ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মালয়েশিয়া থেকে আদিলুরকে ফেরত পাঠানোর নেপথ্যে-

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২২ জুলাই ২০১৭

মালয়েশিয়া থেকে আদিলুরকে ফেরত পাঠানোর নেপথ্যে-

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ডানপন্থী বিতর্কিত মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে ‘সন্দেহজনক ব্যক্তি’ হিসেবেই আটক করেছিল মালয়েশিয়ান পুলিশ। আটকের ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের একটি বিশেষ গোষ্ঠীর বদৌলতে আদিলুর রহমান খানকে ‘বিখ্যাত মানবাধিকার নেতা’ বানানোর চেষ্টা করলেও মালয়েশিয়া বিমানবন্দরে তার কর্মকা- ও তার অতীত তথ্যের কারণেই আটক করা হয়েছিল। ইতোমধ্যেই বিমানবন্দর থেকে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তবে ডানপন্থী মানবাধিকার নেতা হিসেবে তৎপর কেউ কেউ এখনও ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারকে গুলিয়ে ফেলার পাঁয়তারা করছেন। বিতর্কিত মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান একটি সম্মেলেনে যোগ দিতে মালয়েশিয়ায় গিয়ে বিমানবন্দরে আটক হয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার ভোরে কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটক করে। এই ঘটনা গণমাধ্যমকে জানান অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান। এলানের দাবি, তিনি মানবাধিকার বিষয়ক একটি সম্মেলনে যোগ দিতে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে তিনি কুয়ালালামপুরে পৌঁছান। কিন্তু সেখানকার ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে দেয়নি। মালয়েশিয়াকিনি নামের একটি অনলাইনের খবরে বলা হয়েছিল, আদিলুর মৃত্যুদ- বিলোপ সংক্রান্ত একটি সম্মেলনে যোগ দিতে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন। মানবাধিকার সংগঠন ফোরাম এশিয়া বলেছিল, সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান আদিলুর রহমান খানকে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টায় আটক করে অভিবাসন পুলিশ। তবে অধিকারের পরিচালক এলান জানান, আটক নয়, আদিলুর রহমানকে সেখানে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এ তথ্য জানার পর সেখানকার মানবাধিকার আইনজীবীরা সেখানে যান। কিন্তু তার আটকের পেছনে কারণ কী? মালয়েশিয়ান পুলিশ কি তাকে অযথাই হয়রানির জন্য আটক করেছিল? মালয়েশিয়ান পুলিশ ও সরকারের বিভিন্ন তথ্য বলছে, উগ্র ডানপন্থীরা তাকে ‘বিখ্যাত মানবাধিকার নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলেও তার অতীতের কর্মকা-ের সকল তথ্যই আছে মালয়েশিয়ান পুলিশের কাছে। এ কারণে অন্য অনেক মানবাধিকার নেতাদের ওই সম্মেলনে যোগ দিতে ওই দেশে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হলেও বের করে দেয়া হয় আদিলুর রহমানকে। আটকের পর আদিলুর রহমান যখন পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলেন তখন অভিবাসন অফিসার তার নামটি ডাটাবেসে লিখেছিলেন এবং আদিলকে মালয়েশিয়ায় লেখা দুটি শব্দ দিয়ে একটি ছোট চিরকুট দিয়েছিলেন। পরে মালয়েশিয়ার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধিরা তাকে বলেছিলেন ‘সন্দেহভাজন ব্যক্তি’। এরপর ইমিগ্রেশন অফিসার তাকে তার পাসপোর্টটি ফেরত দিয়ে তাকে যাচাইয়ের জন্য কাছের একটি রুমে অফিসারকে তার পাসপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ দেন। দ্বিতীয় অফিসারকে তার পাসপোর্ট জমা দেয়ার সময় আদিলকে কোন ফোন করার জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। পুলিশ তার কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করে তখন। সাড়ে ৭টার দিকে অন্য অভিবাসন পুলিশ অফিসারকে অনুসরণ করতে বলেছিলেন ওই অফিসার। এ সময় আদিল তার ফোন থেকে মালয়েশিয়ার একটি মানবাধিকার সংগঠনের সমন্বয়ককে ই-মেইল করেন। একটি বাক্যে তাকে বলেছিলেন যে, তিনি বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যেতে পারছেন না, সম্ভবত তাকে আটক করা হয়েছে। দুপুরের দিকে এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে