ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেলওয়ার হোসেন

মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক মামা এক বীরের গল্প

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ২২ জুলাই ২০১৭

মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক মামা এক বীরের গল্প

প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। আমার বাড়ির পরের স্টেশনের সেন্টরুমে (শপিং সেন্টার) গেছি। দেখি-ফুড কোর্টের লনে বসে আছেন সুঠামদেহী আকর্ষণীয় চেহারার মধ্য বয়সী এক সুদর্শন পুরুষ। তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার দিকে। চোখ পড়তেই বিনয়ের সঙ্গে খুব আপনজনের মতো করে সালাম ঠুকে দিয়েই দরাজ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন , কী ভাই– বাঙালী না-কি? তিনি কাক্সিক্ষত জবাবটা পেয়েই অদম্য কৌতূহল নিয়ে স্বভাবজাত নিয়মে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্য দিয়ে যখন তিনি জানলেন, শহীদের সন্তান হিসেবে আমার পরিচয়, তখন বিস্ময়াবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন, সর্বনাশ– আমার বাড়ির পাশে থেকেও আপনার পরিচয় আমি জানতে পারিনি এতদিন? কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ভাই? আলিঙ্গনে তার বুকের উষ্ণতায় অনুভব করলাম যেন পৃথিবীর সমস্ত ভালবাসা, স্নেহ, মায়া-মমতা উজাড় করে দিয়ে তার আত্মার ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে চাইছেন আমাকে। আমি নির্বাক। আবেগে আমরা দুজনেই বাষ্পরুদ্ধ। মহানুভব মনের এই মানুষটি খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন নিকটেই তার বাসায়। ভাবি দরজা খুলে দিতেই যে মর্মস্পর্শী ভাষায় তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাতে কেউ আর নিজেদের আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না। মুহূর্তেই পরিবেশটা হয়ে উঠল বেদনাভারাক্রান্ত। আমি কিছু বলার আগেই মামা বলে উঠলেন, আপনি আজ থেকে জেনে নিন দেলওয়ার ভাই, বাংলাদেশের প্রতিটি শহীদ পরিবারের সন্তানই আমার নিজের সন্তান। আমি সেলুট করি বাংলাদেশের প্রতিটি শহীদ পরিবারকে। এরপর খাবার কথা বলেই হাত ধরে টেনে নিয়ে বসালেন ডাইনিং টেবিলের সামনে। লাঞ্চের সময়। টেবিলে সাজানো লোভনীয় রকমারি আয়োজন। অতিশয় অতিথিপরায়ণ পুরনো ঢাকায় জন্ম নেয়া মামা ও তার সহধর্মিণীর বাসার ডাইনিং টেবিল সর্বক্ষণিক সাজানো থাকত এভাবেই পর্যাপ্ত রকমারি আইটেমে। খাওয়া শেষে সোফায় বসে মামার মুখে সেই যে শুরু হলো রণাঙ্গনের গল্প তা যেন আর শেষ হতেই চায় না। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এর মধ্যে হরেক রকমের মুখরোচক খাবার পরিবেশনে ভাবির ছিল না এতটুকু ক্লান্তি। চেনা-অচেনা সকল অতিথি সেবায় দুজনই ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। এই হিসেবে বলা যায় মামার বাড়িটি ছিল এক লঙ্গরখানা। পেনশনের সামান্য আয়ের ওপর নির্ভরশীল মামার সংসারে সচ্ছলতা না থাকলেও অতিথি সেবায় তার পরিবারটি ছিল রাজ পরিবারের দেয়া আতিথেয়তার মতোই তুলনীয়। চেনা-অচেনা, জানা-অজানা সকল মানুষের জন্যই তার ঘরের দুয়ার ছিল ২৪ ঘণ্টাই খোলা। যে কারও বিপদে আপদে সবার আগে এগিয়ে আসা, বিপদগ্রস্তকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেয়ার মতো মহৎ কাজে মামা ও তার স্ত্রী সৈয়দা আখতারুন্নেসা রোজি ছিলেন উদারপ্রাণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রীধারী এই সুগৃহিণীকে মামা ডাকতেন সুরভী নামে। এদিন থেকেই বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক মামা ও তার পরিবার যেন হয়ে গেল