ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৃতি যখন আপনজন

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২৪ জুলাই ২০১৭

প্রকৃতি যখন আপনজন

মানুষ ও প্রকৃতির নৈকট্যই পারে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে। মানুষ যখনই প্রকৃতিকে আপন করে নেয়, তখনই সে হয়ে ওঠে প্রকৃতির মানুষ, ভূমি আর বৃক্ষের অত্যন্ত কাছের মানুষ। আর মানুষ যখনই প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যায়, সে নিজের ধ্বংস ডেকে আনে, সেই সঙ্গে পৃথিবীরও। লিখেছেনÑ সাবিহা সুফিয়ান মানুষ ও প্রকৃতির নৈকট্যই পারে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে। মানুষ যখনই প্রকৃতিকে আপন করে নেয়, তখনই সে হয়ে ওঠে প্রকৃতির মানুষ, ভূমি আর বৃক্ষের অত্যন্ত কাছের মানুষ। আর মানুষ যখনই প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যায়, সে নিজের ধ্বংস ডেকে আনে, সেই সঙ্গে পৃথিবীরও। মানুষ ও প্রকৃতি পরস্পরের পরিপূরক, প্রকৃতি ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচে না; তেমনি মানুষ ছাড়াও প্রকৃতিরও মূল্য নেই। প্রকৃতিকে ভালবাসা মানে নিজেকেই ভালবাসা। এই যে পাহাড়, বন, শস্যক্ষেত, নদী ও সমুদ্র নিয়ত মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। আমরা যখন সমুদ্রে যাই প্রকৃতিকে পাই, আমরা যখন পাহাড়ে যাই প্রকৃতিকে পাই। এই যে পাহাড়ের অবিরাম ঝরনা ধারা, এই যে সমুদ্রের অশান্ত তরঙ্গমালা মানব মনে অনির্বচনীয় অনুভূতি এনে দেয়, এই যে বনের সবুজ বৃক্ষরাজি, পাখপাখালি কী অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। আমরা এখন যে শহরে বাস করি, সেখানে প্রকৃতি নেই, সবুজ মাঠ নেই, স্রোতস্বিনী নদী নেই, কঠিন কংক্রিটের পাথরে তৈরি এই শহর যেন আমাদের জীবনকেও পাথর করে দিয়েছে। এখানে বক, গাঙচিল, শালিকের আনাগোনা নেই। এখানে থই থই জলে ডুবসাঁতার নেই, এখানে প্রস্ফুটিত শাপলার সঙ্গে কিশোরীর লুকোচুরি খেলা নেই। এক কোলাহলময় অথচ নির্জীব শহরে আমরা বাস করছি অথবা আমরা করতে বাধ্য হচ্ছি। পৃথিবীর খুব কম শহরই আছে, যার তিন দিকে নদী আছে। সেই হিসেবে ঢাকা হতে পারত প্রকৃতি ও আধুনিক স্থাপত্যের আশ্চর্য সমন্বয়। কিন্তু আমরা নদীগুলোকে রক্ষা করতে পারিনি, প্রতিদিনের আগ্রাসনে ও আক্রমণে আমরা নদীগুলোকে হত্যা করে চলেছি। ঢাকা যেমন দুনিয়ার দ্বিতীয় নোংরা শহর তেমনি বুড়িগঙ্গা অসম্ভব দুর্গন্ধময় একটি নদী। অথচ এই নদীর সঙ্গে মেঘনার সরাসরি যোগাযোগ, এই নদী দিয়েই একসময় নৌপথে সারা দেশে পণ্য পরিবহন হতো। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এখানে নদী কেবল পরিবহনের মাধ্যম বা মৎস্যসম্পদের আধার নয়, নদী হলো আমাদের জীবনের অংশ। আমাদের শৈশব, আমাদের কৈশোর কেটেছে এই নদীর পাড়ে, নদীর ভাঙা-গড়ার সঙ্গে জোয়ার-ভাটার সঙ্গে আমরা বেড়ে উঠেছি, জীবনকে উপলব্ধি করতে শিখেছি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝির হোসেন মিয়া মেঘনার মোহনায় ময়নার চরে আবাস গড়েছিলেন কুবেরকে নিয়ে। এরকম হাজার হাজার কুবের আছেন, ডাঙা নয়, নদীতেই যারা ঘর বাঁধেন। আমাদের শৈশবে দেখেছি বর্ষাকালে নদীর জোয়ারে দুইপাড় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেত। মাঝে মধ্যে গাছের সারি ও বাড়িঘর দেখা যেত। যাদের ঘরবাড়ি খানিকটা নিচু, তাদের কয়েকদিন জলবাস করতে হতো। টানা কয়েকদিন বর্ষা হলে নৌকাই ছিল চলাচলের একমাত্র অবলম্বন। কেউ কেউ নৌকাজীবন বেছে নিতেন জীবিকার জন্য। সেই নদী এখন নেই। এখনও নদীতে নৌকা-লঞ্চ চলে, দূরবর্তী বন্দর থেকে পণ্যবাহী জাহাজ আসে। কিন্তু রাত জেগে জেলেদের মাছ ধরতে দেখা যায় না। রবীন্দ্রনাথ ফিরিয়ে দাও সেই অরণ্য বলে আক্ষেপ করেছিলেন। শহরে প্রকৃতি নেই বলে ভালবাসা নেই, স্নেহ মমতা নেই। এই ভালবাসার টানেই জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথ পদ্মার পাড়ে ছুটে গিয়েছিলেন। তার কাব্য, তার গান, তার ছোট গল্পের বিরাট অংশজুড়ে আছে প্রকৃতি, আছে পদ্মা ও তার দুই পাড়ের শ্যামল প্রান্তরের জীবনধারা। এই পদ্মার বোটে বসেই তিনি লিখেছিলেন সোনারতরী। নদী মানে কেবল পারাপার নয়, নদী মানে কেবল চলাচল নয়, নদী মানে জীবন, নদী মানে স্বপ্ন, নদী মানে ভালবাসা, নদী মানে প্রকৃতি। মডেল : সাদিয়া ও মেরিন ছবি : রনি রেজাউল
×