ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম নগরীর দুর্ভোগ চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৮ জুলাই ২০১৭

চট্টগ্রাম নগরীর দুর্ভোগ চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ প্রকৃতিগতভাবে আলাদা বৈশিষ্ট্যের নগরী চট্টগ্রাম, যাকে দেশের অন্যান্য নগরীর সঙ্গে মেলানো যায় না। সাগরের তীরবর্তী হওয়ায় সারাবছরই প্রতিদিন দু’বার করে লাগে জোয়ারের ধাক্কা। এর সঙ্গে যদি বৃষ্টির পানি যুক্ত হয় তাহলে তো কথাই নেই। এমনিতেই নিচু এলাকা ডুবতে বৃষ্টির প্রয়োজন হয় না। সাগর থেকে আসা জোয়ারই যথেষ্ট। পরিকল্পিতভাবে কোন উদ্যোগ নিয়ে বাস্তবায়ন না করায় এ নগরীর মানুষের দুর্ভোগ ক্রমশ চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা পলি জমে খাল এবং নালা ভরাটসহ বিভিন্ন কারণে অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত যে, এই সমস্যা দূরীকরণ শুধু সিটি কর্পোরেশন কিংবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) দ্বারা সম্ভব হবে, তা আর বিশ্বাস করতে চাইছে না নগরবাসী। বিশেষ করে জোয়ারের পানি থামানো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা, এ জোয়ার বাধা সৃষ্টি করছে বৃষ্টির পানি নামার ক্ষেত্রে। এদিকে, সেবা সংস্থাগুলোর বক্তব্যের সুরও এখন আর আগের মতো নয়। জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতিতে যুগের পর যুগ ভোটের রাজনীতি হলেও খোদ সিটি মেয়রই বলছেন, এটি শুধু সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব নয়। তবে কি চট্টগ্রাম ধীরে ধীরে একটি অচল নগরীর দিকে ধাবিত হচ্ছে, এমন প্রশ্ন ভুক্তভোগী নাগরিকের। চট্টগ্রাম জোয়ার-ভাটার নগরী। দিনে দু’বার করে জোয়ার এবং ভাটা হয়। অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে সাগর এমনই ফুলে উঠে যে, তা প্লাবিত করে নগরীর বিশাল একটি অংশকে। শুধু বর্ষাকালই নয়, শুষ্ক শীতের মৌসুমেও অনেক এলাকার সড়ক চলে যায় পানির নিচে। পানি নিষ্কাশনের খালগুলোর মুখ অরক্ষিত। নেই স্লুইসগেট। ফলে অনায়াসে প্রবেশ করে জোয়ারের পানি। এতে আগ্রাবাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকাও এখন হুমকির মুখে। চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার গুরুত ঢাকার মতিঝিলের মতোই। কেননা, এখানেই রয়েছে সরকারী, আধাসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত এবং কর্পোরেট হাউসসহ বেরসরকারী অফিসের প্রধান কার্যালয়। বাণিজ্যিক এলাকায় জনবসতি তুলনামূলক কম হলেও গুরুত্ব বরাবরই অধিক। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা নিয়মিতভাবেই ডুবছে। বাণিজ্যিক এলাকা যদি অচল হয়ে পড়ে তাহলে এর ক্ষতিকর প্রভাব যে কতটা ভয়াবহ, তা ভেবে শঙ্কিত ব্যবসায়ী এবং নগর পরিকল্পনাবিদরা। চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা এবং জলজট দূরীকরণের সামর্থ্য এখন আর সিটি কর্পোরেশন কিংবা চউকের নেই বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদগণ। কারণ, দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকতে থাকতে সমস্যা এখন বেশ প্রকট। বৃষ্টির পানি এবং জোয়ার দুটোই ঠেকাতে হবে বন্দরনগরীকে রক্ষায়। তা না হলে পর্যায়ক্রমে ডুবতে থাকবে উঁচু এলাকাও। সে আলামত এখনই পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে সামুদ্রিক জোয়ার। এর তীব্রতা এতটাই যে, শীতকাল তথা শুষ্ক মৌসুমেও ডুবছে নগরীর একাংশ। খালগুলোর মুখে সøুইসগেট দিয়ে জোয়ারের নোনাজল যেমন আটকাতে হবে তেমনি সময়মতো খুলে দিয়ে এবং পাম্প করে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও করতে হবে। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা আবহাওয়া দফতরের কর্মকর্তা শেখ ফরিদ আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, চট্টগ্রামে প্রতিদিনের স্বাভাবিক জোয়ারের উচ্চতা ৩ মিটার বা প্রায় ১০ ফুট, যাকে মরাকটাল জোয়ার বলা হয়ে থাকে। আর অমাবশ্যা ও পূর্ণিমা তিথির ভরাকটাল জোয়ারের উচ্চতা হয় ৫ মিটার বা তারও বেশি। অর্থাৎ ১৬ থেকে ১৭ ফুট পর্যন্ত। সাগরের তলদেশে উচ্চতা বাড়ছে পাহাড় থেকে গড়িয়ে যাওয়া পলিতে। বর্ষা মৌসুমে জোয়ারের সঙ্গে যদি ভারি বর্ষণ হয় তাহলে পানি নিষ্কাশনের সুযোগ থাকে না। তখন বৃষ্টি এবং জোয়ার দুয়ে মিলে নগরীকে ডুবিয়ে দেয়। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরীর একটি অংশে বৃষ্টিপাত হয়, যার মাত্রা তেমন বেশি নয়। অথচ, মাত্র দেড়ঘণ্টার মাঝারি বর্ষণে নগরজুড়ে অচলাবস্থা নেমে আসে। নিচু সড়কগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় যানবাহন উঠে আসে উঁচু সড়কে। হাতেগোনা কয়েকটি সড়কে একসঙ্গে অত্যধিক যানবাহন উঠে পড়ায় এক ধরনের স্তব্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়। আধাঘণ্টার পথ অতিক্রমে সময় লেগে যায় দেড় থেকে দুই এমনকি আড়াইঘণ্টা পর্যন্ত। পাহাড়ঘেঁষা অনেক উঁচু সড়কেও হয়ে যায় হাঁটুপানি। এর প্রধান কারণ, সড়কের পাশে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ভবন। সড়ক বেশ উঁচু হলেও সেখান থেকে পানি গড়িয়ে পড়ার কোন ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। বন্দর নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে একের পর এক মহাপরিকল্পনা যেন বক্তৃতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সংস্থাগুলো যে যার মতো করে পরিকল্পনা প্রস্তুত করে সরকারের কাছে পেশ করছে। কিন্তু নেই সমন্বিত একটি পরিকল্পনা। তাছাড়া হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প কোন্ সংস্থা বাস্তবায়ন করবে তা নিয়েও রয়েছে রেষারেষি। বিশেষ করে রশি টানাটানি রয়েছে সিটি কর্পোরেশন এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে। সর্বশেষ একনেকে অনুমোদিত হয়েছে চউকের একটি প্রকল্প, যার অধীনে কর্ণফুলী নদীর তীরঘেঁষে নির্মিত হবে সাড়ে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ-সড়ক। এতে ব্যয় হবে ১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। চউক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম জানান, এ প্রকল্পের অধীনে ১২টি খালের মুখে স্লুইসগেট নির্মিত হবে। চার লেনের সড়কটি কাজ করবে একইসঙ্গে বাঁধ হিসেবেও। জরিপসহ প্রাথমিক কাজ প্রায় সম্পন্ন। আগামী অক্টোবরেই শুরু হবে নির্মাণ কাজ। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম নগরী আংশিকভাবে হলেও জোয়ার এবং জলজট থেকে রক্ষা পাবে বলে তার অভিমত। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানান, চউকের কাজ মূলত খাল পরিষ্কার এবং দখলমুক্ত রাখা। সে দায়িত্ব কতটুকু পালিত হচ্ছে প্রশ্নের জবাবে তিনি স্বীকার করেন যে, পুরোপুরি দখলমুক্ত করা যায়নি। তবে এ কাজ শুরু হবে শীঘ্রই। বিভিন্ন বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় হয়েছে বলে তিনি জানান। এদিকে, নির্বাচনী ইস্তেহারে জলাবদ্ধতা দূরীকরণের প্রতিশ্রুতি থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এর সমাধান সিটি কর্পোরেশনের কাছে নেই বলে মন্তব্য করেছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। এর জন্য তিনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকেও দায়ী করে বলেন, চউক যদি চাইত তাহলে অবৈধ স্থাপনা হতো না। চউকের অনুমোদনে নিম্নাঞ্চলেও বসতি এবং স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। এর ফলে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তবে তিনি অল্প সময়ের মধ্যে অতি বর্ষণের বিষয়টিও উল্লেখ করে বলেন জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়াসহ বহু কারণ রয়েছে। এসব চিহ্নিত করে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন। তবে নাগরিকদেরও অনেক বেশি সচেতন হতে হবে।
×