আমার আত্মার আত্মীয়। নিয়মিত দেখা-সাক্ষাত ও আসা-যাওয়া থেকে শুরু করে প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত টেলিফোন আলাপ উভয়ের জন্যই হয়ে গিয়েছিল একটি নেশার মতো ব্যাপার । নিজের জীবন ও রণাঙ্গনের বীরত্ব গাথার বর্ণনা ক্লান্তিহীনভাবে চলত দিনের পর দিন। এত আগ্রহ নিয়ে শোনার পরও আজ পর্যন্ত তার গল্প আমার কাছে অসমাপ্তই রয়ে গেছে। শহীদুল হক মামার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক বন্ধুত্ব বেশ নিবিড় হয়ে ওঠে। তার ছোট ছেলে সামি ছিল আমার ছেলে রিশাদের স্কুল সহপাঠী। দুজনই ছিল একে অপরের হরিহর আত্মা। শহীদ ভাইয়ের কাছে রিশাদ ছিল সামির মতোই প্রাণপ্রিয়। সেই সামি ২০০৬ সালে ১৬ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। অতি আদরের সন্তানকে হারিয়ে এই পরিবারটি কি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় সে কথায় পরে আসছি। সামির এই মৃত্যু রিশাদকে যেভাবে নাড়া দিয়েছে, তার গভীর সন্তাপ আজও বয়ে বেড়াচ্ছে আমার সন্তান। অনেক রাত কাটে, সে ঘুমাতে পারে না প্রাণপ্রিয় বন্ধু সামির জন্য। সে নিয়মিত যায় তার কবরে ফুল দিতে। কখনও মন বেশি খারাপ হলে ভয় ডর উপেক্ষা করে যায় সন্ধ্যার ঘন অন্ধকারে। সে আমাকে অনেকবার বলেছে, পাপা আমি মরে গেলে আমাকে সামির পাশে কবর দিও। দুই ছেলে ও এক মেয়ের পরিবারের সদস্য থেকে অতি আদরের প্রিয় এক সন্তান অকালে ঝরে পড়ায় শহীদুল হক মামার পরিবারে নেমে আসে এক ভয়াবহ মানসিক বিপর্যয়। শহীদুল হক মামার অত্যন্ত আদরের ছোট ছেলে সামি ছিল তার মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার এক অতি উৎসাহী শ্রোতা ও তার সর্বক্ষণিক সঙ্গী। প্রতিদিন সে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ত। শহীদ ভাই আমাকে সে কথা প্রায় প্রতিদিনই বলতেন। সামির অকাল মৃত্যুতে সিংহ হৃদয়ের বলিষ্ঠ মামা ভেতর থেকে ভেঙ্গে পড়েন কাঁচের মতো চূর্ণ-বিচূর্ণরূপে। সুইডেন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মামা অসুস্থ হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেন সক্রিয় কর্মকাণ্ড থেকে। স্ত্রী হয়ে পড়েন শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীষণ অসুস্থ। পার্থিব সকল সুখ ও বৈষয়িক অর্জনের মোহ বিবর্জিত মামা চোখে বড় স্বপ্ন নিয়ে একমাত্র মেয়ে শায়লাকে উচ্চ শিক্ষার্থে পাঠিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। সামির অকাল মৃত্যুতে পরিবারের সেই স্বপ্নও ধূলিসাত হয়ে যায়। লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখে শায়লা সুইডেনে ফিরে এসে অসুস্থ মা-বাবার পাশে দাঁড়ায়। একমাত্র বড় ছেলে খালেদের পড়াশোনায়ও ঘটে সাময়িক ছেদ। সুইডেনপ্রবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা, ’৭১-এর রণাঙ্গনের ২ নম্বর সেক্টরে খালেদ মোশারফ ও মেজর হায়দারের সহযোদ্ধা, গেরিলা মামা বাহিনী প্রধান, অকুতোভয় বীর যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের নিয়ামক দ্বিতীয় রাজসাক্ষী শহীদুল হক মামা কাতারের একটি হাসপাতালে দীর্ঘ দুটি মাস লাইফ সাপোর্টে জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে জীবনের রণাঙ্গন থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান পরপারে ৩০ জুন। দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ দেশপ্রেমিক এই বীর মুক্তিযোদ্ধা তার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশেই থাকতে বেশি পছন্দ করতেন। শুধু চিকিৎসার প্রয়োজনে স্বল্প সময়ের জন্য তিনি সুইডেনে অবস্থান করতেন। কিছুদিন বাংলাদেশে থাকার পর চিকিৎসার প্রয়োজনে