার কোন নজির নেই। ২৫ থেকে ৩০ বছর পরেও কোন কোন মাদকসেবীর মাদক সেবন করার নজির রয়েছে। কারণ মাদকের রাসায়নিক উপাদান রক্তের মধ্যে থেকে যায়। যা যেকোন সময় মাদক সেবন থেকে দূরে থাকা ব্যক্তিকে মাদকের পথে টানতে পারে। এই চিকিৎসক জানান, প্রতিদিন এখানে অন্তত ১০ জন মাদকাসক্ত নারী, পুরুষ ও শিশু আসে। মাদকাসক্তরা নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। পুরুষদের বেশিরভাগই বস্তির বাসিন্দা। মাদকাসক্ত শিশুদের অর্ধেকই বস্তি বা পথশিশু। এরা বস্তিতে হরহামেশাই মাদক সেবন করতে দেখে। ফলে এদের মধ্যে মাদক সেবন করার আগ্রহ জন্মায়। এছাড়া হতাশা, বঞ্চনা থেকেও মাদক সেবনের নজির ভূরি ভূরি। যারা চিকিৎসাধীন তাদের প্রত্যেকের জীবনেই এভাবেই মাদক গ্রহণ শুরু হয়েছে। আর মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের সন্তানদের মাদক সেবনের শুরুটা এখন খুবই অভিনব। এসব পরিবারের সন্তানদের পকেটে যথেষ্ট টাকা থাকে। টাকার কারণে, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডায় গিয়ে, ঘনিষ্ঠদের পীড়াপীড়িতে, নিজেদের হিরু প্রমাণ করতে, অন্যের ওপর জেদ করে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, পিতামাতার মধ্যে কলহের কারণে পরিবারে অশান্তির ফলে, পারিবারিক কলহের কারণে, পরিবারের মধ্যে মাদক সেবনের রেকর্ড থাকলে, পিতামাতা, ভাইবোন বা পরিবারের কারো অবহেলা- অনাদরে, অতিরিক্ত শাসনের কারণে, সেবনের পর মুখে বা গায়ে বা পোশাকে কোন দুর্গন্ধ না হওয়ার কারণে, কারও টের পাওয়ার সুযোগ না থাকার কারণে ইয়াবার প্রতি আসক্ত হয়। এই চিকিৎসক বলছেন, অনেককেই দেখা গেছে, তারা ধূমপান করে না। এতে করে পরিবারের লোকজন দারুণ খুশী। সন্তান ধূমপানই যেহেতু করে না, তাহলে নেশা করার প্রশ্নই আসে না। এটি পুরোপুরি একটি ভ্রান্ত ধারণা। কারণ ইতোমধ্যেই তাদের কাছে অনেক ইয়াবায় আসক্ত নারী পুরুষ এসেছে, যারা জীবনে একবারও ধূমপান করেনি। অথচ তারা মারাত্মকভাবে ইয়াবায় আসক্ত। হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের প্রায় শতভাগই ইয়াবায় আসক্ত। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অতিরিক্ত শাসনের ফলে সন্তানাদির মন বিগড়ে যায়। তারা শুধু ফাঁক খুঁজে বেড়ায়। যখনই সুযোগ পায়, তারা ইয়াবার মতো গন্ধহীন মাদক সেবন করে মানসিক যন্ত্রণা ভুলে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে। মাদক সেবন করলে কোন মানুষের মনের যন্ত্রণা দূর হয় না। বরং বেড়ে যায়। সাময়িকের জন্য সে নেশার ঘোরে থাকে। নেশার ঘোর তার কাছে বাস্তবতা থেকে ভিন্নরকম অনুভূতি দেয়। এই অনুভূতির কারণে ওই মাদকাসক্ত মনে করেন, মাদক সেবনের ফলে তার মনের যন্ত্রণা দূর হয়েছে। এটি তার মনের একটি ভ্রান্ত ধারণা। এরা এক ধরনের মানসিক রোগী। বিষয়টি শুধু মানসিক ব্যাপার। আসলে মাদক সেবন করার পুরো প্রক্রিয়া বা ভাবনাটিই একটি মানসিক বিষয়। এই চিকিৎসক বলছেন, কোন স্বামী যদি মাদকাসক্ত হয়, তাহলে তার স্ত্রীর গর্ভে সন্তান আসার পর থেকেই ওই সন্তানের ওপর প্রভাব পড়তে থাকে। তবে তা খুবই যতসামান্য। সন্তান বড় হওয়ার পরেও পিতা যদি মাদকাসক্ত থাকেন, তাহলে বড় হওয়ার পর সন্তানের ওপর মাদকের প্রভাব পড়তে বাধ্য। তবে ব্যতিক্রমও আছে। শতকরা ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আর মা যদি মাদকাসক্ত হয়। তাহলে তার প্রভাব পড়ে সরাসরি। সন্তান গর্ভে আসার পর পরই তার দেহে থাকা রক্তে নেশাদ্রব্যে থাকা রাসায়নিক পদার্থের প্রভাব পড়ে। মা মাদকাসক্ত হলে নবজাতকের বিকলাঙ্গ বা শারীরিক কোন সমস্যা নিয়ে সন্তান জন্ম নেয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। স্বাভাবিক সন্তান হওয়ার পর ওই সন্তানের মাদকাসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ৮৫ ভাগ। এর প্রধান কারণ মাদকাসক্ত মায়ের সরাসরি প্রভাব। এই চিকিৎসক জানান, পথশিশু ও বস্তির শিশুদের মধ্যে পরিবেশগত কারণে