শংকর লাল দাশ ॥ দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তর বরিশালে আমের চাষ হয় না। পরিবেশ উপযোগী নয়। এমন নানা অপপ্রচারে আম চাষে বরিশাল অঞ্চল বরাবরই ছিল পিছিয়ে। কিন্তু এখন দৃশ্যপট পাল্টে যেতে শুরু করেছে। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পটুয়াখালী আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের নিরলস গবেষণা আর চাষীদের উৎসাহে লোনাপানির এই অঞ্চলে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে আমের চাষ। অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি চাষীরা ঝুঁকে পড়ছে আম চাষে। উত্তরাঞ্চলের আম দক্ষিণাঞ্চলে ফলিয়ে চাষীরা দেখাচ্ছে চমক। আর এ ক্ষেত্রে শীর্ষে উঠে এসেছে আম্রপালির মতো আমের জাত। শুধু তাই নয়, কৃষি বিজ্ঞানীদের সহায়তায় চাষীরা উৎপাদন করছে বিষমুক্ত আম।
পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার লেবুখালী ইউনিয়নের বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়ক ঘেঁষে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পটুয়াখালী আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র। চারদিকে বাউন্ডারি ঘেরা উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্রে ঢুকতেই চোখে পড়ে সারি সারি আম গাছ। অধিকাংশ গাছ আমের ভারে ন্যুয়ে পড়েছে। বাঁশ দিয়ে কোনমতে গাছগুলো দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটি গাছে ঝুলছে আম আর আম। সবুজ পাতার দেখাই মেলে না। আর প্রতিটি আম রাখা হয়েছে আবার ব্যাগে পুড়ে। ব্যাগ খুলতেই বেরিয়ে পড়ে বেশ বড় আকৃতির হালকা হলুদ রঙের আম।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পটুয়াখালী আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্রে আম নিয়ে নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর গবেষণা শুরু হয় ২০১১ সালে। গবেষণাকেন্দ্রে ওই বছর ২০ প্রজাতির আমের চারা রোপণ করা হয়। এরমধ্যে বারি-১, ২, ৩, ৪, ৫, ৮, গোপালভোগ, মল্লিকা, ল্যাংড়া, ফজলি, পাহুতান এবং ক্ষিরসাপাত অন্যতম। শুরু থেকে কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা সমানভাবে প্রতিটি প্রজাতির আম গাছের যথাযথ পরিচর্যা করেন। ফলে অধিকাংশ গাছে দুই বছর না যেতে থোকায় থোকায় মুকুল ধরে। ২০১৫ সাল থেকে আসে সাফল্য। ওই বছর বারি আম-১ প্রজাতির প্রতিটি গাছে ৬ থেকে ১৯ টি, বারি-২ গাছে ৪৯ থেকে ১০০টি, বারি-৩ গাছে ১৮৭ থেকে ৩৯৫টি, বারি-৪ গাছে ৪৯ থেকে ৭৯টি আম ধরে। ওজনের হিসেবে প্রতিটি বারি-৩ প্রজাতির গাছে প্রায় ৬৪ কেজি আম ধরেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বারি-৪। প্রতিটি গাছে প্রায় ৫৩ কেজি আম ধরেছে। প্রতিটি গাছে প্রায় ৩৫ কেজি আম উৎপাদন করে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বারি-৮। এরআগে পটুয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলের তৃণমূল পর্যায়ের চাষীরা সাধারণত বারি প্রজাতির আম তেমন চাষ করত না। তারা ফজলি, মল্লিকা, ক্ষিরসাপাতা ও ল্যাংড়া চাষ করত। কিন্তু কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় এখন সে দৃশ্য পাল্টে গেছে। চাষীরা এখন বারি প্রজাতির আমচাষেও সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছে। মাঠ পর্যায়ে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে বারি প্রজাতির আমের চাষ।