তিনি বাংলাদেশ থেকে ২৮ এপ্রিল কাতার এয়ারোয়েজে সুইডেনের পথে রওনা হন। দীর্ঘদিন যাবত নানা জটিল রোগে ভুগতে থাকা এই বীর বিমানে অসুস্থ হয়ে পড়লে ২৯ এপ্রিল তাকে দোহার আল ওয়াকার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থার অবনতি হতে থাকলে তাকে ৩ মে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। খবর পেয়ে স্টকহোল্ম থেকে তার অসুস্থ স্ত্রী, একমাত্র ছেলে খালেদ ও মেয়ে শায়লা দোহা রওনা হন। সেখান থেকে তার লাশ ৩ জুলাই তারিখে নিয়ে যাওয়া হয় বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, আফসার বাহিনী, বিচ্ছু জালাল বাহিনী ও মামা বাহিনী নামে যে বাহিনী ছিল, সেই মামা বাহিনীর প্রধান ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ শহীদুল হক মামা। দেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হলেও রণাঙ্গনের ২ নম্বর সেক্টরের মেলাঘর ইউনিটের প্রধান এই বীর সেনানী নিজের জীবন বাজি রেখে অতুলনীয় পরাক্রমের সঙ্গে আত্মসমর্পণ না করা স্বাধীনতার শত্রু বিহারিদের দখলে থাকা দুর্ভেদ্য ঘাঁটি মিরপুর-মোহাম্মদপুর মুক্ত করেন ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। এ এক অসামান্য বীরত্বগাথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। যুদ্ধাপরাধী কসাই কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অন্যতম সরকারী সাক্ষী ছিলেন শহীদুল হক মামা। চরম হুমকি ও প্রলোভনের মুখেও অনড় থেকে কাদের মোল্লার মিথ্যাচার ও বিকৃত তথ্য উপস্থাপনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আদালতে হাজির হন তিনি। কাদের মোল্লা যখন নিজেকে প্রকৃত কাদের মোল্লা না এবং নির্দোষ হিসেবে প্রমাণের চেষ্টায় প্রায় সফলতার দিকে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই শহীদ মামা ২ নম্বর রাজসাক্ষী হিসেবে আদালতে হাজির হয়ে তাকে প্রকৃত ক্রিমিন্যাল, কুখ্যাত গোলাম আযমের সহচর, কবি মেহেরুন্নেসা, তার মা ও দুই ভাইকে ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সালে সহযোগী হাসিব হাশমী, আব্বাস চেয়ারম্যান, আখতার গু-া, নেহাল ও প্রমুখদের নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা ও টুকরো টুকরো করার কসাই হিসেবে শনাক্ত করেন, তখনই এই মামলা মোড় নেয় তার নির্ঘাত ফাঁসি সাব্যস্তের দিকে। এই সাক্ষ্যের ফলে যুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২, ২৮ মে, ২০১২ তারিখে ৬টি অপরাধ প্রমাণের ভিত্তিতে কাদের মোল্লাকে ফাঁসির রায় দেন। তার আগে ফাঁসির সাজা এড়িয়ে যাওয়া রায়ের বিরুদ্ধে এবং ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে যে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে ওঠে, সেখানে সুইডেন থেকে অসুস্থ শরীরে গিয়ে যোগ দেন মামা। এই অসুস্থ শরীরেই তিনি নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ ও খাওয়া-দাওয়া ছাড়াই সেখানে পড়ে থাকেন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। জামায়াতের ঘাঁটি বিভিন্ন জেলায় কাদের মোল্লার পক্ষে যে তীব্র মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছিল, তার বিপক্ষে ফাঁসির জনমত গড়ে তোলার জন্য তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে হুমকি উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাল-তলোয়ারবিহীন অবস্থায় গেছেন জেলায় জেলায় ছুটে। এই গণজাগরণ মঞ্চে বজ্রকণ্ঠে যে ফাঁসির আওয়াজ তিনি তোলেন , তা থেকেই জেগে ওঠে দেশব্যাপী গণজাগরণ এবং শাহবাগে গণমানুষের উত্তাল ঢল। তিনি রাতারাতিই হয়ে ওঠেন দেশবরেণ্য অকুতোভয় বীর। দেশ-বিদেশের