ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিউটি পারভীন

ডেনমার্ক জাতীয় দলে খেললেও নাদিয়ার হৃদয়ে আফগানিস্তান

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ২৬ জুলাই ২০১৭

ডেনমার্ক জাতীয় দলে খেললেও নাদিয়ার হৃদয়ে আফগানিস্তান

২০০০ সালে মা এবং চার বোনের সঙ্গে দেশ ছাড়েন নাদিয়া য় আফগান ন্যাশনাল আর্মির জেনারেল তার বাবা তালেবানদের হাতে নিহত হয়েছিলেন য় এরপরই দেশে থাকাটা আর নিরাপদ মনে করেনি নাদিয়ার পরিবার য় শরণার্থী শিবিরের পাশেই ছিল ডেনমার্কের বেশকিছু বড় ক্লাব য় সেখানে ছেলেদের সঙ্গেই ফুটবল চর্চা শুরু করেন য় পরে নিজের দক্ষতায় বি৫২ আলবর্গ, টিম ভিবর্গ ও আইকে স্কোভবাক্কেনের হয়ে খেলেন য় আবেদনের পর ২০০৮ সালে ডেনমার্কের নাগরিকত্ব লাভ করেন য় ২০০৯ সালে ডেনমার্ক জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যান এই আফগান তরুণী য় আলগ্রেভ কাপে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে খেলেন তিনি ডেনিশ জার্সি গায়ে য় সেটাই ছিল অন্য দেশের নাগরিক হয়েও ডেনমার্কের হয়ে প্রথম কোন মহিলা ফুটবলারের খেলার ঘটনা নিজ দেশ ছেড়ে এসেছিলেন নাদিয়া নাদিম। তখন মাত্র ১২ বছর বয়স তার। ওই বয়সেই বাবাকে হারিয়েছিলেন। আফগানিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল ছিলেন। তালেবানরা ২০০০ সালে তাঁকে হত্যা করেন। এরপর সেই শৈশবকালেই পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে আসেন ডেনমার্কে। তারপর থেকে হয়ে গেছেন ফুটবলার। শরণার্থী শিবিরে থাকার সময় খেলতে শুরু করে এখন একটি জাতীয় মহিলা দলের অপরিহার্য স্ট্রাইকার তিনি। বর্তমানে ডেনমার্ক মহিলা ফুটবল দলের জার্সি গায়েই চলমান ইউরো মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে খেলছেন তিনি। হংল্যান্ডে চলমান এ আসরে সবার নজর কেড়ে নিয়েছেন তিনি আফগান বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে। ২৯ বছর বয়সী এ স্ট্রাইকার দাবি করেছেন শুধুমাত্র ক্রীড়াতে মেয়েদের অংশগ্রহণই তার জন্মভূমিতে নারীদের জন্য যত বাধ্যবাধকতা সেটা ভেঙ্গে যেতে পারে। আর আফগানিস্তানের মেয়েরা ক্রীড়াক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনাময়ী সেটাও দাবি তার। ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে যে কোন ক্রীড়া উন্নয়নের স্বার্থে যুক্ত থাকার স্বপ্ন দেখছেন নাদিয়া। ২০০০ সালে মা এবং চার বোনের সঙ্গে দেশ ছাড়েন নাদিয়া। আফগান ন্যাশনাল আর্মির জেনারেল তার বাবা তালেবানদের হাতে নিহত হয়েছিলেন যুদ্ধাক্রান্ত দেশটিতে। এরপরই দেশে থাকাটা আর নিরাপদ মনে করেননি নাদিয়ার পরিবার। শরণার্থী শিবিরের পাশেই ছিল ডেনমার্কের বেশকিছু বড় ক্লাব। সেখানে ছেলেদের সঙ্গেই ফুটবল চর্চা করতে শুরু করেন নাদিয়া। পরে নিজের দক্ষতাগুণ দেখিয়ে তিনি বি৫২ আলবর্গ, টিম ভিবর্গ এবং আইকে স্কোভবাক্কেনের হয়ে খেলেন। তবে ২০০৬ সালের আগে ডেনমার্কের নাগরিকত্ব পাওয়ার আবেদন করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত আবেদনের পর ২০০৮ সালে নাগরিকত্ব লাভ করেন তিনি। কিন্তু ফিফা ১৮ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত ডেনমার্ক জাতীয় দলের হয়ে খেলার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা দিয়ে রেখেছিল। তবে ডেনিশ ফুটবল এ্যাসোসিয়েশন এই আইনের একটি ব্যতিক্রম করার জন্য আবেদন করে ফিফার কাছে। শেষ পর্যন্ত ২০০৯ সালে ডেনমার্ক জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যান তিনি। আলগ্রেভ কাপে শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ২-০ গোলে পরাজয়ের ম্যাচে খেলেন তিনি প্রথমবার ডেনিশ জার্সি গায়ে। সেটাই ছিল অন্য দেশের নাগরিক হয়েও ডেনমার্কের হয়ে প্রথম কোন মহিলা ফুটবলারের খেলার ঘটনা। ২০১২ সালে তিনি ফরচুনা হিওরিংয়ে যোগ দেন। একই বছর সেপ্টেম্বরে মহিলা চ্যাম্পিয়ন্স লীগে অভিষেক হয় নাদিয়ার। স্কটিশ চ্যাম্পিয়ন গ্লাসগো সিটির বিরুদ্ধে ২-১ গোলে জয়ের ম্যাচে জোড়া গোলই করেন তিনি। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রস্তাব পেয়ে তিনি যোগ দেন সে দেশের মহিলা সকার লীগে স্কাই ব্লু ক্লাবে। গত বছর জানুয়ারিতে দল পরিবর্তন করে পোর্টল্যান্ড থর্নসে যোগ দেন নাদিয়া। তারপর থেকে সেই ক্লাবেই আছেন তিনি। ইউএস জাতীয় মহিলা সকার লীগে পোর্টল্যান্ড থর্নসের সঙ্গে ফুটবলে অধিক পরিচিতি পেতে শুরু করেন নাদিয়া। এ বিষয়ে নাদিয়া বলেন, ‘দেশ ছেড়ে আসা ব্যতীত আমাদের অন্য কোন উপায় ছিল না। কারণ সবকিছুই ভয়ানক হয়ে উঠেছিল সেখানে বাস করার জন্য। আমরা এক মানব পাচারকারীর সহায়তায় ডেনমার্কে এসেছিলাম। তখন থেকে এখানেই আছি।’ ডেনমার্কের শরণার্থী শিবিরে থাকার সময় নাদিয়া ফুটবল খেলতে শুরু করেন। তখন ছেলেদের সঙ্গেই খেলতেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সেখানে তেমন কিছুই করার ছিল না। যেখানে ছিলাম সেটার খুব কাছাকাছিই ছিল বড় একটি ক্লাব। সেখানেই আমি ফুটবল খেলতে শুরু করি।’ ডেনমার্কের বেশ কয়েকটি ক্লাবের হয়ে খেলেছেন নাদিয়া। এরপর নিউজার্সির ক্লাব স্কাই ব্লুর হয়ে খেলার সুযোগ পান ২০১৪ সালে। এর দুই বছর পর তিনি পোর্টল্যান্ডে যোগ দেন। এ বিষয়ে নাদিয়া বলেন, ‘পোট্যল্যান্ডের হয়ে খেলাটা বিশাল ব্যাপার। এটা ১০০ ভাগ স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতোই বিষয়। আমার মনে পড়ে যখন ছোট ছিলাম তখন ভাবতাম কিভাবে একজন পেশাদার ফুটবলার হওয়া যায়। এখন যে অবস্থানে এসেছি সেটা ওই চিন্তাধারারই ফলাফল। সুতরাং এটাকে আমি বিস্ময়করই বলব এবং এমন একটি ক্লাবে থাকতে পারাটা সত্যিই এক বড় মর্যাদা।’ ২০০৯ সালে ডেনমার্কের জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে যান নাদিয়া। ডেনিশ ফেডারেশন ইমিগ্রেশন আইনটাকে পর্যালোচনা করে তাকে দলে নেয়। তিনটি ইউরো কোয়ালিফাইং খেলে তিনি ডেনিশ জার্সি গায়ে ২২ ম্যাচ খেলে ৯ গোল করেন। তবে এর মধ্যে ৭টি গোলই তিনি করেছেন এ বছরের ইউরো অভিযাত্রায়। এ বিষয়ে নাদিয়া বলেন, ‘আগের টুর্নামেন্টগুলো আমার জন্য কিছুটা ব্যতিক্রম ধরনের ছিল। যারা কোচ ছিলেন আমার ওপর তেমন কোন আস্থাই ছিল না। তাই আমি ভেবেছিলাম আমার পক্ষে বড় কিছু করা হয়ত সম্ভব হবে না। কিন্তু এখন সবকিছুই বদলে গেছে। আমি খেলোয়াড় হিসেবে উন্নতি করেছি। এর পাশাপাশি কোচদের বিশ্বাসও অর্জন করেছি।’ বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে এবার ইউরোতে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ১-০ গোলের জয় এবং স্বাগতিক হল্যান্ডের কাছে ১-০ গোলের পরাজয়ের ম্যাচে দারুণ নজরকাড়া খেলা উপহার দিয়েছেন নাদিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করা এবং ডেনমার্কের হয়ে খেলার পাশাপাশি নাদিয়া মেডিক্যালে পড়াশোনাও করেছেন। কিন্তু এতকিছুর পরও নিজের জন্মভূমি আফগানিস্তানকে ভুলে থাকতে পারেন না এ স্ট্রাইকার। আফগানিস্তান থেকে কোন মহিলা এ্যাথলেট বেরিয়ে আসা একটা সময় খুবই দুরূহ ব্যাপার ছিল। কিন্তু নাদিয়া মনে করেন সবকিছুর পরিবর্তন ঘটছে ধীরে ধীরে। তিনি বলেন,‘এখন বেশকিছু মহিলা এ্যাথলেট বেরিয়ে আসছে। এমনকি একটি মহিলা ফুটবল দল করার বিষয়টিও আলোচনায় আছে। আশা করছি এই উন্নতিটা অব্যাহত থাকবে। আমিও আশা করি সেখানে আমার কিছু অবদান রাখার সুযোগ থাকবে। মুসলিম নারী হিসেবেও ক্রীড়াক্ষেত্রে আফগানিস্তান কিছু করতে পারে সেটা দেখানো সম্ভব হবে বলেই বিশ্বাস করি।’ নিজের ফুটবল অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি এমনকি স্বপ্ন দেখছেন ক্রীড়াক্ষেত্রে শুভেচ্ছা দূত হওয়ার। এ বিষয়ে নাদিয়া বলেন, ‘এটা আমার লক্ষ্য এবং পরিকল্পনার অংশ। আমি ফুটবলার তৈরির অংশ হতে চাই, শুধু মহিলা ফুটবল নয়- সার্বিক ফুটবলের ক্ষেত্রে। আমি এমন এক উচ্চ অবস্থানে দেশের ফুটবলকে নিয়ে যেতে চাই যেটা আসলে আফগানিস্তানের জন্য খুবই সম্ভব।’
×