মাদকাসক্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ্যণীয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, একই মাদকাসক্ত বার বার এসেছেন। আর মাদক এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ যা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শরীরের রক্তে না যেতে পারলে মাদকসেবীর নানা ধরনের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। যেমন কারও কারও খিচুনি হয়, বমি বমি ভাব হয়, অনেকে পাগলের মতো আচরণ করতে থাকেন, অহেতুক নিজের মনেই কথাবার্তা বলতে থাকেন, শরীরের কোথাও না চুলকালেও অযাচিতভাবে শরীর চুলকায়, মাথায় বা হাতে ধারালো বা অন্যকোন কিছু দিয়ে আঘাত করে। এমন বহু উপসর্গ দেখা যায়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, শরীরে মাদকের উপাদান প্রবেশ না করার প্রতিক্রিয়া। যে যে মাদক সেবন করে, সেই মাদক সেবন করার পরেই তারা আবার স্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। মাদকসেবীদের চিকিৎসা নিয়ে টানাপোড়েন বাংলাদেশ সাইকিয়াটিস্ট সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডাঃ মোহিত কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, মাদকাসক্তদের চিকিৎসা নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মধ্যে এক ধরনের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের আইন মোতাবেক মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য সারাদেশে অধিদফতরটির বেশ কিছু নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে; যা অধিদফতর নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আসলে এখানে একটি বড় ধরনের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। মাদক বিষয়টিই মানসিক। কোন মানুষ যখন মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, এরপর তার চিকিৎসা দেয়ার দায়িত্ব চিকিৎসকদের। মাদক রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। এই পদার্থ মানুষের রক্ত, মাংস, শরীর, মন, ব্রেন, কিডনি, লিভারসহ মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করে। এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চিকিৎসা করে থাকেন চিকিৎসকরা। তাই মাদকাসক্তদের চিকিৎসার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে থাকা উচিত। অথচ এর দায়িত্ব রয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছে। ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞান মোতাবেক মাদকাসক্তদের শতভাগ সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে না। অনেক মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসক নেই। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নেই। তার অভিযোগ, হালে মাদকাসক্ত থেকে সঠিক পথে আসা ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এসব প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা মাদকাসক্তদের চিকিৎসা করবেন; যা একেবারেই একটি ভ্রান্ত ধারণা। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকবে। কারণ তারা চিকিৎসক নয়। একজন মাদকাসক্তকে চিকিৎসা বিজ্ঞান মোতাবেক চিকিৎসা দিতে হবে। অন্যথায় তাকে মাদকের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা কঠিন। এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হলে এক সময় মাদকাসক্তে দেশ ভরে যাবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উচিত দেশে মাদকের আগ্রাসন কমানো। মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দেয়া নয়। মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের। অভিযোগ রয়েছে, মাদকাসক্ত নিরাময়ের হাসপাতাল খুলে ব্যবসা করতেই এবং দেশী-বিদেশী অর্থ হাতিয়ে নিতে একটি মহল কাজ করছে। এই চক্রের সঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। যারা নিরাময় কেন্দ্রগুলো অধিদফতরের অধীন রাখতে চায়। তাদের