ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মন্ত্রী-এমপি প্রভাবশালী নন, ‘ক্লিন ইমেজ’কেই প্রাধান্য দিচ্ছে আওয়ামী লীগ

সেরা প্রার্থীর হাতেই এবার নৌকা প্রতীক তুলে দেবে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২২ জুলাই ২০১৭

সেরা প্রার্থীর হাতেই এবার নৌকা প্রতীক তুলে দেবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ এবার সবচেয়ে সেরা প্রার্থীদের হাতে নৌকার টিকেট তুলে দেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে একাধিক গোপন জরিপের মাধ্যমে প্রত্যেক আসনে ‘গুড ইমেজ’র প্রার্থী বাছাই করছে দলটি। আসনভিত্তিক মনোনয়ন একজন পেলেও নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে এবার প্রতি আসনে এমন তিন প্রার্থীর নাম বাছাই করা হচ্ছে। নির্বাচনের সময়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর অবস্থান যাচাই করেই বাছাইকৃত তিন প্রার্থীর মধ্যে থেকে একজনের হাতে দলীয় প্রতীক নৌকার টিকেট তুলে দেবেন দলটির হাইকমান্ড। দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনকে অনেক চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছে আওয়ামী লীগ। মুখে যত কথাই বলুক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই নির্বাচনে আসবে প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। তাই আগামী নির্বাচন অনেকটাই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে ধরে নিয়েই প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সতর্কতামূলক অবস্থান নিয়েছে দলটির নীতিনির্ধারকরা। সেক্ষেত্রে দলের যতই বড় বাঘা বাঘা নেতা-এমপি বা মন্ত্রীই হোক না কেন, নির্বাচনী এলাকায় জনপ্রিয়তা ও ইমেজ হারানো কাউকেই দলীয় মনোনয়ন দেয়ার ঝুঁকি নেবেন না তাঁরা। তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসতে দফায় দফায় গোপন জরিপের মাধ্যমে জনপ্রিয় ও ক্লিন ইমেজের প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ জোরেশোরেই চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। দলটির মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক সদস্য আগামী নির্বাচন সামনে রেখে প্রত্যেক নির্বাচনী আসনে দুই/তিন সেট প্রার্থী বাছাইয়ের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। এর মধ্যে অন্যতম হলো- আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে কোথাও প্রার্থীর ইমেজ আবার কোথাও দলের ইমেজকে গুরুত্ব দেয়া হবে। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমলে নেয়া হচ্ছে- দলের নেতাকর্মীদের কাছে ‘গুড ইমেজ’ আছে কিনা, রাজনীতিক হিসেবে এলাকায় কতটা পরিচিত, সংগঠক হিসেবে কতটা দক্ষ, ভোটার ও স্থানীয় দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক কতটা নিবিড়, দলের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা কেমন। এসব বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দলীয় সূত্র জানায়, প্রত্যেক আসনে বাছাই করা এসব প্রার্থীর মধ্য থেকেই আগামী নির্বাচনে নৌকার টিকেট দেবেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এর সঙ্গে তৃণমূল থেকে পাঠানো তালিকাও দেখা হবে। তৃণমূলের পাঠানো নামের সঙ্গে গোপন জরিপের মাধ্যমে বাছাই করা প্রার্থীর নাম আছে কিনা, তাও খতিয়ে দেখবেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর চূড়ান্ত মনোনয়ন দেবেন তিনি। সূত্রটি আরও জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের একাধিক গ্রুপকে তিনশ’ আসনে গোপন জরিপে নিয়োগ করেছেন, একই সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমেও সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে। এমন একাধিক গোপন জরিপের মাধ্যমে উঠে আসা ‘কমন’ নামগুলো চূড়ান্ত বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দলটির মনোনয়ন বোর্ডের দু’জন সদস্য জনকণ্ঠকে জানান, প্রার্থী বাছাই করার কাজ চলছে অনেক আগ থেকেই। বিভিন্ন সংস্থাসহ একাধিক মাধ্যমে এই বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়ার আগে বিভিন্নভাবে যাচাই-বাছাই করেন। এবার আগে থেকেই এ যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু করেছেন তিনি। আমরা মনে করি, এবার সবচেয়ে সেরা প্রার্থীদের হাতেই নৌকার টিকে তুলে দেবেন দলীয় সভাপতি। গ্রহণযোগ্যরাই