ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অরিত্র ধীরোদাত্ত

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২১ জুলাই ২০১৭

অরিত্র ধীরোদাত্ত

বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবেরের ষাট বছর পদার্পণ উপলক্ষে ‘অরিত্র ধীরোদাত্ত’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। প্রকাশকাল ২৬ মে ২০১৭। বইটি বের করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিঃ। প্রচ্ছদ এঁকেছেন মাসুক হেলাল। সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখকদের প্রবন্ধ নিয়ে সংকলিত গ্রন্থটি মঈনুল আহসান সাবেরের সাহিত্যিক চেতনা, তাঁর আদর্শিক বোধ সর্বোপরি সমাজ-সংসারের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের এক প্রচ্ছন্ন দলিল। কবি আহসান হাবিবের সুযোগ্য পুত্র মঈনুল হাসান জীবনভর লালিত হন এক সমৃদ্ধ সাহিত্যিক বলয়ে। তাঁর সাক্ষাতকার থেকে জানা যায় বাবা কবি হওয়ার কারণে কবিতার বইয়ের সংখ্যা যতই বেশি হোক না কেন পারিবারিক আলয়ে ছোটবেরা থেকে তাঁদের গ্রন্থ পরিচয়ের হাতেখড়ি প্রবন্ধ কিংবা গল্প দিয়েই। যা কবি পিতার ইচ্ছেনুসারেই। ফলে কথাসাহিত্যিক সাবের সাহিত্যের এই আঙিনায় তাঁর সৃজনশীলতাকে নিবেদন করেছেন। পরিবারের ছোট্ট গ-ি পেরিয়ে তাঁর খ্যাতি যখন বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করে তখন থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন সাহিত্যের এক বিশিষ্ট কর্ণধার। গ্রন্থটিতে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন অনেকেই। তার মধ্যে আহমদ রফিক, কবীর চৌধুরী এবং সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতো বিশিষ্টজনরাও আছেন। মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে যে অনবদ্য মিলন যজ্ঞ তা যেমন মঈনুল আহসানকে তাড়িত করেছে। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর সৃষ্টিশীল দ্যোতনা। মানুষ আর প্রকৃতির নিগৃঢ় বন্ধনে কিভাবে সাবেরের সাহিত্যিক চেতনা আলোড়িত হয়েছে তার একটা স্পষ্ট রূপ ধরা পড়ে আহমেদ রফিকের লেখায়। আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার ক্লান্তি, অবসাদ, দুঃখ, বিচ্ছিন্নতায় বিপন্ন মানুষ শেষমেষ প্রকৃতির অপরূপ মহিমায় নিজেকে সমর্পণ করে। প্রকৃতির সঙ্গে নতুন উদ্যোম আর উদ্যোগে মিত্রতার গ্রন্থী তৈরি করে। প্রকৃতিকে সমাজসত্তার প্রতিপক্ষ না ভেবে সহযোগী ভাবাই অত্যন্ত জরুরী। সাবেরের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পরাস্ত সহিস’-এর গল্পে তাঁর প্রকৃতিপ্রেম যেভাবে আধুনিক সভ্যতার ওপর নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে তা পাঠকদের মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যায়। ১৯৮২ সাল থেকে তাঁর সত্যিকারের সাহিত্যিক অঙ্গনে প্রবেশ করা। সময়ের আর্থসামাজিক অবয়ব তাঁকে যেভাবে আন্দোলিত করে সেখান থেকেও স্পষ্ট হয় তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা এবং দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা। সময়টা একেবারে ’৭৫-এর পরবর্তী দুঃসহ অভিযাত্রার এক নির্মম নিষ্ঠুর অধ্যায়। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধর্ষিত হওয়ার এক বেদনাচ্ছন্ন অনুভব মঈনুল আহসানকে নানাভাবে উদ্বেলিত করে। যা স্পষ্ট হয়েছে কবির চৌধুরীর লেখায়। ‘রেল স্টেশনে শোনা গল্প’ পড়তে গিয়ে পাঠককে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বিরোধী চক্রের নানা টানাপোড়েনে পড়তে হয়। পুরো আশির দশকটা ছিল স্বৈরশাসনের এক উত্তাল সময়। যা সৃজনশীল মানুষদের বিভিন্ন মাত্রিকে উদ্বিগ্ন করে দিশেহারা এবং উৎকণ্ঠিত করে। সাহিত্যিক সাবেরও তার মধ্যে নিজের শিল্পচর্চাকে ব্যাপৃত রাখেন। শিশু-কিশোরদের নিয়ে তাঁর আরও একটি চমৎকার সৃষ্টিশীল বলয়কে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এখানে বিত্ত আর নির্বিত্তদের ফারাকও চোখে পড়ার মতো। ছোটদের নিয়ে লেখা বই ‘সবচেয়ে সুন্দর’ এ স্থান পেয়েছে প্রায় ৯টি ছোটগল্প। এখানে বালক থেকে কিশোরদের বহুমাত্রিক প্রশ্নের অবতারণা করা হলেও শেষমেষ গন্তব্য একটিই খাদ্য এবং ক্ষুধা। যা সিরাজুল ইসলাম অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। গ্রন্থটির শেষে সন্নিবেশিত করা হয়েছে মঈনুল আহসানের একটি সুচিন্তিত এবং পরিশীলিত সাক্ষাতকার। যাতে তিনি উল্লেখ করেন তাঁর লেখার হাতেখড়ি থেকে এই পর্যন্ত সৃষ্টিশীল উদ্যমকে নিরন্তর করার বিভিন্ন কর্মপ্রক্রিয়া। কবির সন্তান হওয়া সত্ত্বেও গল্প এবং উপন্যাসের বলয়ে নিজেকে নিমগ্ন রাখার বিষয়টি ক্ষমতার সঙ্গে দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গও তিনি এড়িয়ে যাননি। আগেই উল্লেখ করা হয় ছোট্ট বয়সে বাবাই পড়ার বিষয় নির্ধারণ করে দিতেন যেখানে কোন কবিতার বই থাকত না। গল্প, উপন্যাস আর প্রবন্ধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হতো। গ্রন্থটি পাঠকদের জন্য একটি বিশেষ মূল্যবান বই হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সেখানে শুধু মঈনুল আহসানই নন সমকালীন সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির একটি স্বচ্ছ পরিচয় পাওয়া সম্ভব হবে। বইটির সর্বাঙ্গীণ সফলতা কামনা করছি। নাজনীন বেগম
×