পটুয়াখালী আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান তালুকদার বলেন, ২০১৬ সালে মাঠ পর্যায়ে বারি আম-৩ জাতের অন্তত ৩ হাজার কলম দেয়া হয়েছে। ওই গাছগুলো এখন ছয়-সাত ফুট উচ্চতার হয়েছে। এক বছর বয়সী গাছে আমের মুকুল আসে। তবে চার থেকে পাঁচ বছর বয়সী গাছ থেকে প্রতিবার প্রায় ৩০০টি আম আহরণ করা যায়। তিনি আরও বলেন, এ জাতের একটি গাছে বছরে প্রায় ৬০ কেজি পর্যন্ত আম হয়। আমটি খেতে খুবই সুমিষ্ট। আস্তে আস্তে এ জাতের আমের চাষ আরও বাড়বে। এমনকি বাড়ির ছাদেও এ আমের চাষ সম্ভব।
পটুয়াখালী আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রে সরেজমিনে দেখা গেছে, পোকামাকড়ের সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য অধিকাংশ আম কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা রেজাউল করিমকে গাছের পরিচর্যা করতে দেখা যায়। তিনি বলেন, এ গাছগুলো লাগানোর এক বছরের মধ্যে ফল ধরে। যত দিন বাঁচবে, তত দিন এসব গাছে আম ধরবে। দক্ষিণাঞ্চলে ‘ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি’তে আমরাই প্রথম আম চাষ শুরু করেছি। কীটনাশক ও কেমিক্যাল ছাড়া উৎপাদিত এ আম গুণগতমান ভাল হওয়ায় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বিদেশেও এর কদর অনেক বেশি। অন্য আমের চেয়ে এর দাম দ্বিগুণ হওয়ায় লাভবান হবেন এ অঞ্চলের চাষীরা। তিনি আরও বলেন, লাভ বেশি হওয়ায় চাষিরা ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম চাষে ঝুঁকছে। তাই আগামীতে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু এসব কাজের জন্য যে পর্যাপ্ত শ্রমিক ও ব্যাগ প্রয়োজন, তা সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। চীন থেকে আনা প্রতিটি ব্যাগ চার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে দেশের একমাত্র কারখানায় উৎপাদিত ব্যাগ সাড়ে ৩ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। চড়া দাম হলেও ব্যাগের সঙ্কট থাকে মৌসুম জুড়েই। তাই ব্যাগের দাম কমলে বিষমুক্ত স্বাস্থ্যকর আম উৎপাদন আরও বাড়বে।
গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ইফতেখার মাহমুদ ও রেজাউল করিম বলেন, প্রথম বারই ব্যাপক সাফল্য এনে দিয়েছে আম্রপালি। গুণগত মান ও বাজার মূল্যের বিচারে দ্বিতীয় অবস্থানে হয়েছে বারি-৪। গত ২০১১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চারা এনে উদ্যানের কৃষি খামারে চাষ শুরু করা হয়। বর্তমানে খামারের ১ হেক্টর জমিতে অন্তত ২০ প্রজাতির আম চাষ হচ্ছে। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল বলছে- দক্ষিণাঞ্চলে সবচেয়ে পরিবেশগতভাবে আম্রপালি চাষে চাষীরা সফলতা পাবে।
বর্তমানে গবেষণাকেন্দ্র থেকে খামারিদের কাছে কলমযুক্ত চারা বিতরণ করা হচ্ছে। চাষীরাও যথেষ্ট উৎসাহ নিয়ে আমের চাষ করছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বরিশাল অঞ্চলে আমের চাষ হয় না, এমন অপবাদ থেকে মুক্ত হবে দক্ষিণাঞ্চল। আম হবে চাষীদের কাছে আরেকটি লাভজনক কৃষিপণ্য। কৃষি বিজ্ঞানীদের আশা, সেদিন বেশি দূরে নয়। যেদিন দক্ষিণাঞ্চলও পরিচিতি পাবে আমের রাজ্য হিসেবে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: