ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সমন্বিত উদ্যোগ ও বিনিয়োগের তাগিদ

ব্লু ইকোনমি প্রসারে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা দেবে বিশ্বব্যাংক

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৮ জুলাই ২০১৭

ব্লু ইকোনমি প্রসারে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা দেবে বিশ্বব্যাংক

আনোয়ার রোজেন ॥ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম হচ্ছে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন। নতুন জলসীমার অধিকার পাওয়ায় ব্লু ইকোনমি প্রসারে বাংলাদেশে যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, সেটিই এফএওর এমন আশাবাদের কারণ। যদিও সংস্থাটির হিসাবে, সমুদ্রে মাছ আহরণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ২৫তম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের সম্ভাবনাকে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। ফলে গভীর সমুদ্র এলাকায় বিশাল অংশ বাংলাদেশের জলসীমায় অন্তর্ভুক্ত হয় এবং নতুন এ জলসীমার পরিমাণ বাংলাদেশের মোট স্থল অঞ্চলের প্রায় ৮১ শতাংশ। সমুদ্রসীমা জয়ের ৫ বছর পেরিয়ে গেছে; কিন্তু বিশাল এই এলাকার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, সমুদ্র থেকে মৎস্য সম্পদ আহরণের লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো উন্নয়নে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছে অনেক দিন ধরে অর্থ সহায়তা চেয়ে আসছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে এ বিষয়ে প্রস্তাবিত একটি প্রকল্পে ২০ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ২ হাজার ৪শ’ কোটি টাকা সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে বিশ্বব্যাংক। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের শেষের দিকে এ প্রকল্পের সহায়তা প্রস্তাব সংস্থার বোর্ড সভায় উঠবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সমুদ্রে মাছ আহরণ বাড়বে। ফলে শক্তিশালী হবে ব্লু ইকোনমি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচ্ছিন্ন একটি-দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে সামুদ্রিক সম্পদের বিশাল সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে না। এজন্য প্রয়োজন সরকারী-বেসরকারী সমন্বিত উদ্যোগ ও বিনিয়োগ। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) হিসাব মতে, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ৭০ শতাংশ আসে সমুদ্রে মাছ আহরণ, সামুদ্রিক খাদ্য ও বাণিজ্যিক সমুদ্র পরিবহন হতে। প্রায় ৩ কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর বিশ্ব ব্যাংক বলছে, মাছ খাত সংশ্লিষ্ট পেশায় বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ নিয়োজিত আছে। এর মধ্যে কেবল সামুদ্রিক মাছ আহরণে নিয়োজিত আছে ৫০ লাখ মানুষ। এর পরও সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের অনুপস্থিতি, দক্ষ মানব সম্পদের অভাব, স্টেকহোল্ডারদের মাঝে সমন্বয়হীনতা, পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব এবং সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে সামর্থ্যরে অভাবে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ বাড়ছে না বলে মনে করে বিশ্ব ব্যাংক ও ঢাকা চেম্বার। এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, অভ্যন্তরীণ আহরণ ও চাষের মাধ্যমে মাছ উৎপাদনে এ দেশ সামনের সারিতে থাকলেও পিছিয়ে আছে উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে। দেশের মোট মাছ উৎপাদনের মাত্র সাড়ে ১৮ শতাংশ আসছে উপকূল ও সমুদ্র থেকে। এ প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সৈয়দ আরিফ আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, মাছের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। গত ৭ বছরে দেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০ লাখ টন। কিন্তু সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার মতো ট্রলার, প্রশিক্ষিত জনবল ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সরঞ্জাম আমাদের নেই। সূত্র জানায়, সমুদ্রে মাছ আহরণের পরিমাণ বাড়াতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপনের জন্য প্রস্তাবটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। একনেকের অনুমোদন পেলে ২০২২ সালের মধ্যে ‘টেকসই উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে মৎস্য অধিদফতর। মূলত উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ বাড়ানোর লক্ষ্যে সামনে রেখে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। তাছাড়া দারিদ্র্যবিমোচন এবং পরিবেশের ভারসাম্যও প্রকল্পটির অন্যতম উদ্দেশ্য। এছাড়া প্রকল্পটির মাধ্যমে উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের ব্যবস্থাপনার উন্নতি করা হবে। মৎস্য চাষ ও আহরণে নিয়োজিত জনশক্তির জীবনমান উন্নয়নেও গুরুত্ব দেয়া হবে। বিশ্ব ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০ কোটি ডলারের মধ্যে সুশাসন ও টেকসই মৎস্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রকল্পটির আওতায় ৭ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করা হবে। এর মাধ্যমে সরকারী-বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো, সরকারী ব্যবস্থাপনার পূর্ণাঙ্গ সংস্কার, ২০০৮ সালে প্রণীত মৎস্য নীতির সংস্কার এবং উপকূলীয় মৎস্য ব্যবস্থাপনায় মৎস্য অধিদফতরের সক্ষমতা বাড়ানো হবে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় মৎস্য আহরণে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন, জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ও কাক্সিক্ষত পুষ্টি নিশ্চিত করতে ব্যয় করা হবে ৫ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার। মাছ আহরণে নিয়োজিত জনশক্তির দক্ষতা বাড়ানো হবে। তাছাড়া অবকাঠামো উন্নয়ন ও উপকূলীয় জলবায়ু রক্ষায়ও অর্থ বরাদ্দ থাকবে। শৃঙ্খলা রক্ষায় মৎস্য আহরণে নিয়োজিত জনশক্তিকে পরিচয়পত্র দেয়া হবে প্রকল্পের আওতায়। মাছ আহরণে নিয়ন্ত্রণ আনতে এসব পরিচয়পত্রের আলোকে দেয়া হবে খাদ্য সহায়তা। টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে প্রকল্পটির আওতায় আরও ৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার ব্যয় করা হবে। আহরণ করা মাছের মান ধরে রাখার পাশাপাশি সহায়ক শিল্পের মাধ্যমে নতুন করে মূল্য সংযোজনের উদ্যোগও নেয়া হবে এর আওতায়। তাছাড়া ব্লু-ইকোনমির উন্নতির মাধ্যমে সামুদ্রিক মাছ রফতানিতেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে। বিশ্ব ব্যাংক জানায়, বাংলাদেশের প্রাণীজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ আসছে মাছ থেকে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ৩৬০ কোটি ডলার মূল্যমানের মাছ আহরণ করা হয়ে থাকে। এর প্রায় সাড়ে ৫২ শতাংশ আসে মাছ চাষের মাধ্যমে। নদী-নালা ও অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে আসে ২৯ শতাংশ। অবশিষ্ট সাড়ে ১৮ শতাংশ মাছ আহরণ করা হয় উপকূল ও সমুদ্র থেকে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন মাছ আহরণ করা হয়। আর সামুদ্রিক উৎস থেকে আহরণ করা হয় ৬ লাখ মেট্রিক টন মাছ। এর বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ৫১ কোটি ডলার। আর সামুদ্রিক মাছের ৪০ শতাংশ অবদান ইলিশের।
×