ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আরও ধস আরও মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৬ জুলাই ২০১৭

আরও ধস আরও মৃত্যু

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ/মোহাম্মদ আলী ॥ ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা নয়, মৌসুমি বায়ুর বৈরী আচরণেই এ দুর্যোগ অব্যাহত। এ যেন দুর্যোগ থেকে মহাদুর্যোগের ভয়াল রূপ। ক্রমাগতভাবে বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক পাহাড় ও সংলগ্ন সড়কগুলো ধসে পড়ছে। পাহাড়ের প্রতিটি অংশই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। এ ঝুঁকির সঙ্গে অবিরাম বর্ষণ যুক্ত হওয়ার জের হিসাবে ধসের ঘটনা ঘটেই চলেছে। সর্বশেষ কক্সবাজারে পাহাড়ধসে ২ শিশুসহ প্রাণ হারিয়েছে ৪ জন। চট্টগ্রামের কুসুমবাগ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়েও ধস সৃষ্টি হয়েছে। বান্দরবানে বিভিন্ন স্থানে যে কোন মুহূর্তে আরও পাহাড়ধসের শঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের কামারপাড়া এলাকায় পাহাড়ী ঢলে মাটি ধসে নতুন করে ২০ মিটার সড়ক একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ঘাগড়া-বরইছড়ি সড়কে পাহাড়ধসে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্ষণ চলাকালে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজে কাজ করতে গিয়ে সমুদ্রে পড়ে ২ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৫ জেলায় বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। চট্টগ্রাম বহির্নোঙ্গরে নোঙ্গর থেকে লাইটার জাহাজযোগে পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। কিছু কিছু লাইটার জাহাজ বহির্নোঙ্গরে অবস্থান করছে। আবার কিছু কিছু কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অলস নোঙ্গর করে আছে। কন্টেনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকলেও পণ্যের খালাস ও ডেলিভারি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আবহাওয়া বিভাগ আরও কয়েকদিন অতি, ভারি, মাঝারি বর্ষণের পূর্বাভাস দিয়েছে। তবে আজ বুধবার ব্যাপক বর্ষণ হতে পারে বলে জানিয়েছে। অমবস্যা ও পূর্ণিমার তিথি যুক্ত হওয়ায় আবহাওয়ার এ বৈরী আচরণ বলে মত ব্যক্ত করা হয়েছে আবহাওয়া দফতর থেকে। এবারের বর্ষা মৌসুমে আবহাওয়ার বৈরী আচরণ সবদিক থেকেই রেকর্ড গড়েছে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ অতি বর্ষণ হয়েছে। জলোচ্ছ্বাস ব্যতীত স্বাভাবিক জোয়ারের পানির উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ২৩৫ মিটার। এ জোয়ারের পানি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, কোরবানিগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, চরচাক্তাই, বারিক বিল্ডিং মোড়, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, আবাসিক এলাকাসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে প্রবেশ করে জনজীবনকে থমকে দিয়েছে। এটিও একটি রেকর্ড। আর অব্যাহতভাবে পাহাড়ধসের ঘটনা সর্বকালের রেকর্ড গড়েছে। প্রাণহানি, সহায়সম্পদ ক্ষতির দিকটিও নতুন রেকর্ড। বৃহত্তর চট্টগ্রামে এ পরিস্থিতি অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়েছে। দিনের পর দিন গড়িয়ে মাস পেরিয়ে গেছে। বর্ষণ যেন থামছেই না। নিম্নচাপের প্রভাবে বর্ষণ হয়েছে। স্থল নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার পর এর প্রভাবে এ বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে বলে আবহাওয়া বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু এর প্রভাবে যে দুর্যোগ সৃষ্টি হয়েছে তার যে ভয়াল রূপ তা স্বাভাবিক সব পরিস্থিতিকে ল-ভ- করে দিয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখার সময়ও বর্ষণ অব্যাহত ছিল। এ যেন আকাশ ফুটো হয়ে ক্রমাগত বর্ষণ। থামার কোন লক্ষণ নেই। সঙ্গে যোগ হয়েছে সামুদ্রিক জোয়ার। একদিকে জোয়ারের পানি নগরীতে ঢুকে যাচ্ছে, অপরদিকে, বর্ষণে পানি খাল দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ না পেয়ে জোয়ারের পানির সঙ্গে টক্কর খাচ্ছে। ফলে সৃষ্ট জলজট, দুর্যোগ অস্বাভাবিকতার ভয়াল রূপ। কক্সবাজার পরিস্থিতি কক্সবাজার শহর ও রামুতে পাহাড়ধসে চার জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও ৭ জন। মঙ্গলবার ভোর রাতে রামু উপজেলার মিঠাছড়ির চেইন্দা কাইম্যার ঘোনা এবং কক্সবাজার শহরের লাইট হাউসপাড়া এলাকায় পৃথক এ ঘটনা ঘটে। কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের উপ-সহকারী পরিচালক আব্দুল মালেক বলেন, ভারি বর্ষণের ফলে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে রামুর চেইন্দা এলাকায় পাহাড়ধসে ঘুমন্ত অবস্থায় একই পরিবারের সায়মা (৫) ও জিহান (৭) নামে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে মাটিচাপা পড়া অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে তাদের পিতা জিয়াউর রহমান (৩৫) ও মা আনার কলিকে (২৯)। তাদের কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। রাঙ্গামাটির পরিস্থিতি গত কয়েকদিন ধরে ভারি বর্ষণের ফলে রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কের কামারপাড়া এলাকায় নতুন করে ২০ মিটার সড়ক পাহাড়ী ঢলে মাটি ধসে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। একই সঙ্গে ঘাগড়া-বরইছড়ি সড়কে পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ায় এ সড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে গেছে। অবিরাম ভারি বর্ষণে ফের শুরু হয়েছে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ। ভূমিধসের আরও আশঙ্কায় প্রশাসন জেলার ১০ উপজেলায় মাইকিং করে ভূমিধসের সর্তকতা জারি করেছে। বান্দরবান পরিস্থিতি বান্দরবান থেকে জনকণ্ঠের নিজস্ব প্রতিনিধি এস বাসু দাশ জানান, টানা বর্ষণে বিপর্যয়ের কারণে বান্দরবানের সঙ্গে দেশের সব অঞ্চলের যোগাযোগ দ্বিতীয় দিনের মতো বন্ধ রয়েছে। চার দিনের অনবরত ভারি বর্ষণে বান্দরবানের রুমা উপজেলার সড়কপথের দলিয়ানপাড়া এলাকায় গত রবিবার সড়কের ওপর পাহাড় ধসে মাটিচাপা পড়ে নিখোঁজ চারজনকে এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। নিখোঁজ রয়েছে সিংমেচিং, মুন্নি বড়ুয়া, গৌতম কুমার নন্দী ও রবিউল। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার পর জেলার দমকল বাহিনীর সদস্য, সেনা সদস্য ও রেডক্রিসেন্টের সদস্যরা উদ্ধার অভিযান চালালেও বৃষ্টির কারণে ঘটনাস্থলে ফের পাহাড়ধসের আশঙ্কা থাকায় উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হচ্ছে। উদ্ধারকর্মী ও আহতদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ৬ সদস্যবিশিষ্ট জরুরী মেডিক্যাল টিম ওই এলাকায় অবস্থান করছে। চট্টগ্রাম মহানগর পরিস্থিতি চট্টগ্রামে মঙ্গলবার বৃষ্টির তীব্রতা কিছুটা কম থাকলেও ছিল মৌসুমের সর্বোচ্চ জোয়ার। স্বাভাবিকের চেযে বেশি উচ্চতার জোয়ারের পানিতে ডুবেছে বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গুদাম ও বিভিন্ন আবাসিক এলাকা। এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে অনেক পণ্য। প্রকৃতিগতভাবেই চট্টগ্রাম আলাদা বৈশিষ্ট্যের নগরী, যার সঙ্গে দেশের অন্য নগরীগুলোকে মেলানো যাবে না। এখানে প্রতিদিন দুবার জোয়ার-ভাটা হয়। বৃষ্টির সময় সাগরে জোয়ার থাকলে ক্ষয়ক্ষতি হয় সীমাহীন। দুর্যোগ এখনও কাটেনি। আবহাওয়া দফতর বলছে, মঙ্গলবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগে সকাল ৬টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিল ২২৩ মিলিমিটার। আরও বৃষ্টিপাত হতে পারে। বহাল রাখা হয়েছে সমুদ্রবন্দরসমূহের জন্য ৩ নম্বর সতর্কতা সঙ্কেত। ভারি বর্ষণ এবং ভূমিধসের পূর্বাভাসও রয়েছে। মৌসুমি বায়ু বেশ সক্রিয়, যা প্রচুর বৃষ্টি ঘটাতে পারে। চট্টগ্রামে মঙ্গলবার জোয়ার ছিল প্রবল। বছরে এ পর্যন্ত হওয়া ৭০৫টি জোয়ারের মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে বেশি উচ্চতার। বৃষ্টিপাত কম হলেও নগরী ডুবেছে জোয়ারের পানিতে। বৃষ্টি এবং জোয়ার দুইয়ে মিলে স্তব্ধ জনজীবন। খাগড়াছড়ির পরিস্থিতি খাগড়াছড়ি থেকে জনকণ্ঠের পার্বত্যাঞ্চল প্রতিনিধি জীতেন বড়ুয়া জানান, গত ৩ দিনের টানা বর্ষণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে খাগড়াছড়ির পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষ। তবে প্রাণহানির মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের আশ্রয় কেন্দ্রে আসার লক্ষ্যে মাইকিং করা অভ্যাহত রেখেছে। জেলার ৯ উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে। তবে অতিবর্ষণে সড়কের কিছু কিছু অংশে ছোটখাটো ভাঙ্গন দেখা দিলেও কোথাও দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। এছাড়া জেলার কিছু কিছু এলাকায় ভারি বর্ষণে পাহাড়ধস হলেও প্রাণঘাতির ঘটনা ঘটেনি। গত সোমবার বিকেলে খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি সড়কের মহালছড়ি এলাকার রাস্তা পানির নিচে তলিয়ে গেলেও যান চলাচল এখনও স্বাভাবিক রয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এটিএম কাউছার আলম বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে এখানে বড় ধরনের কোন ক্ষতি হয়নি। রাস্তার আশপাশে ও কিছু কিছু এলাকায় পাহাড়ধস হয়েছে কিন্তু কোন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
×