পাবেন আগামী নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন। তাঁরা আরও জানান, এবার তিন ধাপে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হবে। আওয়ামী লীগের দুর্গ বলে খ্যাত এবং ব্যক্তি ইমেজের কারণে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকা প্রায় একশ’ আসন চিহ্নিত করেছে আওয়ামী লীগ। এসব আসনে নির্বাচনের এক বছর আগেই দলীয় চূড়ান্ত প্রার্থীদের দলের হাইকমান্ড থেকে গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে নির্বাচনী মাঠে নামানো হবে। যাতে করে এসব প্রার্থীরা নিজ নিজ আসনে থাকা দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দলীয় কর্মী বাহিনীকে নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট চাইতে পারেন। আর এসব আসনে দলীয় প্রার্থীদের দলেরই কোন কোন নেতা বিরোধিতা করতে পারেন, নিশ্চিত বিজয়কে অনিশ্চিত করতে পারেন- তাদেরও একটি পৃথক তালিকা তৈরি করে আগে থেকেই সেসব নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন দলটির হাইকমান্ড। দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও দলের বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেন, সামনে নির্বাচন। ৩শ’ আসনে মনোনয়ন দিতে হবে। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে যারা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, ‘উইনেবল ক্যান্ডিডেট’ হবেন না, তারা মনোনয়ন পাবেন না। যারা উইনেবল ক্যান্ডিডেট হবেন, তারাই মনোনয়ন পাবেন। যারা নেতার জন্য যোগ্য, যাদের জনপ্রিয়তা আছে, তারাই মনোনয়ন পাবেন। কোনভাবেই অগ্রহণযোগ্যদের এবার মনোনয়ন দেয়া হবে না। একই সঙ্গে তিনি দলের যেসব এমপি-মন্ত্রীরা এলাকায় কিছুটা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তাদের দ্রুত নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে নিজের হারানো ইমেজ পুনরুদ্ধারের ব্যাপারেও সতর্ক করে দিয়েছেন। গোপন জরিপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বোর্ডের একাধিক সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে অধিকাংশ নির্বাচনী আসনেই দলীয় কোন্দল ও অভ্যন্তরীণ গৃহবিবাদ। একশ’রও বেশি আসনেই আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ এখন আওয়ামী লীগই। সরকারের গত আট বছরে ব্যাপক উন্নয়ন-সফলতায় সারাদেশেই নৌকার পক্ষে জনসমর্থন বৃদ্ধি পেলেও এই অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর প্রার্থীর ছড়াছড়িই আওয়ামী লীগের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের দুর্গ বলে খ্যাত অনেক আসনেও শুধু দলীয় কোন্দল-বিবাদের কারণে নিশ্চিত আসন হাতছাড়া হবার যোগার হয়েছে। সারাদেশের এমন বাস্তবতার নিরিখে নির্বাচনের দেড় বছর বাকি থাকতেই দলীয় কোন্দল মেটাতে উদ্যোগী হয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রতি সপ্তাহেই বিভিন্ন জেলায় গিয়ে বর্ধিত ও কর্মিসভার মাধ্যমে দলীয় কোন্দল, দ্বন্দ্ব মিটিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন। এছাড়া দলটির যুগ্ম সম্পাদক ও বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরা কোন্দল-দ্বন্দ্বে জড়িত থাকা জেলার নেতাদের ঢাকায় তলব করে তা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন। এমন বৈঠকে আসা প্রায় ১২টি জেলার নেতারা নিজেদের মধ্যে সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের। জানা গেছে, পুরো বছর ধরেই দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা দলকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠনকে চাঙ্গা ও শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবেন। এ প্রসঙ্গে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ জনকণ্ঠকে বলেন, প্রার্থী যাচাই-বাছাই আওয়ামী লীগের রুটিন কাজ। তাই এ কাজগুলো নির্বাচন পর্যন্ত চলবে। আগামীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে বলে আমরা আশা করি। তাই প্রস্তুতিও পরিকল্পনা মাফিক নেয়া হচ্ছে। আর এলাকায় যার গ্রহণযোগ্য রয়েছে, ভোটার ও দলীয় কর্মী-সমর্থকদের কাছে জনপ্রিয়, যার বিরুদ্ধে কোন অনৈতিক কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগ নেই, আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে তাঁরাই অগ্রাধিকার পাবে।
×