ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ফিরোজ আহমেদ

অভিমত ॥ আইসিডিডিআরবির কথিত কথন

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২৩ জুলাই ২০১৭

অভিমত ॥ আইসিডিডিআরবির কথিত কথন

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষসহ বিশ্বের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা গবেষণা সংশ্লিষ্ট অনেকেই জানেন যে, আইসিডিডিআরবি একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। আসলে এটি বাংলাদেশ সরকারের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৮ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত সিয়াটো কলেরা রিচার্স ল্যাবরেটরিকে আইসিডিডিআরবিতে রূপান্তর করে। বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের কারণে অধ্যাদেশটি বাতিল হওয়ায় বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের উদ্যোগে ‘আইসিডিডিআরবি আইন’ প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন আছে। অধ্যাদেশের প্রবিধানে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশীদের ইউএন স্তর ও বাংলাদেশীদের ইউএন স্তরের সমতুল্য বেতন সুবিধাদিসহ দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে ট্যাক্স-ভ্যাট ফ্রি যন্ত্রাংশ ও রসদ আমদানি, সরাসরি সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া মানব নমুনা পৃথিবীর যে কোন দেশে প্রেরণ এবং অন্যান্য গবেষণাবান্ধব বিশেষ ব্যবস্থার ক্ষমতা দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত সতেরো (১৭) সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদÑ বোর্ড অব ট্রাস্টিসের উপর অর্পণ করে। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে স্বাস্থ্য সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক, এই তিনজন সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। উল্লেখ্য, মহাখালীতে চার একর জমিসহ সকল স্থাপনা সরকারী টাকায় তৈরি এবং আইসিডিডিআরবি পরিচালনায় ব্যয়ের সিংহভাগই প্রতিবছর সরকার কর্তৃক বরাদ্দ দেয়া হয়। যুগান্তকারী ওরস্যালাইন আবিষ্কারের গৌরব নিয়ে যাত্রা শুরু করা আইসিডিডিআরবি সময়ের আবর্তে একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার পর্যায়ে চলে এসেছে। বোর্ড অব ট্রাস্টিসের চেয়ারম্যান ও নির্বাহী পরিচালকের পছন্দের সদস্য নিয়োগের মাধ্যমে নিজস্ব সিন্ডিকেট গঠন, প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ উচ্চ-প্রশাসনিক পদগুলোতে বিদেশীদের সংখ্যাধিক্যসহ কিছু উচ্চপদস্থ বাংলাদেশী কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানীর কর্মরত বিদেশীদের মতো বেতন ও অন্য সুবিধাদির লোভ-লালসা পরিস্থিতি জটিল করেছে। গবেষণার সিংহভাগ বিদেশীদের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে, দেশের চাহিদা মেটাতে নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ সকল বাঙালী-বিদেশী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আইসিডিডিআরবি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে। বর্তমানে স্বল্পসংখ্যক বিজ্ঞানী একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর গবেষণা করায় গবেষণা ক্ষেত্রগুলো বৈশ্বিক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশে ডায়রিয়াজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব ও ডায়রিয়া সংক্রান্ত চলমান গবেষণার ক্ষেত্র হওয়ায় এ সম্পর্কিত বিজ্ঞানীদের দুয়েকটি সিন্ডিকেট প্রতিষ্ঠানটির বৈদেশিক অনুদান থেকে শুরু“করে বোর্ড অব ট্রাস্টিসের সদস্য নিরূপণ, নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ ও অন্য সকল বিষয়ে পর্দার অন্তরাল থেকে নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তিগত স্বার্থে ও ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার প্রয়াসে উল্লিখিত কয়েকজন বাংলাদেশী বিজ্ঞানী এ সকল সিন্ডিকেটের সহায়তায় প্রতিষ্ঠানটিকে গণমুখী করার পরিবর্তে নিজেদের ব্যবসা