অনুমতিতেই নিরাময় কেন্দ্র স্থাপিত হবে। তারা এর থেকে বাড়তি সুবিধা পাবেন। আসলে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। ভেজাল ইয়াবায় দেশ সয়লাব সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী দেশী-বিদেশী চক্রের কারণে দেশে ইয়াবার আগ্রাসন বন্ধ হচ্ছে না। এরমধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভেজাল ইয়াবা। গত বছর খোদ ঢাকা থেকেই সাতটি এবং চট্টগ্রামে কয়েকটি ভেজাল ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেফতার হয় অন্তত ৪৫ জন। গ্রেফতারদের বরাত দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া ইয়াবার শতকরা ৮৫ ভাগই ভেজাল। আর গ্রেফতারের অধিকাংশই কোন না কোন সময় বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিতে কেমিস্ট ছিল। ভেজাল ইয়াবা প্রস্তুতকারীদের একটি সিন্ডিকেট বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিতে কর্মরত কেমিস্টদের টার্গেট করে থাকে। তাদের টার্গেটের শিকার হয় অনেকেই। ইয়াবা ট্যাবলেট তৈরির প্রধান উপাদান এমসিটামিন নামের রাসায়নিক পদার্থ। পদার্থটি বাংলাদেশের কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি সরকারী অনুমোদন নিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। এসব ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে উচ্চমূল্যে ভেজাল ইয়াবা ব্যবসায়ীরা এমসিটামিন কিনে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাজারে বর্তমানে পাওয়া যাওয়া ৩ প্রকারের ইয়াবা ট্যাবলেটই ভেজাল। সাংকেতিক ভাষায় যাকে বড়মাল বলা হয়, সেটি মিয়ানমারের তৈরি সুপার ইয়াবা। এটি মিয়ানমার থেকে আসা আসল ইয়াবা। এমন এক হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট গুঁড়ো করে এর সঙ্গে ভেজাল রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে অন্তত ৫ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট তৈরি করা হয়। এর বর্তমান বাজার মূল্য ৪ থেকে ৫শ’ টাকা। এসব ইয়াবা ট্যাবলেটে আসল ইয়াবা ট্যাবলেটের উপাদান থাকে। তবে তা খুবই সামান্য পরিমাণ। এই ভেজাল ইয়াবা ট্যাবলেটটি বাজারে সুপার ইয়াবা নামে পরিচিত। এছাড়া আর কোন ইয়াবা ট্যাবলেটে আসল ইয়াবার ট্যাবলেটে থাকা উপাদান মেলেনি। চম্পা সুপার নামে বিক্রি হওয়া দ্বিতীয় ধাপের ইয়াবা ট্যাবলেটের পাইকারি দাম প্রতিপিস ২ থেকে ৩শ’ টাকা। আর শুধু চম্পা নামে বিক্রি হওয়া ইয়াবা ট্যাবলেটের পাইকারি দাম ৮০ থেকে ২শ’ টাকা। এসব ইয়াবা ট্যাবলেটে এমসিটামিন নামক কেমিক্যালের কোন উপাদানই থাকে না। ইয়াবা ব্যবসায়ীর সংখ্যা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের নিরোধ ও গবেষণা শাখা সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে অন্তত ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। এরমধ্যে ঢাকায় পাইকারি ও খুচরা মাদক বিক্রেতার সংখ্যাই অন্তত ১৫ লাখ। বাকি ১৫ লাখের মধ্যে ১০ লাখ ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের। বাকি ৫ লাখ ব্যবসায়ী দেশের বিভিন্ন জেলায়। অধিকাংশ ব্যবসায়ীই ইয়াবা ও হেরোইন ব্যবসায় জড়িত। ইয়াবাগুলো মিয়ানমার থেকে জলপথে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম হয়ে স্থল ও আকাশপথে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ইয়াবা আসছে। ইয়াবা বন্ধে সরকারের উদ্যোগ সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইয়াবার আগ্রাসন বন্ধ করতে কড়া নির্দেশ জারি করেন। তিনি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে ইয়াবা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আলোচনা করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলছেন, সমাজকে সুশৃঙ্খল করতে এবং সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করতে মাদকের বিষয়ে কোন আপোস করার সুযোগ নেই। সমাজ থেকে চিরতরে মাদক ধ্বংস