ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রিটেন ইউরোপের রুগ্ন মানব!

প্রকাশিত: ০৭:২৩, ২৬ জুলাই ২০১৭

ব্রিটেন ইউরোপের রুগ্ন মানব!

ব্রিটেনের ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোট হওয়ার পর এক বছর সময় পেরিয়ে গেল। এ সময় তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সবচেয়ে দৃশ্যমান একটা ক্ষতি ঘটে গেছে। রক্ষণশীল দলে টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিক দলের কট্টর বামপন্থী নেতা জেরেমি করবিন বলছেন আগামী ছয় মাসের মধ্যে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। এই যখন দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা তখন আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্রিটেনের ভাবমূর্তির ওপরও লেগেছে গুরুতর আঘাত। ১৯৫৬ সালের সুয়েজ সঙ্কটের পর থেকে ব্রিটেনের ভাবমূর্তি আরও কখনও এত নিচে নামেনি। কয়েক দশক ধরে ব্রিটেনের রাজনীতি তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। স্তম্ভ তিনটি হলো যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও উদীয়মান বিশ্ব। আমেরিকার সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক অতি নিবিড়। রক্ত ও ভাষার বন্ধনে আবদ্ধ। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল এই বন্ধনকে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ আখ্যায়িত করেছিলেন। সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে ব্রিটেনের কয়েক ডজন এশীয় ও আফ্রিকান দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ব্রিটেনের ইউরোপের ভবিষ্যত নির্ধারণে বড় ধরনের ভূমিকা ছিল। অনেক সময় দেশটি ফ্রাঙ্কো-জার্মান জোটের পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে কাজ করেছে ব্রিটিশ কূটনীতিকরা হয়ত নাখোশ হবেন এমন কথা শুনে যে আমেরিকার সঙ্গে দেশটির যে বিশেষ সম্পর্ক আছে সেটি ওয়াশিংটনে বিসর্জন দিতে কুণ্ঠিত হয় না যখনই তার জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সেই সম্পর্কের সংঘাত বাধে। ১৯৫৬ সালের সুয়েজ সঙ্কটই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ব্রিটিশরা বরাবরই ইউরোপের দ্বিতীয় ডিভিশনের খেলোয়াড়। তার পরও তিনটি স্তম্ভ শুধু যে কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তাই নয়, এগুলো একে অপরকে সুদৃঢ়ও করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্রিটেনের সদস্যপদ যেমন আমেরিকায় দেশটির প্রভাব বাড়িয়েছে তেমনি আমেরিকার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ইইউর ভেতরেও নিজ প্রভাব বাড়িয়েছে। ইইউর বদৌলতে ব্রিটেনের বৈশ্বিক শক্তি যথেষ্ট বেড়েছে। কিন্তু ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপের প্রভাব খর্ব হবে। ইতোমধ্যে এর দুর্বলতাও ফুটে উঠেছে। ব্রেক্সিট প্রশ্নে ব্রিটেনের প্রধান আলোচক ডেভিড ডেভিস ছাড় দেয়া ছাড়া তেমন কিছুই আদায় করতে পারেননি। তার একঘরে হয়ে পড়া একটু একটু করে প্রকাশ পাচ্ছে। তাছাড়া ব্রিটেন এমন এক সময় ইইউ ত্যাগ করছে যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের ওপর বেশ চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প কখন কি করে বসেন বা সিদ্ধান্ত নেন তার কোন ঠিক নেই। তার মূলমন্ত্র হলো ‘সবার আগে আমেরিকা।’ বিভেদ সৃষ্টি করতে তিনি অসাধারণ পারঙ্গম। এর অর্থ ব্রিটেন যতই ট্রাম্পের কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করবে ততই ট্রাম্পবিরোধীরা দূরে সরে যাবে। ৩৭টি দেশে পিউ রিসার্চ সেন্টার পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে যে জনগণের ২২ শতাংশ মনে করে যে আন্তর্জাতিক ব্যাপারে ট্রাম্প সঠিক কাজ করবেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামার শেষ বছরটিতে ওবামা সম্পর্কে ৬৪ শতাংশ মানুষ এখন ধারণা পোষণ করত। এখন আসা যাক তৃতীয় স্তম্ভ বা উদীয়মান বিশ্বের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্কের ব্যাপারে। বেক্সিটপন্থীদের সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তি হচ্ছে তারা বিশ্বায়নপন্থী। তাদের যুক্তি হচ্ছে ইউরোপের পচনশীল লাশ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে পারলে ব্রিটেন অবাধে উদীয়মান বিশ্বের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারবে। অথচ ইইউর সদস্য থাকার কারণে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো এ ব্যাপারে কিছু করতে পারছিল না এমন কোন প্রমাণ নেই। জার্মানির মিটেলস্ট্যান্ড কোম্পানিগুলোর বিশ্ববাজারের মহাশক্তিধর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার ব্যাপারে ইইউ কখনই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং ব্রিটেন যা ভাবছে তার উল্টোটাই হতে পারে। উদীয়মান দেশগুলো বরং ৫০ কোটি লোকের ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাজারে প্রবেশ করতে আগ্রহী। উদীয়মান দেশগুলো একটি ছোট দেশের চাইতে বরং বৃহৎ পাওয়ার ব্লকগুলোর সঙ্গেই লেনদেন করতে উৎসাহী। ১৯৮০-এর দশক থেকে আমেরিকা ও ব্রিটেন বিশ্বে নব্য উদারতাবাদ ভাবধারার শীর্ষ প্রবক্তা হয়ে এসেছে। ব্রিটিশ উপদেষ্টারা বিরাষ্ট্রীয়করণের পাঠ দিতে ইউরোপ ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন চষে বেড়িয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে নব্য উদারতাবাদের গায়ে আঘাত নেমে আসে। এই আঘাতের পরিণতিতে ব্রিটেন ও আমেরিকায় আরেক জোয়ার নেমে আসে। সেটা বিশ্বায়নবিরোধী। সেই জোয়ার থেকে আটলান্টিকের এক পাড়ে সৃষ্টি হয় ব্রেক্সিট এবং অন্য পাড়ে ট্রাম্প। ব্রেক্সিটপন্থীদের যুক্তি হলো ইইউ। বেরিয়ে গেলে ব্রেক্সিট বসন্তের আগমন ঘটবে। অন্যদিকে ইউরোপের অবস্থা হবে টলায়মান। কিন্তু তার বদলে দেখা যাচ্ছে যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এখনকার মতো ভাল অবস্থা গত কয়েক বছরের মধ্যে আর হয়নি। ফ্রান্সে একজন নতুন সংস্কারক ক্ষমতায় এসেছেন এবং ফ্রাঙ্কো জায়ান সংহতি আরও সুদৃঢ় রূপ নিয়েছে। মহাদেশজুড়ে সংবাদপত্রগুলো বলছে যে ব্রিটেন এখন ইউরোপের রুগ্ন মানব। এতদিন ব্রিটেন বিশ্বে যে ভূমিকা পালন করে আসছিল ২০০৮-এর অর্থনৈতিক সঙ্কট ও ২০১৬ এর ব্রেক্সিটের মিলিত কল হিসেবে এক ঝাপটায় সেই ভূমিকাগুলো হারিয়ে ফেলেছে। এখন জানালাগুলো ভেঙ্গে পড়ছে। ছাদও ধসে পড়ছে সূত্র : টাইম
×