ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষণ কমলেও বেড়েছে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ধর্ষণ

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২২ জুলাই ২০১৭

ধর্ষণ কমলেও বেড়েছে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ধর্ষণ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মানুষের ধারণা, দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিসংখ্যান বলছে, ধর্ষণের ঘটনা বাড়েনি। বরং উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কারণ আগে ধর্ষণের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলার শতকরা ৮৫ ভাগই ছিল মিথ্যা। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই মামলাগুলো দায়ের করা হতো। হালে আর সে সুযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষেই ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঘটনায় মামলা হচ্ছে। মিথ্যা মামলা দায়েরের সুযোগ না থাকায়, স্বাভাবিক কারণেই ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়েরের সংখ্যা কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে অনেক ধর্ষিতা লোকলজ্জার কারণে মুখ খুলতেন না। এখন সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ধর্ষিতা বা যৌন নিপীড়িনের শিকার হওয়ারা আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন। তারা থানা বা আদালতে গিয়ে মামলা দায়ের করেছেন। ধর্ষণ মামলা নিয়ে গোটা জাতি যখন সোচ্চার তখন, স্বাভাবিক কারণেই এসব মামলার সঠিক তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত রিপোর্টের প্রেক্ষিতে আদালতও যুগান্তকারী রায় দিচ্ছেন। ধর্ষকদের প্রকৃত সাজা হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশে দিন দিন ধর্ষণের ঘটনা কমে আসতে বাধ্য। চলতি বছর রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে জন্ম দিনের দাওয়াত দিয়ে বান্ধবীকে ধর্র্ষণের ঘটনা সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। মামলার আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের গ্রেফতার নিয়ে নানা গুঞ্জন ওঠে। কিন্তু সব গুঞ্জনকে পেছনে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসামিদের গ্রেফতার করে। আসামিদের অনেকেই আদালতে ধর্ষণের দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। এছাড়া জন্ম দিনের দাওয়াত দিয়ে বনানীর ন্যাম ভবনের এক ফ্ল্যাটে বান্ধবীকে ধর্ষণের ঘটনায় এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর ছেলে ইভান গ্রেফতার র‌্যাবের হাতে। এছাড়াও রাজধানীতে সৎমেয়েকে আট বছর ধরে ধর্ষণের অভিযোগে ওই মেয়ের দায়ের করা মামলার আসামি একটি বেসরকারী জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেলের শব্দ প্রকৌশলী আরমানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে আরমান ধর্ষণের কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়। ধর্ষণ মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ধর্ষণ মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। প্রতিটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রত্যেক ইউনিটকে এ ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোন নির্যাতিত নারী মামলা করতে চাইলে, প্রাথমিক তদন্ত করে ওই নারী বা অভিযোগকারীর মামলা গ্রহণের জন্য দেশের প্রতিটি থানাকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক। এক্ষেত্রে থানা বা পুলিশের কোন ইউনিট গাফিলতি করলে তাদের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বনানীর রেইনট্রি হোটেলের ঘটনা। ওই ঘটনায় অভিযোগ নিতে দেরি করায় বনানী থানার প্রভাবশালী ওসিসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ওসির পিতা ক্ষমতাসীন দলের একটি বিশেষ জেলার আওয়ামী লীগের পদধারী প্রভাবশালী নেতা। তারপরও ওসি ফরমান আলীর বেলায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে কোন দেরি করেনি কর্তৃপক্ষ। তদন্তকারীরা আরও জানান, হালের ধর্ষণের কৌশল পাল্টেছে। এসব ধর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনার সূত্রপাত ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে। মোবাইল ফোনে বা ফেসবুকের মাধ্যমে প্রেমের সূত্রপাত হয়। এরপর ঘনিষ্ঠতা বাড়তে বাড়তে তা ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে। ছেলে মেয়ের ইচ্ছেয় সেসব অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘটনা ঘটে, তা কোন দিনই প্রকাশ পায় না। তবে কোন কোন সময় ছেলে বা মেয়ে তাদের চাহিদা মোতাবেক সহযোগিতা না পেলে থানায় বা আদালতে অভিযোগ করেন। অনেক মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এমন তথ্য মিলেছে। তবে প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে অনেক সময়ই মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ধর্ষণের ঘটনাগুলো ঘটে। শুধু ধর্ষণ নয়, কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্ষক অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণের ভিডিও করে রাখে। এসব ভিডিও দেখিয়ে মেয়েকে জিম্মি করে পরবর্তীতে চাহিদা মোতাবেক টাকা পয়সা বা ধর্ষণের সুযোগ নেয়। এমন ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এক পর্যায়ে মেয়ে বা ছেলে বিষয়টি বুঝতে পেরে থানায় বা আদালতে অভিযোগ করেন। ঢাকায় বেশ কিছু ধর্ষণকারী চক্র রয়েছে। যাদের অধিকাংশ ধনাঢ্য পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান। তারা ইয়াবার মতো মারাত্মক মাদকে আসক্ত। তারা দামি গাড়ি হাঁকিয়ে বাড়তি টাকা পয়সা খরচ করে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। এরপর সুযোগ বুঝে মেয়েদের ধর্ষণ করে। এমন ঘটনার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এসব চক্র আবার ধর্ষণের সময় তার ভিডিও ফুটেজ ধারণ করে রাখে। এসব ফুটেজ দেখিয়ে ওইসব মেয়েদের কাছ থেকে পরবর্তীতে চাহিদামত সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। এরা গ্রুপ র‌্যাপে বিশ্বাসী। তারা মূলত বিকৃত যৌনাচারে বিশ্বাসী মানসিক রোগী। তারা দল বেঁধে বন্ধুদের নিয়ে এক বা একাধিক বান্ধবী বা মেয়েদের ধর্ষণ করতে পছন্দ করে। এছাড়া কারও বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সুযোগ বুঝে কাউকে ধর্ষণের ঘটনার কাহিনী বহু পুরনো। হালে অনেক ধর্ষণকারী মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করে তাদের বাসায় নানা ধরনের খাবার নিয়ে বেড়াতে যায়। ওইসব খাবারে নেশা বা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে কৌশলে মেয়েকে খাইয়ে দেয়। এরপর দলবেঁধে ধর্ষণ করে। গত ১৮ জুন রাতে রাজধানীর কদমতলী থানাধীন পূর্ব জুরাইন এলাকায় জামাল ও রাজীব নামের দুই যুবক তাদের পূর্ব পরিচিত পারুল বেগম নামে এক নারীর বাসায় যায় ফল, হালিম আর কোমল পানীয় নিয়ে। পানীয় আর হালিমে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে রাখে। তা কৌশলে পারুলকে খাইয়ে দিলে সে অচেতন হয়ে যায়। এরপর তারা পালাক্রমে পারুলকে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে বাসায় থাকা টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে যায়। গত ১০ জুলাই কদমতলী থানাধীন পূর্ব জুরাইন শিশু কবরস্থানের একটি বাড়িতে শামীম, সাগর ও জাকির নামে তিন বন্ধু ফরিদা বেগম নামের এক নারীর বাসায় যায়। ওই নারীর সঙ্গে তিন বন্ধু একটি গার্মেন্টসে চাকরি করত। বাসায় একা পেয়ে তিনজন মিলে ফরিদা বেগমকে পালাক্রমে ধর্ষণের পর হত্যা করে। তদন্তকারীরা বলছেন, আগের চেয়ে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়েরের সংখ্যা কমে গেছে। তবে ধর্ষণকারীরা নানা কৌশলে ধর্ষণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। বাস বা অন্যকোন যানবাহনে বা রাস্তায় নারীদের একা পেয়ে ধর্ষণ এবং বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের ঘটনার কৌশল বহু পুরনো। তবে আগের চেয়ে এখন অনেকেই এসব কৌশল সম্পর্কে অবহিত। ফলে এসব ধরনের ধর্ষণের ঘটনা কমে এসেছে। তবে খাবারের সঙ্গে নেশাদ্রব্য মিশিয়ে বা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যা সম্প্রতি বেশ আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। তদন্তকারীরা জানান, আগে প্রতিদিন সারাদেশের থানাগুলোতে নারী ও শিশু নির্যাতন, বিশেষ করে ধর্ষণের অভিযোগে কয়েকশ’ মামলা হতো। বর্তমানে সেই পরিমাণ মামলা হচ্ছে না। কারণ আগে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে যেসব মামলা হতো তার শতকরা ৮৫ ভাগই মিথ্যা ছিল বলে তদন্তে ধরা পড়েছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই এই আইনে মামলাগুলো দায়ের করা হতো। বর্তমানে প্রকৃতপক্ষেই ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হচ্ছে। যে কারণে স্বাভাবিকভাবেই ধর্ষণের মামলা দায়েরের পরিমাণ আগের যেকোন সময়ের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক কমে গেছে। এ ব্যাপারে পুুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে সরকার এবং তাদের তরফ থেকে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। পুলিশের কোন সদস্য বা কোন ইউনিট এসব বিষয়ে মামলা বা অভিযোগ বা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিলে বা নিতে না চাইলে ওইসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনার শিকার হওয়াদের দ্রুত থানা পুলিশ বা আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। কারণ এতে করে ঘটনার আলামত পাওয়া এবং তদন্ত করা সহজ হয়। অপরাধীরা শাস্তি পায়। শুধু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে নয়, বহু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আছে। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অনেক মামলার তদন্ত চলছে। অনেক মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের চাকরিচ্যুতিসহ নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে কোন প্রকার আপোস না করার কড়া নির্দেশ রয়েছে। যারা আপোস করবেন, তাদের কপালে দুঃখ আছে। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, এটি সামাজিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের অপরাধ। এজন্য উচিত ব্যক্তিকে সচেতন থাকা। পাশাপাশি ছেলে মেয়েদের প্রতি অভিভাবকদের নজর রাখা। তার ছেলে মেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে এ এসব একটু নজরে রাখলেই অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
×