করে দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। মাদকের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। সীমান্তে পথে যাতে কোন প্রকার মাদক দেশে প্রবেশ করতে না পারে এজন্য কড়া নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলছেন, ইয়াবাকে দেশের এক নম্বর মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা ও অপারেশন্স বিভাগের পরিচালক পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের পর মিয়ানমার সরকার ইয়াবার বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি হয়েছে। যদিও আগেও বেশ কয়েক দফায় মিয়ানমারের সঙ্গে ইয়াবা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। তবে কোন চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। বহুবার আলোচনা হওয়ার পর মিয়ানমারের দায়িত্বশীলরা চুক্তিতে স্বাক্ষর না করেই বৈঠক শেষ করেছেন। সম্প্রতিও এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনার পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি জানানো হয়। এরপর সরাসরি প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেন। তিনি আরও জানান, সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইয়াবার বিষয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। তাতে দেশে ইয়াবার আগ্রাসন, ব্যবহার, অভিযান, ব্যবসায়ীর সংখ্যা, সেবনকারীর সংখ্যাসহ বহু বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে সিওড্রএফিড্রিন আমদানি বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। দ্রুত এই রাসায়নিক পদার্থ আমদানি বন্ধ করতে যাচ্ছে সরকার। অভিযোগ রয়েছে, ওষুধ তৈরির জন্য অনেক কোম্পানি এই রাসায়নিক পদার্থ আমদানি করে উচ্চমূল্যে ভেজাল ইয়াবা তৈরিকারকদের কাছে বিক্রি করছে। এজন্য সরকার এই রাসায়নিক পদার্থ আমদানি নিষিদ্ধ করছে। কাশির সিরাপ তৈরিতে ব্যবহৃত এই রাসায়নিক পদার্থ ভেজাল ইয়াবা তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাঁশির ওষুধ তৈরির জন্য বিকল্প রাসায়নিক পদার্থ আনার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৩০ জেলা ও ১২৯ উপজেলা ভারতের সীমান্ত লাগোয়া। আর মিয়ানমারের সীমান্তের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে বাংলাদেশের তিনটি জেলা ও সাতটি উপজেলার। দুটি দেশ থেকেই ইয়াবা আসে। তবে ভারত থেকে তুলনামূলক অনেক কম আসে। সবচেয়ে বেশি ইয়াবা আসে মিয়ানমারের সঙ্গে লাগোয়া বাংলাদেশের তিন জেলা ও সাতটি উপজেলার সীমান্তপথে। সম্প্রতি বরগুনা, ভোলা ও পটুয়াখালীর জলপথে ইয়াবা চোরাচালানের নতুন রুট আবিষ্কৃত হয়েছে। মিয়ানমারের ১৫০টি পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ইয়াবা প্রবেশ করে। সব মিলিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের চোরাচালানপ্রবণ ৫২৪ স্পট রয়েছে। আরও অনেক বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা ও অপারেশন্স বিভাগের পরিচালক পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, আগামী ২০, ২১ ও ২২ আগস্ট মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ১২ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের বৈঠক বসছে। বৈঠকে ইয়াবা থাকছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পাশাপাশি ইতোপূর্বে মিয়ানমার সরকারের কাছে ইয়াবা তৈরির ল্যাবরেটরি ও এর ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের একটি তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে। তালিকা মোতাবেক মিয়ানমার সরকার কি ব্যবস্থা নিয়েছে সে বিয়ষটিও আলোচনা হবে। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক জল, স্থল ও দেশের ভেতরে একযোগে সাঁড়াশি অভিযান চলবে। দেশের সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে এমন অভিযান চালানো হবে। অভিযানের একটি কৌশলও ঠিক করা হয়েছে।
×