ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

থাই জেনারেলের বিচার

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ২২ জুলাই ২০১৭

থাই জেনারেলের বিচার

বছর দুয়েক আগে থাই-মালয়েশীয় সীমান্ত এলাকার জঙ্গলে গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর বিশ্ববিবেক শিউরে উঠেছিল। এর মাধ্যমে মানব পাচারের নামে মানব হত্যার এক রোমহর্ষক বাস্তবতা বিশ্ববাসীর সামনে পরিষ্কার হয়। গণকবর শনাক্তের পর পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনীর এক জেনারেল, থাই পুলিশ কর্মকর্তা, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও মিয়ানমারের নাগরিকরা ছিলেন। ওই ঘটনার পর মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় পাচার করার এবং আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের বিষয়গুলো সামনে চলে আসে। আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে অচিরেই ওই ঘৃণ্য তৎপরতার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ধীরে ধীরে মানুষ জানতে পারে পাচারকারীরা বিভিন্ন ক্যাম্পে শরণার্থীদের জিম্মি হিসেবে আটকে রেখেছিল স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে। যারা শেষ পর্যন্ত মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হন তাদের চরম পরিণতির শিকার হতে হয়। বাংলাদেশী নাগরিক ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাচারে জড়িত চক্রের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ মামলায় থাইল্যান্ডের আদালত অবশেষে বুধবার রায় ঘোষণা করেছেন। রায়ে দেশটির সেনাবাহিনীর এক জেনারেলসহ অর্ধশতাধিক আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন আদালত। জান্তাশাসিত থাইল্যান্ডে কোন শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তাকে এভাবে আদালতে দোষী সাব্যস্ত করা একেবারেই বিরল ঘটনা। অভিযুক্ত জেনারেল মানাসকে ২৭ বছর কারাদ- দেয়া হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে মানব পাচারের গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট এলাকা থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের নিরাপত্তা দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন এই লে. জেনারেল মানাস। বিচার চলাকালে শুনানিতে বলা হয়, মানব পাচার চক্রের এজেন্টদের কাছ থেকে তিনি ৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাদের পাচারের ভয়াবহ ও লাভজনক ব্যবসায় থাইল্যান্ডের সরকারী কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার বিষয়টি রায়ে উঠে এসেছে। এ মামলার রায়ের প্রতি থাইল্যান্ডের ভেতর ও বাইরে মানুষের বিশেষ আগ্রহ ছিল। বিচার শুরুর পর এ-সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, কিছু সাক্ষীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন ও বিচার চলাকালে আদালতকক্ষে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ বা তথ্য সংগ্রহে বাধা দেয়ার অভিযোগ ওঠে। এমনকি প্রাথমিকভাবে মামলার তদন্তে নেতৃত্বদানকারী এক মেজর জেনারেল জীবননাশের হুমকির মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশ থেকে বিদেশগামী ৫১ শতাংশ অভিবাসী কোন না কোন পর্যায়ে প্রতারণার শিকার হন। এর মধ্যে ১৯ শতাংশ বিদেশে যাওয়ার টাকার একাংশ বা পুরোটা দেয়ার পরও বিদেশ যেতে পারেন না। আর ৩২ শতাংশ প্রতারণার শিকার হন গন্তব্যে পৌঁছার পর বা বিদেশে থাকাকালে। থাই জেনারেলের বিরুদ্ধে মানব পাচারে সংশ্লিষ্ট থাকার বিচারের রায় থেকে কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে। প্রথমত পাপ বাপকেও ছাড়ে না। এ থেকে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের শিক্ষা নেয়ার আছে। দ্বিতীয়ত অন্ন ও আশ্রয়সন্ধানী হতভাগ্য মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যেতে বাধ্য হয়। কর্মসন্ধানে তার এই অভিবাসন-ইচ্ছা পূরণে বৈধ পথ প্রদর্শন তাই জরুরী। এক্ষেত্রে মানুষ যেন প্রতারণার শিকার না হয়, মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে না পড়ে সেটি দেখার দায়িত্ব কল্যাণকামী রাষ্ট্রের। মানব কল্যাণে অবশ্যই ব্রতী হতে হবে রাষ্ট্রনায়কদের।
×