ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোরীরা নিজেরাই ঠেকাচ্ছে তাদের বাল্যবিবাহ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৩ জুলাই ২০১৭

কিশোরীরা নিজেরাই ঠেকাচ্ছে তাদের বাল্যবিবাহ

আনোয়ার রোজেন ॥ চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার প্রত্যন্ত সীমান্ত ইউনিয়নের কিশোরী সোহাগী (১৪)। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী মেধাবী এ কিশোরীর স্বপ্ন শিক্ষক হওয়ার। পড়াশোনায় ভাল হওয়ায় স্থানীয় গয়েশপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের মাঝে সে জনপ্রিয়। কিন্তু স্বপ্নপূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নিজেরই বাবা-মা। হঠাৎ একদিন বাড়িতে বিয়ের জন্য পাত্রপক্ষ হাজির। তারা সোহাগীর বাবা আবদুল খালেক ও মা রোজিনা বেগমকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়ে ফেলে। উপায়ন্তর না পেয়ে বন্ধুদের বিষয়টি জানায় সোহাগী। এ ঘটনার কিছুদিন আগেই সোহাগী ও তার বন্ধুরা পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) পরিচালিত ‘বাল্যবিবাহ রোধে করণীয়’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তারা বিষয়টি দ্রুত স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি, শিক্ষক ও পিকেএসএফের সমৃদ্ধি ওয়ার্ড কমিটিকে অবহিত করে। এর ফলে তৎপর হন সংশ্লিষ্টরা। এভাবেই সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে বিয়েটি বন্ধ হয়। পিকেএসএফের হিসাবে এমন সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের ১৬ ইউনিয়নে পাঁচ মাসে ২০ বাল্যবিবাহ ঠেকানো গেছে, যা বাল্যবিবাহ রোধের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, ভৌগোলিক ও আর্থসামাজিকভাবে এ ইউনিয়নগুলোর অবস্থান প্রান্তিক পর্যায়ে। এ প্রসঙ্গে পিকেএসএফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ড. জসীম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে এককভাবে কারও পক্ষে বাল্যবিবাহ ঠেকানো কঠিন। এজন্য প্রয়োজন সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগ। দেশজুড়ে থাকা বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন ও চলমান বিভিন্ন কর্মসূচী বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। যেমন- গ্রাম এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদের একজন চেয়ারম্যান বা কয়েক মেম্বারের পক্ষে সব সময় বাল্যবিবাহের বিষয়ে নজর রাখা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে আমরা প্রতি ওয়ার্ডে, স্কুলে এবং শিক্ষার্থী-তরুণ-যুবকদের সমন্বয়ে সক্রিয় কমিটি করে এসব বিষয় তাদের নজরে আনছি। এতে কাজও হচ্ছে। যেমন- একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার বড়তারা ইউনিয়নের ১৫ বছর বয়সী কিশোর রকি চন্দ্র মালীর জীবনে। বাবা গিরেন চন্দ্রের বড় ছেলে রকি বরাবরই বাবা-মার কাজে সহযোগিতা করে। দরিদ্রতা এবং অজ্ঞানতার দরুন রকির দাদি ঠিক করেন, রকিকে বিয়ে করিয়ে যৌতুকের টাকা দিয়ে একটি ব্যবসা ধরিয়ে দেবেন। কিন্তু রকির সম্মতি না থাকা সত্ত্বেও পরিবারের চাপে তাকে বিয়েতে রাজি হতে হয়। গ্রামে খবরটি ছড়িয়ে পড়লে পিকেএসএফের সমৃদ্ধি কর্মসূচীর শিক্ষা সহায়তা কেন্দ্রের কর্মকর্তারা স্থানীয় সহযোগী সংগঠনের মাধ্যমে বিয়েটি বন্ধ করতে রকির পরিবারকে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এতে কাজ না হওয়ায় অবশেষে তারা সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) বিষয়টি জানায়। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বিয়েটি বন্ধ করে দেন। সূত্র জানায়, উন্নয়নের বহুমাত্রিক ধারণায় সম্পৃক্ততার অংশ হিসেবে পিকেএসএফ তার সহযোগী সংস্থাগুলোর বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করছে। এর অংশ হিসেবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে মাদক, বাল্যবিয়ের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘সোশ্যাল এ্যাডভোকেসি এ্যান্ড নলেজ ডিসেমিনেশন’ ইউনিট। এ ইউনিট অন্যান্য জনসচেতনতামূলক কাজের পাশাপাশি পিকেএসএফের সমৃদ্ধি কর্মসূচীভুক্ত প্রান্তিক ১৬ ইউনিয়নে নারী ও শিশুর অধিকার রক্ষায় বিশেষ করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। জসীম উদ্দিন বলেন, বৃহৎ পরিসরে জনসচেতনতা বৃদ্ধির একটি পূর্বশর্ত হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এ দিকটি বিবেচনা করে পিকেএসএফ সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, শিক্ষক, ইমাম, কাজী, যুবসমাজের প্রতিনিধি, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ‘সামাজিক উন্নয়ন ও দায়বদ্ধতা’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। জানা গেছে, এর আওতায় এ পর্যন্ত দুই হাজার ১২৮ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ে আলোচনা সভা, প্রশিক্ষণ ও এ্যাডভোকেসি কর্মশালা চলমান রয়েছে। ১৬ ইউনিয়নে ৪০ মাধ্যমিক ও সমমানের স্কুলের ৫৯৫ শিক্ষক ও ১০ হাজার ২৩৫ ছাত্রছাত্রীকে ওরিয়েন্টেশন প্রদান করা হয়েছে। এ ওরিয়েন্টশন কর্মসূচী এখনও চলমান রয়েছে। এছাড়া সহায়তা করা হয়েছে ‘কিশোরী ক্লাব’ গঠনে। এটি বাস্তবে বাল্যবিবাহ রোধে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে এবং সমবয়সীদের মাঝে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করাতেও সহায়তা করছে। এর পাশাপাশি যুবসমাজও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে। এসব কার্যক্রমের ফলেই চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ২০টি বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব হয়েছে। ইউনিয়নগুলো হলোÑ নওপাড়া, পাঁচগাঁও, সীমান্ত, এলেঙ্গা, আইয়ুবপুর, দুর্গাপুর, গণিপুর, সুকুন্দী, বরকল, দেবীডুবা এবং বড়তারা।
×