ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাছের সুদিন

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২৩ জুলাই ২০১৭

মাছের সুদিন

সেই একদিন ছিল, যখন বাঙালী সখেদে উচ্চারণ করত ‘মৎস্য মারিবো, খাইবো সুখে।’ অবশ্যই সুখের সঙ্গে মৎস্যের স্বাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের সঙ্গে নানা বাহারি মাছ রসনাতৃপ্ত করত। কত জাত-প্রজাতির মাছ খেলা করত খালে-বিলে, পুকুর-নদীতে। ছিপ বড়শি বা জালে উঠে আসা মাছ সূর্যের আলোতে চিকচিক করত। দেখে হয়ত নয়ন জুড়াত। প্রতিটি বাঙালী পরিবার, তা সে ধনী, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত যাই হোক, খাবারের পাতে মাছ না হলে ক্ষুণিœবৃত্তি মিটত না। আঠারো ও উনিশ শতকের কবি মুকুন্দরাম ও ভারতচন্দ্রের কাব্যে মাছের বর্ণনা মেলে। সেকালের পুকুর ভরা মাছের কাহিনী বর্ণিত হয় একালেও। কিন্তু সেও ছিল বিত্তবানের পুকুরের মাছ। দরিদ্রজন নালা, ডোবা, জলাশয় থেকে মৎস্য আহরণ করত। একালে তো খাল, নালা, ডোবা, জলাশয়, এমনকি নদী আর নেই সেভাবে। সবই ভরাট হয়ে গেছে দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে। গড়ে উঠেছে ঘরবাড়িসহ নানা স্থাপনা। তাই মাছের চারণভূমি হ্রাস পেয়েছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে বহু প্রজাতির মাছ। নানা মাছের নানা পদ এখন আর মেলে না। অনেক মাছ তো কেবলই স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে বয়সীদের কাছে। সবার পাতে মাছের সমাহার আর দেখা যায় না। বহু পরিবার আছে কালেভদ্রে মাছের স্বাদ পায়। মৎস্যের আকাল পড়েনি যদিও। কিন্তু মৎস্য চাষ বা পালনের জন্য পুকুর, নদীর ঘাটতি যতই বেড়েছে, ততই মাছের সাম্র্রাজ্য সীমিত হয়ে পড়েছে। চাহিদানুযায়ী মাছের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার বৈকি। কারণ প্রতিদিন গড়ে যদি পঞ্চান্ন থেকে ষাট গ্রাম মাছ খাওয়া হয়, তাহলে প্রয়োজন বাষট্টি লাখ টন মাছের। কিন্তু দেশে বর্তমানে উৎপাদন চল্লিশ লাখ টন। অবশ্য লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও দেশে মাছের উৎপাদন বেশি হচ্ছে। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে পঁয়তাল্লিশ লাখ টন মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কিন্তু মৎস্য চাষ যে হারে বাড়ছে, তাতে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এখন তো ধানী জমিতে পানির ঘের দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এদিক থেকে দেখতে গেলে দেশ মাছ উৎপাদনে ক্রমান্বয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে যাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে আগামী তিন বছরেই অতিরিক্ত ছয় লাখ টন মাছ উৎপাদন হবে। ধারাবাহিক গড় প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কারণে খাতটি বর্তমানে প্রশংসনীয়। তবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে মাছের উৎপাদন বাড়াতে বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তিবান্ধব উপায়ে মাছ চাষ করা প্রয়োজন। তাই মাছ চাষের প্রান্তিক পর্যায়ে প্রযুক্তির প্রসার ঘটাতে হবে। সরকার প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিয়ে গবেষণা উৎসাহিত করায় দেশে বিভিন্ন জাতের মাছের উৎপাদন বেড়েছে। এক কোটি বিরাশি লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা এখন মৎস্যসম্পদের সঙ্গে সম্পর্কিত। জিডিপিতে মৎস্যসম্পদের অবদান প্রায় চার শতাংশ। দেশের প্রাণিজ আমিষের ষাটভাগের জোগান আসে মৎস্য খাত থেকে। অবশ্য চাহিদা মেটানো না গেলেও মিঠা পানির মৎস্য আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। মৎস্য উৎপাদন ও মৎস্য চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়নে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে ফাও মৎস্য অধিদফতরকে ‘এডওয়ার্ড ট্রমা’ পুরস্কারে ভূষিত করেছিল। হাওড়ে মাছ চাষ বাড়াতে হলে ভেতরের খালগুলো ড্রেজিং করা জরুরী। বিল ও জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে রফতানি বাড়ানো যায়। আধুনিক মান নিয়ন্ত্রণ ল্যাব এ খাতে আরও বাড়ানো দরকার। সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর সমুদ্রের আয়তন বেড়েছে। সুতরাং মৎস্য আহরণ বাড়ানো যায়। সরকার নতুন জলমহাল নীতিমালা করায় মাছ উৎপাদন বেড়েছে। জেলেদের আর্থিক অনুদান প্রদানের পরিমাণও বেড়েছে। জাতীয় চিংড়ি নীতিমালা প্রণীত হওয়ার পর রফতানির পরিমাণও বেড়েছে। জাটকা নিধন বন্ধ করায় ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে। তবে সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছেÑ মাছে ফরমালিনের অত্যধিক ব্যবহার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উদ্বোধনকালে বলেছেন, মুনাফার লোভে যারা এ কাজ করছে তারা দেশের সর্বনাশ করছে। ফরমালিনের অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। দেশবাসীও এই বিষ থেকে মাছের মুক্তি চায়। পরিকল্পিতভাবে মৎস্য চাষ, আহরণ, বিপণন ও রফতানি করা হলে দেশবাসী ‘মৎস্য মারিবো, খাইবো সুখে’ বলে গান গেয়ে উঠতে পারবে। ‘মাছ চাষে গড়ব দেশ, বদলে দেব বাংলাদেশ’ সেøাগান পাবে সার্থকতা। মাছে-ভাতে বাঙালীর জীবনে নানা প্রজাতির মাছে ভরে উঠুক পাতÑ সেই কামনা।
×