কেন্দ্র্রে পরিণত করেছেন। সার্বিক পরিস্থিতির পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমান নির্বাহী পরচালক ডাঃ জন ক্লিমেন্সের নিয়োগের মধ্য দিয়ে আইসিডিডিআরবি দেউলিয়া প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চলেছে। এই ডাঃ জন ক্লিমেন্স আশির দশকে আইসিডিডিআরবিতে এসে মতলব উপজেলায় কলেরা ভ্যাকসিন ট্রায়াল পরিচালনা করে মূল তথ্য-উপাত্তের (ডাটা) কপি প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ না করে চলে যান। পরবর্তীতে ওই গবেষণার ফলাফল সংশ্লিষ্ট মহলে বিতর্কের সৃষ্টি করে। নির্বাহী পরিচালক ডাঃ ডেভিড স্যাক ২০০০ সালের দিকে বারবার ডাঃ জন ক্লিমেন্সকে গবেষণার মূল তথ্য-উপাত্তের (ডাটা) জন্য তাগাদা দিলেও তিনি তা আইসিডিডিআরবিকে ফেরত দেননি। ডাঃ জন ক্লিমেন্স ২০১৩ সালে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পাবার পর অধ্যাদেশের মূল কাঠামোর পরিবর্তন করে চীফ অপারেটিং অফিসার নিয়োগ করেন। অতঃপর ক্ষমতা নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। আইসিডিডিআরবির যে কোন স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রয় ও হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমতি বাধ্যতামূলক। কিন্তু, সে সবের তোয়াক্কা না করেই বর্তমান বোর্ড অব ট্রাস্টিসের চেয়ারম্যান ডাঃ রিচার্ড স্মিথ যিনি একজন জার্নাল ব্যবসায়ী, ডাঃ জন ক্লিমেন্সের সহায়তায় আইসিডিডিআরবির মালিকানাধীন বাংলাদেশের একমাত্র ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর সম্বলিত আন্তর্জাতিক মানের জার্নাল, ‘জেএইচপিএন’ বিক্রির নাটক সাজিয়ে বায়োমেড সেন্ট্রাল কোম্পানির সঙ্গে শেয়ারে নিজের করে নিয়েছেন। এছাড়া জন ক্লিমেন্সের বর্তমান সময়ে অযথা বিদেশী কনসালটেন্ট নিয়োগ ও বিদেশীদের কর ফাঁকির মাত্রা বহুগুণে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশী স্টাফদের সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে অস্থায়ী পদে স্বল্পমেয়াদী চাকরি প্রথার ব্যাপক প্রয়োগ করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তন করে অবৈধভাবে কয়েকজন বাংলাদেশীকে বিনা পরীক্ষায় সিনিয়ার ডিরেক্টর নিয়োগ করা হয়েছে। প্রশাসনিক সাধারণ পদগুলোতে, যেখানে দেশী অভিজ্ঞ জনবল বিদ্যমান, সেখানে চড়া বেতনে (প্রতি মাসে ১৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার মার্কিন ডলার) বিদেশীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, অথচ ঘন ঘন আর্থিক সঙ্কটের কথা বলে দেশী স্টাফ ছাঁটাই করা হচ্ছে। জন ক্লিমেন্স প্রশাসন আইসিডিডিআরবির মৌলিক গবেষণা সঙ্কুচিত করে শত শত লিটার মানব নমুনা বিদেশে প্রেরণ করছেন, যেখানে পাশের দেশ ভারত থেকে এক (১) মিলিলিটার রক্তের নমুনাসহ মানব নমুনা বিদেশে প্রেরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। উল্লেখ্য, উন্নত বিশ্বে এসব নমুনার ভীষণ সঙ্কট আছে এবং সংগ্রহে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। প্রকৃতপক্ষে, এদেশের গরিব মানুষদের গিনিপিগ বানিয়ে বিদেশীদের নমুনা সংগ্রহ করার কাজে আইসিডিডিআরবিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব নমুনা বিদেশে প্রেরণ না করে দেশে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করলে দেশী বিজ্ঞানীদের বিকাশ ও বিজ্ঞান চর্চার দ্বার উন্মুক্ত হতো, ঠিক যে লক্ষ্যে আইসিডিডিআরবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, সব জেনেও সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো নির্বিকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহের কেবিনেট সভায় আইসিডিডিআরবির চার সহস্রাধিক স্টাফের সকল অসুবিধার কথা জেনে প্রাক্তন স্বাস্থ্য সচিব মনজুরুল ইসলামকে প্রতিষ্ঠানটির সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেয়ায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে আকার ধারণ করেছে। বিস্তারিত জানবেন পরবর্তী পর্বে। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
×