মিডিয়ায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তিনি হয়ে ওঠেন আলোচনার কিংবদন্তি প্রাণপুরুষ এবং বিশেষত টকশোর শিরোমণি। মানুষ তন্ময় হয়ে শুনত তার অসাধারণ বজ্রবাণী। শহীদ মামাকে আমি শহীদ ভাই বলেই ডাকতাম। বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার বাবার মতো। তবুও কেন আমাকে দেলওয়ার ভাই এবং আপনি সম্বোধন করেন, অত্যন্ত বিব্রতচিত্তে এর কৈফিয়ত ও আর্জি তার কাছে বার বার পেশ করেও কোন লাভ হয়নি। তিনি বার বার বিস্ময় নিয়ে বলে উঠেছেন, সর্বনাশ বলেন কী, দেশের জন্যে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেয়া শহীদের সন্তান আপনি। আপনাকে আমি সেলুট করি। সেলুট করি আপনার মহান শহীদ বাবা-মাকে। আমরা একটা দেশ পেয়েছি তাদের ত্যাগের জন্য। জাতি তাদের কি সম্মান দিয়েছে? আমরা তো শুধুই যুদ্ধ করেছি। দেশের জন্য জীবন তো আর দেইনি। এই স্বাধীনতার জন্য যদি আমি নিজে শহীদ হয়ে যেতাম, তাহলে আমার জন্মটাকে আমি সার্থক মনে করতাম। আপনাদের গোটা পরিবারকেই আমি সেলুট করি এ জন্য। এ জাতির ক্ষমতা নেই আপনাদের অবদানের কোন মূল্য দেয়ার। আছে শুধু এইটুকু সম্মান। আমি কেন আপনাকে সেটা দেব না ভাই? এখানে বয়সের প্রশ্ন তুলবেন না দেলওয়ার ভাই। সম্মানিত ব্যক্তির কোন বয়স হয় না। কিশোর বয়সী রাজাকেও তো মানুষ কুর্ণিশ করে, কেন করে বলুন তো? আমি তার যুক্তির কাছে নির্বাক হয়ে যেতাম। এরপর আসে মজার প্রসঙ্গ। তিনি যখন সুইডেন আওয়ামী লীগের সভাপতি, তখন পত্রিকায় দেয়ার জন্য তার দেয়া একটি নিউজ আমি করেসপনডেন্ট হিসেবে সুইডেন থেকে পাঠিয়েছিলাম জাতীয় দৈনিকে। সেই নিউজে আমি সৈয়দ শহীদুল হক মামা থেকে মামা শব্দটি বাদ দিয়েছিলাম। প্রকাশিত নিউজটি পড়ার পর মামা টাইটেলটি বাদ পড়া দেখে তিনি ভীষণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। আমাকে কৈফিয়ত দিতে হয়েছিল, কেন মামা শব্দটি বাদ গেল? আমি নিজের গা বাঁচানোর জন্য বলেছিলাম, এটা নিউজ এডিটরই বাদ দিয়েছেন। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই যেন আগুনে ঘি ঢালার মতোই তিনি দ্বিগুণ তেজে জ্বলে উঠলেন। আমি প্রশ্ন করলাম, এই মামা সম্বোধনটা নামের সঙ্গে কি শোভনীয়? এটা কি কেউ ব্যবহার করে? আপনিই বা কেন করছেন ? তিনি উত্তেজিত অবস্থায় জবাব দিয়ে বললেন, শোনেন আমার নামের সঙ্গে মামা টাইটেলটি বাদ দেয়ার অধিকার কোন সম্পাদকের নেই। আমার টাইটেল বাদ দিয়ে কোন নিউজ ছাপানোর প্রয়োজন নেই। আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম, এটা তো একটা সম্বোধন, নামের টাইটেল হয় কি করে? তিনি একটু শান্ত হয়ে বললেন, শোনেন দেলওয়ার ভাই, আপনি হয়ত জানেন না, আমার সঙ্গে যুদ্ধে ছিল এক ভাগ্নে। সে আমাকে মামা বলে ডাকত। মুক্তিযুদ্ধের সময় সকল সহযোদ্ধার গভীর ভালবাসায় সিক্ত হয়ে আমি এই নাম পেয়েছি। কোন ব্যক্তি স্বার্থের জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেইনি। মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। এই যুদ্ধে আমার পরিবার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমার জন্যই আমার এক ভাইকে হানাদার খান সেনারা ধরে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে দীর্ঘ নয়টি মাস নির্যাতন করে তাকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছে। মামার কথা শোনার পর আমি হয়ে যাই নির্বাক। ৬৬ সালে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা আন্দোলন হতে ৭০ সালের নির্বাচনে অকুতোভয় ছাত্রনেতা হিসেবে সৈয়দ শহীদুল হক মামা রেখেছেন উল্লেখযোগ্য সক্রিয় ভূমিকা। পুরান ঢাকায় নাজিরা বাজারের এক বনেদী পরিবারে জন্ম নেয়া