ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এরশাদের ভারত সফর রাজনীতিতে চলছে নানা গুঞ্জন

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২২ জুলাই ২০১৭

এরশাদের ভারত সফর রাজনীতিতে চলছে নানা গুঞ্জন

রাজন ভট্টাচার্য ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনীতি যখন সরগরম ঠিক তখন ভুটান সফর শেষ করে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই ভারত সফরে গেলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নির্বাচনের ঠিক আগে আগে তার ভারত সফর নিয়ে রাজনীতিতে চলছে নানা গুঞ্জন ও আলোচনা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি। দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও প্রায় দুই মাসের সফরে এখন লন্ডনে। পাশাপাশি বিরোধী দলের প্রধান এরশাদও ভারতে অবস্থান করছেন। দেশের রাজনীতিতে লন্ডন ও ভারতের গুরুত্ব যথেষ্ট। এইদিন বিবেচনায় দুই নেতার দুই দেশ সফর বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখছেন তারা। জাতীয় পার্টির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয়েছে এরশাদের ভারত সফর নিয়ে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে নেতারা জানিয়েছেন, ভারত সরকারের ওপর ভরসা করেই ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান এরশাদ। আর টিকে থাকার রূপরেখা চূড়ান্ত করতেই মূলত তার এই সফর। এবারের এরশাদের ভারত সফর নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যেও ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। দেশে ফেরার পর এরশাদকে বিমানবন্দরে গণসংবর্ধনা দেয়ারও প্রস্তুতি শুরু করেছে জাতীয় পার্টি। এরমধ্যে অন্তত তিনটি প্রস্তুতি সভার শেষ করেছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিগুলো। রওশন এরশাদও দলের এমপি, প্রেসিডিয়ামের সদস্য থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রশ্ন হলো কি বার্তা নিয়ে আসছেন এরশাদ। যে কারণে এত আয়োজন। নেতাকর্মীদের মধ্যে এত প্রাণচাঞ্চল্য। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন হয়েছিল ৯০ দশকে। এরপর রাজনীতিতে খুব একটা সুসময় তার জন্য আসেনি। জেল খাটতে হয়েছে বারবার। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোট গঠনের পর এরশাদের রাজনৈতিক উত্থান ফের শুরু হয়। পাঁচ বছর অনেকটা নিরাপদেই রাজনীতিতে টিকে ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে না আসায় ৪০ সাংসদ নিয়ে বিরোধী দলে এখন জাতীয় পার্টি। সরকারে জাপার এখন তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আছেন। মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে আছেন এরশাদ। গেল আট বছরে তার সাংঠনিক দুর্বলতা কমলেও ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে নিজেকে নিরাপদে রেখেছেন। তাই এই সময় ভারতের পরামর্শ মেনে চলার যৌক্তিকতা তো রয়েছেই। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, কোন বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দলকে যুক্ত না করলে ভোটের রাজনীতিতে জাপার অবস্থান খুবই দুর্বল। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও জেলা পরিষদ, মেয়র থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপ নির্বাচনের জাপার ভোট বিপর্যয়ই চরম সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়টি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে। তাই এরশাদও মনে করে টিকে থাকতে হলে শক্তিশালী দল ছাড়া উপায় নেই। তাহলে জোয়াড়ে হয়ত জাপা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকবে। এছাড়া একক নির্বাচন করলে ফলাফল যে ভয়াবহ বিপর্যয় হবে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ জাপার দুর্গ হিসেবে পরিচিত রংপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোর সব পর্যায়ের নির্বাচিত বেশিরভাগ নেতাই এখন অন্য দলের। তাই ভবিষ্যত রাজনীতিতেও নিজেকে নিরাপদ রাখতে চান