আদিলকে জিজ্ঞেস করলেন যে তিনি এই আটকাদেশের কথা বাইরে কাউকে জানিয়েছেন কিনা? আদিলুর রহমান তাকে বলেন, তিনি তার বন্ধুকে জানিয়েছেন, তার সেল ফোনটি বের করে নেয়ার আগে। অফিসার তখন কিছুটা ধমক দিয়ে বলেন, কেন আপনি এটা করেছেন? ইতোমধ্যেই আদিলুর রহমান খানকে মালয়েশিয়ার অভিবাসন পুলিশ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে মালেশিয়ান এয়ারলাইন্সের এমএইচ-১১২ নম্বর ফ্লাইটে আদিলুর রহমান বিমানবন্দরে আসেন। স্বাভাবিক নিয়মে ইমিগ্রেশন শেষে তিনি বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। কে এই আদিলুর রহমান? কেন তাকে নিয়ে কেবল একটি বিশেষ গোষ্ঠীই সক্রিয়? কেন তার আটকের পর হেফাজত, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ উগ্রবাদী দলগুলোর প্রতিবাদ জানাতে সময় লাগেনি? ২০১৩ সালের ৫ মে রাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ নিয়ে তথ্য বিকৃতির অভিযোগে তথ্য প্রযুক্তি আইনের মামলায় দেশে আদিলুরের বিচার চলছে। হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের সরিয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সে সময় যে অভিযান চালায়, তাতে ৬১ জন নিহত হয় বলে অধিকারের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল। অধিকারের কাছে ‘নিহতদের’ নাম পরিচয় চেয়ে সরকারের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হলেও অধিকার তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়। মতিঝিলে হেফাজতবিরোধী অভিযান নিয়ে তথ্য বিকৃতি, অসত্য তথ্য উপস্থাপন, ফটোশপের মাধ্যমে ছবি বিকৃত করে অধিকারের প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা এবং জীবিত ব্যক্তিকে মৃত দেখানোর মতো অভিযোগ ওঠে মামলার আসামি আদিলুর ও তার পরিচালক এলানের বিরুদ্ধে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল আদিলুর ওই মামলায় গ্রেফতার হয়ে বেশ কিছুদিন কারাগারে থাকলেও পরে সুপ্রীমকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পান। ৫ মে হেফাজত-জামায়াতের ভয়াবহ তা-রের পর চালানো অভিযান নিয়ে দেশে-বিদেশে দফায় দফায় হত্যার কাল্পনিক তথ্য ছড়িয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে মানবাধিকার সংগঠনের নামে সক্রিয় গ্রুপ ‘অধিকার’। হত্যার কোন প্রমাণ না থাকলেও একের পর এক মিথ্যা আর বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছিল কথিত এ মানবাধিকার সংগঠনটি। তালিকা প্রকাশ করাত দূরের কথা, তাদের দাবি করা নিহত ৬১ জনের তালিকা দেশী-বিদেশী পাঁচটি মানবাধিকার সংগঠনকে দিয়েছে বলে দাবি করলেও তাতেও ধরা পড়েছে অধিকারের মিথ্যাচার। তালিকা পাঠানো পাঁচ সংগঠনের অন্যতম আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়ে দিয়েছিল, তারা অধিকারের এ ধরনের কোন তালিকাই পায়নি। অধিকার নানা কৌশলে দাবি করলেও শেষ পর্যন্ত এ ধরনের তালিকা পাওয়ার কথা বলেনি অন্য চার সংগঠনও। ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর সমাবেশ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন’ শীর্ষক অধিকারের প্রতিবেদনে ৫ মে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সময় ৬১ জন নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এদিকে অধিকার তালিকার নামে উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে ফায়দা হাসিলের সুযোগ করে দিলেও নিহতদের কথিত তালিকাটি প্রকাশের পর চুপসে গেছে সংগঠনটি। পুলিশের তদন্তে ওই তালিকায় নাম থাকা ৬১ জনের মধ্যে ৩৫ জনেরই নাম পাওয়া গেছে ভুয়া। বাকিরা মারা গেছে ৫ মে দিনেরবেলায় এবং পরদিন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ও হাটহাজারী সংঘর্ষে। ওই তালিকায় নাম থাকা তিনজন জীবিত বলেও প্রমাণ মেলে। অধিকার দাবি করেছিল, তারা সরেজমিন তদন্ত করে ওই রাতে এই ৬১ জন নিহত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে। তবে হেফাজতের নেতারা ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন, ওইরকম একটি তালিকা তারা অধিকারকে দিয়েছেন। ফলে বেড়িয়ে আসে অধিকারের কথিত ‘সরেজমিন’ তদন্তের আসল চেহারা।
×