বঙ্গবন্ধুর সহচর ও স্বনামধন্য আইনজীবীর সন্তান এই বীর- মায়ের নিষেধ অমান্য করে বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরে মেলাঘর ইউনিটে যোগ দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসীম বীরত্বগাথা রচনা করেন। তিনি আমাকে জানান, ’৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলনের সময় থেকে তিনি অবাঙালী মুসলিম লীগ ও জামায়াতের বিরুদ্ধে সেøাগান লিখে কাফেলা সঙ্গীত ও নাটক রচনা করে মঞ্চস্থ এবং নিজে তার সুরেলা কণ্ঠে সুর দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় তা দলবেঁধে পরিবেশন করে বেড়াতেন। এ জন্য হয়েছেন রাজনৈতিক নিপীড়ন ও হুলিয়ার শিকার। গান, কবিতা, ছড়া লেখা, সুর দেয়া ও আবৃত্তিতে ছিল তার অসাধারণ দক্ষতা। তার কণ্ঠে তা শুনে আমি অবাক হয়ে ভেবেছি কী এক বিরল প্রতিভার অধিকারীই না তিনি। আরও শুনেছি তার এই বিরল প্রতিভার কারণে তিনি স্বাধীনতার পর কয়েকটি চলচ্চিত্রে সফল অভিনয় করে সিনেমা দর্শকদের মুগ্ধ করেন এবং চলচ্চিত্রে তার ক্যারিয়ার গঠনের ব্যাপক আমন্ত্রণ ও সুযোগ থাকলেও সে পথে যাননি তিনি। ১৯৭২-৭৬ পর্যন্ত তিনি পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। তার স্ত্রীও পড়াশোনা করেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। স্বাধীনতা উত্তরকালে রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘটে যাওয়া বহু অজানা কাহিনীর এক কালের সাক্ষী তিনি। বঙ্গবন্ধু ও শেখ কামালের নিবিড় সান্নিধ্যে কেটেছে তার দীর্ঘ সময়। তিনি একই সঙ্গে সক্রিয় হয়ে পড়েন রাজনীতিতে। বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই তিনি দুর্মর প্রতিবাদে নেমে পড়েন রাজপথে গেরিলা যোদ্ধার মতোই। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, খুনী চক্রকে শায়েস্তা ও অবৈধ শাসক উৎখাত চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন জীবনবাজি রেখে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মোকাবেলা করেছেন ঘাতক অপশক্তির জীবননাশের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার জন্য তিনি আদালতে রিট করেছিলেন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জিয়ার বিরুদ্ধে। এরপরই তার জীবন ও পরিবারের ওপর নেমে আসে দুঃস্বপ্নের মতো ভয়ঙ্কর দুর্যোগের অমানিশা। এরপরই পরিবারের জীবন বাঁচাতে তিনি পাড়ি দেন সুইডেনে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর জীবনের ঝুঁকি ও হুমকিকে অগ্রাহ্য করে তিনি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়েরসহ চালিয়েছেন দুঃসাহসিক আন্দোলন। শেষতক জিয়াউর রহমান তাকে ডেকে নিয়ে মন্ত্রিত্বের পদ অফার করলে তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে থুথু ছুড়ে দিয়েছিলেন তার সামনে। এই খবর একটি পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছে। তার কপি তিনি আমাকে দেখিয়েছেন। ২৮ এপ্রিল ঢাকা থেকে সুইডেন আসার পথে মামা বিমানে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে কাতারের একটি হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হয়। ৩ মে থেকে তাকে রাখা হয় লাইফ সাপোর্টে। হাসপাতালে ব্যয়বহুল চিকিৎসা ও পরিবারের সদস্যদের হোটেলে অবস্থান, এর বিপুল অঙ্কের ব্যয় ভার বহনে হিমশিম খাওয়া দুরবস্থার খবর একাধিকবার দেশের নানা মিডিয়ায় প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে। তাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি এ লেখার মধ্যদিয়ে। লেখক : সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক [email protected]
×