তিনি। যে দল ক্ষমতায় আসবে তাদের সঙ্গেই হবে জাপার গাটছড়া। তাই আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন অনেকটা আটঘাট বেঁধেই। ইতোমধ্যে ৫৮ দলের সর্ববৃহত রাজনৈতিক জোট গঠন করেছেন তিনি। ৩০০ আসনে নিজ দলের প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত। আসন প্রতি তিনজন করে প্রার্থী বাছাই কাজ শেষ হয়েছে। দলটির নেতারা জানিয়েছেন, যদি বিএনপি নির্বাচনে আসে তাহলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ফের মহাজোট করে নির্বাচন করবে জাপা। অন্যথায় বিরোধী দলে যাবে জাতীয় পার্টি। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে আসন ভাগাভাগি হতে পারে। মহাজোটে নির্বাচন করতে হলে এরশাদের চাই ১০০ আসন। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হাতে ১০০ জনের প্রার্থী তালিকা দেয়া হয়েছে জাপার পক্ষ থেকে। এরমধ্যে ৭০ জাপার প্রার্থী। বাকি ৩০ জন এরশাদের নেতৃত্বাধীন শরিক দলের নেতা। জাপা নেতারা জানিয়েছেন, ভারত চায় জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের পাশে থাক। কারণ জামায়াত, যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ ইস্যুতে বিএনপির প্রতি ভারতের রাজনীতি খুব একটা ইতিবাচক নয়। ভারত সরকার মনে করে, বাংলাদেশের ভূখ- সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হলে সবচেয়ে বেশি বিপদ তাদের। তাই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যাদের শক্ত অবস্থান তারা ক্ষমতায় টিকে থাকা মানেই ভারত নিজেদের অনেকটা নিরাপদ মনে করে। জাপা সূত্র বলছে, আগামী ২৩ জুলাই দিল্লী সফর শেষে দেশে ফিরবেন এরশাদ। বুধবার তিনি ভারতে যান। জানা গেছে, ভারত সরকারের আমন্ত্রণেই এরশাদ দিল্লী গেছেন। সফরকালে এরশাদ ভারতের শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপির সিনিয়র নেতাদের পাশাপাশি কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। বৃহস্পতিবার বিজেপির কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য তার এই সফরকে খুবই তাৎপর্যময় বলে মনে করছেন পার্টির নেতাকর্মীরা। ফেরার দিন তাকে বিমানবন্দরে দেয়া হবে গণসংবর্ধনা। প্রায় ৫০ হাজার মানুষের টার্গেট চূড়ান্ত করা হয়েছে এ আয়োজনে। সফরে যাওয়ার দিন পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, ভারতে তাদের সঙ্গে অনেকের দেখা সাক্ষাত হবে, শুভেচ্ছা ও মতবিনিময় হবে। বিস্তারিত তিনি পরে জানাতে পারবেন। জানতে চাইলে জাতীয় পার্টি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি বলেন, পার্টির চেয়ারম্যানের এ সফরকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন তারা। সময় এলেই সবকিছু পরিষ্কার হবে। পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুল ইসলাম মিলন বলেন, আশাকরি এবারের সফর সফল হবে। এই সফরকে কেন্দ্র দলে দলের নেতাকর্মীরা অনেকটাই উজ্জিবীত বলেন জানান তিনি। দলটির শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, দুটি বিষয়ে এরশাদের সঙ্গে ভারতের ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বৈঠক হতে পারে। একটি হলো বিএনপি নির্বাচনে না এলে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে তারা দেখতে চান। অপরটি হলো, বৃহৎ রাজনৈতিক জোট করায় ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নের কথা বিজেপি নেতাদের কাছে তুলে ধরতে পারেন এরশাদ। তবে আওয়ামী লীগের পাশে থেকে আরও কিছু আসন নিয়ে বিরোধী দলে থাকার বিষয়টি শেষমেশ চূড়ান্ত হতে পারে। দলটির নেতারা বলছেন, ভারত সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের বৈরিতার কারণেই এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছিল। এজন্য রাজনীতিতে অনেক কঠিন মূল্য দিতে হয়েছে তাকে। তাই জীবনের পড়ন্ত বেলায় ভারতের কথা মেনেই রাজনীতি চালিয়ে যাবেন এমন ধারণা অনেক নেতার। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ও নিরাপদ রাজনীতি। এ দুটোর পক্ষেই এখন এরশাদের অবস্থান।
×